১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

জন লকের দর্শন : ইসলামের কাছে ঋণ

জন লকের দর্শন : ইসলামের কাছে ঋণ - নয়া দিগন্ত

পশ্চিমা আলোকায়নের প্রভাবশালী দার্শনিক জন লক আধুনিক উদারবাদ এবং রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশের কাণ্ডারি। তাকে ধর্মনিরপেক্ষতার উদগাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার প্রভাবশালী গ্রন্থ ‘টু ট্রিটিসিস অফ গভর্নমেন্ট’ এবং ‘এন অ্যাসেস কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ পশ্চিমা দর্শন এবং রাজনৈতিক তত্ত্বের শরীর-মনে অবিচ্ছেদ্য প্রভাব রেখেছে। ধর্মীয় সহনশীলতা, ব্যক্তি অধিকার এবং সরকার সম্পর্কে জন লকের ধারণাগুলো আজকের পশ্চিমা বোধকেও শাসন করছে। লকের চিন্তা অধ্যয়ন থেকে বহু গবেষক দেখিয়েছেন, তার দর্শনের নানা দিক ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য থেকে আহরণকৃত। ইসলামের প্রভাবকে এড়িয়ে তিনি জীবনকে পাঠ করতে পারেননি।
ধর্মীয় সহনশীলতার বিষয়ে লকের ধারণা পশ্চিমের সাপেক্ষে ছিল যুগান্তকারী। এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করা যায় সেই কক্ষপথে, যেখানে তার দার্শনিক নীতি ও ইসলামের মধ্যে সম্পর্কের বোঝাপড়া ঘটেছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিষয়ে তার চিন্তাধারা জন্ম নিয়েছিলো খ্রিষ্টান সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে তীব্র ধর্মীয় সঙ্ঘাতের সময়। এই পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় লক গির্জা এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে যুক্তি দেন, যা ধর্মনিরপেক্ষতাকে দার্শনিক ভাষা দান করে। লক সামাজিক শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনের উপায় হিসেবে ধর্মীয় সহনশীলতার পক্ষে সোচ্চার হন।

লক বিশেষভাবে ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এমন স্বীকারোক্তি তার নেই। তবে ইসলামিক দর্শনের অনেক দিকের প্রতিধ্বনি লকের দর্শনে সুস্পষ্ট।
লকের ধারণা এবং ইসলামী দর্শনের মধ্যে সম্ভাব্য সংযোগের বহুমুখী ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন-

১. সহনশীলতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা : ইসলামী ঐতিহ্য ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি দেয়, সহনশীলতা ও নাগরিকদের ধর্মপালনের অধিকার রক্ষার উপর জোর দিয়েছে।
লক একই ধারণা হাজির করেছেন। তবে তা ধর্মনিরপেক্ষ অবয়বে। গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে যুক্তি দেন। ধর্মীয় সহনশীলতাকে তিনি সমর্থন করেন এবং রাষ্ট্রের জবরদস্তি ছাড়াই তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার ওকালতি করেন।

২. সহজাত অধিকার : ইনসানিয়াত, আদালত ও হুকুক বা মানবতা, ন্যায়বিচার ও অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বিষয়। এগুলো মানুষের প্রাকৃতিক অধিকার। যার প্রতি অঙ্গীকার ঘোষণা করত উসমানি সালতানাতও। জন লক জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারকে উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করেন। ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে ন্যায়বিচার, সমতা এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার জরুরি নীতি লকের অজানা ছিল না। যেখানে সংখ্যালঘুর অধিকার ও প্রশাসনের জবাবদিহিতার নীতি সুস্পষ্ট। সহজাত অধিকার সম্পর্কে লকের ধারণার কোনো পূর্বসূরিতা খ্রিষ্টীয় দর্শনে নেই, ইসলামী দর্শনে আছে।

৩. যুক্তি এবং উন্মোচন : ইসলামী দর্শনে আকল বা যুক্তি-বুদ্ধি ও মুকাশাফা বা মানসিক উন্মোচনের মূল্য ব্যাপক। জন লক তার লেখায় যুক্তি এবং মানসিক উদ্ঘাটনের সামঞ্জস্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর পক্ষে পশ্চিমা মনকে তৈরি করেছেন।

৪. সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব : ইসলামী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার মর্মমূলে আছে শূরা বা পরামর্শভিত্তিক ব্যবস্থা। এটা সামাজিক-সামষ্টিক সম্মতির একটি পরিক্রমা, যেখানে শাসিতদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। জন লক উপস্থাপন করেছেন ঝড়পরধষ ঈড়হঃৎধপঃ-এর তত্ত্ব। যাকে সামাজিক চুক্তি বলে আমরা জানি। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শাসিতদের সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র মানুষের বৃহত্তর সম্মতির ফসল।

৫. সম্পত্তির অধিকার : ইসলামী আইনে সম্পত্তির অধিকারের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সম্পদ বণ্টনের নীতিমালাও পরিষ্কার। শ্রমনীতিও এখানে বিন্যস্ত। জন লক মালিকানার ভিত্তি হিসেবে সম্পত্তির অধিকারের ওপর জোর দেন। শ্রমের ওপর গুরুত্ব দেন। পশ্চিমা বিশ্বে সামন্তবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সম্পদে মানুষের অধিকারকে তাত্ত্বিক ভাষা দেন।
সম্পত্তির অধিকার ও লকের শ্রমতত্ত্ব দাবি করে, ব্যক্তিরা তাদের শ্রমের মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জন করে এবং এটিকে প্রকৃতির সম্পদের সাথে মিশ্রিত করে। যা সম্পত্তির অধিকারের বিষয়ে ইসলামী আইনশাস্ত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ইসলামে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। তবে সম্পদকে নৈতিকভাবে ব্যবহার করা এবং গরিবের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণ করার জন্য ইসলাম অনেকগুলো কর্তব্য নির্দেশ করে। জন লক সাধারণ ভালোর জন্য নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার অধীনে সম্পত্তির মালিকানার তত্ত্বে একে তার মতো রূপায়িত করেন।

৬. সরকার ও সাধারণ সম্মতি : নেতৃত্বের ভিত্তি জবরদস্তি হতে পারে না। শাসিতদের প্রতিনিধি কিংবা শূরা বা প্রাধান্যমূলক সাধারণ মত নেতৃত্ব নির্বাচন করবে। শাসকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এটিই ইসলামের শিক্ষা। জন লক সরকারের শাসনের বৈধতার জন্য জনতার সম্মতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। সামাজিক চুক্তি এবং সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে লকের ধারণার মর্মমূলে ছিল একটি সমাজের মধ্যে মুসলিমসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাথে আচরণের নীতি। লকের মতে, সরকারগুলো বৈধতা অর্জন করে শাসিতদের সম্মতি থেকে। সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির মতো প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য। নাগরিকরা যে ধর্মের হোক, সরকার তাদের অধিকার লঙ্ঘন করবে না।

৭. চিন্তার স্বাধীনতা : ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের মধ্যে পণ্ডিতরা অবাধে বিভিন্ন ধারণা নিয়ে বিতর্ক করেছেন। এমনকি ধর্মীয় জীবনেও এই অনুশীলন যথাযথ প্রিন্সিপলস তৈরি করেছে। ইসলামের সেই নীতিমালা বিশ্বব্যাপ্ত ছিল, যা চিন্তার স্বাতন্ত্র্যকে আপন আদলে সমর্থন করে এবং মুসলিম রাষ্ট্রে বিদ্রোহাত্মক সম্ভাবনার আগ অবধি বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এমনকি ইসলাম গ্রহণের প্রশ্নে স্বাধীন ইচ্ছার মূল্য বিপুল এবং মুসলিম জীবনে ব্যক্তিগত প্রত্যয়ের গুরুত্ব ব্যাপক।
জন লক বিবেকের স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। তিনি তার পত্র A Letter Concerning Toleration-এ সমাজে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের গ্রহণযোগ্যতার জন্য একটি বাধ্যতামূলক বিষয় উপস্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাব করেন রাষ্ট্রকে মতামত ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এর উপর তালা ঝুলানো যাবে না। তবে জন লকের এই স্বাধীনতা কতটা এবং তা অন্যের স্বাধীনতাকে পিষ্ট ও পীড়িত করবে কি না তা অস্পষ্ট।

৮. সমতা এবং মানবমর্যাদা : ইসলামে মানুষের জীবনের, বিশ্বাসের, সম্পদের, সম্মানের, বুদ্ধির ও বংশের মূল্য অত্যন্ত উচ্চে। ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজের সব আইনি ব্যবস্থা এসবের সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত। সাম্য ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে একে করা হয় নিশ্চিত। জন লক তার চিন্তায় এই মূল্যবোধগুলোর ওপর জোর দেন। এর প্রতিধ্বনি করেন নিজের আদলে।

৯. প্রাকৃতিক আইন : ইসলাম ফিতরাত বা প্রাকৃতিক আইনের ধর্ম। এ আইনকে ফিতরাতুল্লাহ বা আল্লাহর প্রকৃতি বলা হয়েছে। এটি চিরন্তন, এতে পরিবর্তন হয় না। ইসলামের ‘ফিতরাহ’ তত্ত্ব সেই সহজাত প্রকৃতি বা প্রবণতাকে বোঝায়, যার ওপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যা অন্তর্নিহিত নৈতিক বোধের উপর জোর দেয়, মানুষের আচরণকে পথপ্রদর্শন করে এবং নৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে আকার দেয়।

লক প্রাকৃতিক আইনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নৈতিক নীতির ভিত্তি তৈরি করে। যদিও লকের প্রাকৃতিক আইনের আলোচনা প্রাথমিকভাবে তার খ্রিষ্টান পটভূমি এবং এনলাইটেনমেন্ট থেকে শুরু হয়েছিল। কিন্তু তার প্রাকৃতিক আইনের ধারণা ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক ধারণার সাথে অনেক ক্ষেত্রেই সমান্তরাল।

১০. অভিজ্ঞতাবাদ ও সেতুবন্ধন : অভিজ্ঞতাবাদী জ্ঞানতত্ত্বে ইউরোপকে পথপ্রদর্শন করেছে মুসলিম দর্শন। বিশেষত আন্দালুসীয় দার্শনিক ইবনে তোফায়েলের হাই ইবনে ইয়াকজান। লকের চিন্তা ও বিশ্লেষণে তার উত্তরসূরিতা সুস্পষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে জন লক ইবনে তোফায়েলের অভিজ্ঞানগুলোকে সূত্র উল্লেখ না করেই বিস্তারিত করেছেন।
ইবনে তোফায়েল দেখিয়েছেন, মানুষ যখন জন্ম নেয়, তখন সে কোনো জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীতে আসে না। জন্মের পর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তাকে শেখাতে শুরু করে। এরই মাধ্যমে সে ক্রমে ক্রমে জ্ঞান লাভ করে। জন লকের দাবিও এটিই।

অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের জন্য জন লকের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে পৃথিবী। কিন্তু ইবনে তোফায়েল একে হাজির করেছিলেন দৃঢ়তার সাথে। আর তার কাজটি ছিল আল-কুরআনের বাণীর বিশ্লেষণ। যেখানে ঘোষিত হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে যখন বের করেছেন, তখন তোমরা কিছুই জানতে না। এরপর, তিনি তোমাদেরকে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও মস্তিষ্ক দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।’ (সূরা নাহল-৭৮)

ইসলামী দর্শন ও ভাষ্যগুলোর সাথে লকের সেতুবন্ধনের সুযোগ ছিল অবারিত। তার সময়ে লাতিন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় ইসলামিক গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে প্রচুর। এসব অনুবাদ তাকে নানাভাবে ইসলামিক দার্শনিক ধারণার সম্মুখীন করে থাকবে।
জন লকের দর্শন ধর্মীয় সহনশীলতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার আধুনিক ধারণার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তিনি তার লেখায় ইসলামকে ব্যাপকভাবে সম্বোধন করেননি বটে। কিন্তু ধর্মীয় সহনশীলতার জন্য তার তাত্ত্বিকতা, প্রাকৃতিক আইনের স্বীকৃতি এবং ব্যক্তি অধিকারের প্রতিরক্ষা ইসলামী নীতির নির্দিষ্ট কিছু দিকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জন লকের সমস্ত দার্শনিক মতামতের কেন্দ্রীয় ধ্রুব হলো একটি সারসত্য; প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক মানব আইন মানবজাতির সংরক্ষণ।

অপর দিকে, ইসলামী জীবনব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে যে শাস্ত্র, তার নাম মাকাসিদুশ শরিয়া বা শরয়ি বিধি-বিধানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এই শাস্ত্র স্পষ্ট দেখিয়ে দেয়, মহান আল্লাহ সব প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা ও আইনকে বিন্যস্ত ও প্রবর্তিত করেছেন মূলত মানবজাতির সংরক্ষণের জন্য।
ইসলামের কাছে ঋণ স্বীকার করতে চাননি জন লক। একে এড়িয়ে গেছেন সযতেœ। কিন্তু জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি সম্পর্কে তার তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি পরীক্ষা করলে ইসলামের বহু নীতি ও তত্ত্বের সাথে এর নিবিড় যোগসূত্র প্রকাশ পায়। যদিও গির্জার প্রতি বিরক্ত জন লক ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে মানুষের স্বাধীনতার যে কল্পনা করেছেন, তার সাথে ইসলামের দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট।

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement