০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ব্যাংকে তারল্য ঘাটতির কারণ

ব্যাংকে তারল্য ঘাটতির কারণ - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ ব্যাংকিং খাত ধারাবাহিকভাবে সীমাহীন তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। কেবল তীক্ষ্ণ আমানত বৃদ্ধি এবং নিম্নবিনিয়োগ ব্যবস্থা ব্যাংক খাতে ক্রমাগত তারল্যের চাপ নিরাময় করতে তেমন সফল হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর ব্যাংকের ভল্টের টাকা বাড়তে দিচ্ছে না। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি, ঋণ আদায়ের ধীরগতি, খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। জীবনযাত্রার ব্যয় সঙ্কটের কারণে আমানতের ধীরগতি ও সরকারি খাতে ঋণের প্রসারও বর্তমান তারল্য সঙ্কটের জন্য দায়ী।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ব্যাংকারদের মতে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, ঋণের সহজ পুনঃনির্ধারণব্যবস্থার কারণে এনপিএল সৃষ্টি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের বিপুল ঋণ নেয়ার ফলে অর্থ সরবরাহ সংকুচিত হওয়ার কারণেও ব্যাংকে তারল্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস, রফতানি আয় হ্রাস ইত্যাদিও তারল্য সঙ্কটে ভূমিকা রাখছে। তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক পাওনা পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) থেকে রেকর্ড দামে মার্কিন ডলার ক্রয়, উচ্চ বাজিতে সরকারি সিকিউরিটিজে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ করায় তাদের হাতে থাকা অতিরিক্ত তারল্য ও নগদ অর্থ কমে যাওয়ায় সঙ্কট গভীরতর হয়েছে।

তথ্য মতে, তারল্য ব্যবস্থাপনার উপর ক্রমবর্ধমান চাপ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আন্তঃব্যাংকের ঋণের উইন্ডোগুলো থেকে ভয়ভাবনাহীনভাবে তহবিল সংগ্রহে প্ররোচিত করেছে। ফলে কল-মানিরেট ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বিনিয়োগের সুদের হার সুবিধা ৯.৭৫ এ পৌঁছেছে। আমানত সংগ্রহের সুদের হার ৫.৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এর ফলে তারল্য সঙ্কটে ব্যাংকগুলোর ব্যালান্স শিট স্থিতিশীল করতে তারল্য ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।

বিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আগস্ট মাসে ১ দশমিক ৭৪ ট্রিলিয়ন টাকা থেকে কমে সেপ্টেম্বরে ১ দশমিক ৬৪ ট্রিলিয়ন টাকায় নেমে এসেছে। এ বছরের জুলাই মাসে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ১.৮১ ট্রিলিয়ন টাকা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২.৩৪ ট্রিলিয়ন টাকা। উল্লেখ্য, অতিরিক্ত তারল্যের মধ্যে নগদ টাকা ছাড়াও অন্যান্য নগদ টাকা যেমন ট্রেজারি বিল, বন্ডসহ বিভিন্ন নগদ এবং নগদ সমতুল্য সম্পদ অন্তর্ভুক্ত।

ব্যাংকের ভল্টে ক্যাশ করার মতো নগদ তহবিলও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এবং সেপ্টেম্বরের শেষে তা ৩০৭ বিলিয়ন টাকায় নেমে এসেছে। আগস্ট ও জুলাই মাসে নগদ অর্থের পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে যথাক্রমে ৩৩১ বিলিয়ন এবং ৩৯২ বিলিয়ন টাকা। যেহেতু ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত চাপের মধ্যে পড়ে, ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিট স্থিতিশীল করতে তহবিল ঘাটতি মেটানোর জন্য তারল্য সমর্থন বেড়েই চলেছে। দেশের শরিয়াহভিত্তিক ৬টি ব্যাংকসহ অন্তত এক ডজন ব্যাংক বর্তমানে চরম তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। এছাড়া তারা বিবির নিয়ম অনুযায়ী, ন্যূনতম তারল্যের সীমা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ১ দশমিক ২৮ ট্রিলিয়ন টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে ক্রেডিট হস্তান্তর করার প্রবণতা অব্যাহত থাকার কারণে বিগত কয় মাসে তারল্য সমর্থনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে যা, আগস্ট মাসে ১ দশমিক ৩৩ ট্রিলিয়ন টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে ১ দশমিক ৬৭ ট্রিলিয়ন টাকা এবং অক্টোবরে ৩ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছায়।

বিশেষ সূত্র মতে, সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকিং সিস্টেমের আমানত ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন একই মাসে বেসরকারি-খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হয়ে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা আগের বছরের ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশের চেয়ে কম। এদতসত্ত্বেও, ব্যাংকগুলো এখন তারল্যের চাপের সম্মুখীন হচ্ছে প্রধানত উচ্চতর খেলাপি এবং বিবির ডেভেলপমেন্ট এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে। এখন, ব্যাংকগুলো সম্পূর্ণরূপে সরকারের দেশীয় ব্যাংকঋণের চাহিদা পূরণ করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশে, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমেছে। বিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি। ব্যাংকাররা বলছেন, সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ঋণপত্রের একটি অংশও ইতোমধ্যে ফোর্স ঋণে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নভেম্বরের ২৩ তারিখ কলমানি রেটের ঋণের সুদের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশে।

বিবির তথ্যমতে, নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে আন্তঃব্যাংক কলমানি মার্কেটে লেনদেন হয়েছে ৯ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। গত বছরের একই দিনে ছিল ৯ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা। ব্যাংকারদের মতে, ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে কলমানি মার্কেটে ব্যাপক চাপ দেখা যাচ্ছে। তাই সুদের হার বাড়ানো সত্ত্বেও শরিয়াহভিত্তিকসহ অনেক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে তারল্যসহায়তা নিচ্ছে।

ব্যাংকিং সেক্টরের সম্পদের একটি মূল অংশ পারফর্ম করছে না বরং এনপিএলের কারণে আটকে আছে। অথচ ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক অর্থপ্রদানের বাধ্যবাধকতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে প্রচুর ক্রেডিটের টাকা ব্যয় করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর তারল্যচাপ কমাতে ডেভেলপমেন্ট মেকানিজমের মাধ্যমে সরকারের জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যাংকঋণ গ্রহণের বেশির ভাগ পূরণ করত। কিন্তু সম্প্রতি, বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবং ব্যাংক-ঋণগ্রহণের চাহিদা ব্যাংকের মাধ্যমে পূরণের জন্য ব্যাপক ঋণ গ্রহণের পদক্ষেপ থেকে সরে এসেছে। এই সব কারণে তারল্য সঙ্কট বাড়ছে। বিবি যদি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তারল্য সঙ্কট হ্রাসে সহায়তা বন্ধ করে তাহলে পরিস্থিতি গুরুতর হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে এক বছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে, যা তারল্য সঙ্কট আরো বাড়িয়েছে। ডলার বিক্রি এখনো অব্যাহত এবং গড়ে প্রতি মাসে ১১৫ কোটি ডলার পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে এই প্রবণতা বাড়তে পারে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স এবং আমদানি আদেশের প্রবাহ কমেছে। তার পরও রফতানি আয়ের অর্থ সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না।
এগুলো তারল্য পরিস্থিতির ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করছে। এই ধরনের তারল্যের চাপের মধ্যে, গুরুতর তারল্য-সম্পর্কিত সমস্যা এড়াতে আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিবির সংকোচন-নীতির কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে তারল্য পরিস্থিতি আরো সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

উচ্চতর এনপিএল থাকা সত্ত্বেও, ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের পুনর্র্নির্ধারণের নীতি শিথিল করায় তারল্যের ওপর আরো চাপ পড়েছে। আগে ঋণখেলাপিদেরকে ১০ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনর্নির্ধারণসুবিধা পেতে হতো, এখন তা মাত্র আড়াই শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে পাওয়া যায়। ব্যাংকারদের মতে, ব্যাংকগুলোতে স্ট্রেস অ্যাসেটের প্রকৃত আকারের চেয়ে এনপিএল-এর পরিমাণের অনেক বেশি হবে যদি ঋণ পুনর্নির্ধারণ এবং রাইট-অফের পরিমাণ বিবেচনায় নেয়া হয়।

প্রশ্ন আসে, এই তারল্য সঙ্কট হলো কেন কিংবা টাকা গেল কোথায়? উত্তরে বলতে হয়, সাধারণ গ্রাহক ব্যাংকে যে পরিমাণ টাকা জমা রাখেন, ব্যাংকগুলো সেই টাকাই ঋণ হিসাবে বিতরণ করে। সেক্ষেত্রে জমাকৃত অর্থ ও বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেশে জমা ও বিতরণের মধ্যে মস্ত ফারাক দেখা গেছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া, অবৈধ ও কালো টাকা বেড়ে যাওয়ায় দুর্নীতিবাজরা কালো টাকাকে প্রতিষ্ঠানে না আনা, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে আমানত কমে যাচ্ছে। একইভাবে মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের সঙ্কট এবং অতিমূল্যায়নের কারণে বিতরণের চাপ বেড়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে শাসকদের মধ্যে যে কোনো সঙ্কট-সমস্যা অস্বীকারের প্রবণতা দেখা যায়। তারা এটাকে সরকারের ব্যর্থতা মনে করে। প্রকৃতপক্ষে, সব সঙ্কটের ব্যর্থতার দায় সরকারের নয়। তবে সঙ্কট যদি সরকারের ভুলনীতির কারণে সৃষ্টি হয়, যদি সঙ্কটের আভাস পেয়েও তা আমলে না নেয়ার কারণে হয় এবং সঙ্কট যদি সরকারসংশ্লিষ্টদের দ্বারা সৃষ্ট হয়, তাহলে তার দায় তো সরকারকে নিতেই হবে। তাই একটি বিবেচক সরকারের উচিত, কোনো সঙ্কটের আভাস পেলে তা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান তারল্য সঙ্কট অনুমানের বাইরে ছিল না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সঙ্কট চলছে, অথচ এটাকে কোনো সমস্যাই মনে করছে না সরকার। এখন সঙ্কট স্বীকার করে তা কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিতে হবে। এসময় ব্যাংকগুলোকে শুধু উৎপাদনশীল খাতে ঋণ দিতে হবে। সেইসঙ্গে বাড়াতে হবে তদারকি। যারা ব্যাংক খাতের এ অবস্থার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংককে মানুষের আস্থায় আনতে হবে। সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে সাময়িক সমাধান করা গেলেও একই সমস্যা আবার ফিরে আসবে; মাঝখান থেকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং আরেক দফা মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। ডলার পাচার রোধ এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার প্রকৃত সুশাসন।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement