২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাজা হলোকাস্ট

গাজা হলোকাস্ট - প্রতীকী ছবি

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ইসরাইলকে তার ‘পোড়ামাটি নীতি’ কৌশল পরিত্যাগ করতে বলেছেন। তার মতে, হামাসকে ‘ধ্বংস করা অসম্ভব’। সংখ্যাগরিষ্ঠ বেসামরিক জনগোষ্ঠীসহ গাজা উপত্যকা ধ্বংস করা ভিন্ন বিষয়। ল্যাভরভ ৭ অক্টোবর হামাসের পদক্ষেপ ও ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া ‘নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি’ উভয়েরই বিরোধিতা করেন এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।

নির্বিচারে মানুষ হত্যা ও ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে গাজা থেকে বহিষ্কার করা হলে খুব সম্ভব আরো এক শতাব্দীকাল বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠন ছাড়া আশু কোনো সমাধান নেই, তবে আগেও বলেছি, স্বাধীন রাষ্ট্র হলেই যে শান্তির বারি বর্ষিত হবে তাও নয়। রাষ্ট্রকে ধরে রাখা ও ইসরাইলি ‘পবিত্র ভূমি দখল’ নীতির কারণে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের যুদ্ধই করে যেতে হবে। তবে বর্তমানে চলমান ইহুদি-জিয়নিজমের পোড়ামাটি নীতি গাজায় বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করেছে। গাজা এখন আরব শহীদদের বৃহত্তম কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।

ইউক্রেনে দুই বছরের যুদ্ধে ৫০০ শিশু নিহত হলেও গাজা সঙ্ঘাতে নিহতের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী দুই হাজার শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং ৭০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করছে। আহতের সংখ্যা ৩২ হাজার ৫০০, বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২৩৮টি হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। হামলায় তিন হাজার ২৫০ ফিলিস্তিনি নিখোঁজ বা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে।

ইসরাইলের নির্বিচারে বোমাবর্ষণে মৃতের সংখ্যার মধ্যে আট হাজারের বেশি শিশু ও নারী। নিহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই মার্কিন প্রশাসন এসব পরিসংখ্যান বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নয়। এখন গাজাবাসীর লুকানোরও জায়গা নেই। যেসব অসহায় ফিলিস্তিনির ছবি মিডিয়ায় এসেছে সেগুলো দেখে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে। শুধ মুসলমান নয়, ইউরোপীয় ও পশ্চিমা সংসদে সদস্যরা নিন্দাবাদ জানিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিচ্ছেন। হাসপাতাল, স্কুল ও মসজিদ, গির্জা সবই বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

গাজাবাসীর একমাত্র পছন্দ হলো মৃত্যু এবং উদ্বাস্তু শিবির। এখন আশ্রয়শিবিরেও নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে। এডলফ হিটলারের অশুভ সাধনার মতো, তারা পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্তু করছে। হিটলার ইহুদি মেরেছিল, তার মতে- এরা দুনিয়ার সবচেয়ে অসৎ ও অনির্ভরযোগ্য। অথচ হিটলার হাসপাতাল, আশ্রয়শিবির এসব কিছুকে লক্ষ্যবস্তু করতে নিষেধ করেছিলেন। তারপরও তিনি জেনারেল আইখম্যানকে দিয়ে যে হাজার হাজার ইহুদি হত্যা করেছিলেন সেটি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হলোকাস্ট হিসেবে চিহ্নিত।

বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার ২০ শতাংশসহ ১৯টি আরব রাষ্ট্র রয়েছে। এই সংখ্যার সাথে অন্য ২৯টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যোগ করলে ১৯১ সদস্যের জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ৪৮টি শক্ত ভোট হয়। ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিরা কথায় নয়; বরং তাদের আরব ভাইদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়া কোনো দয়া নয়, আবশ্যিক যা দুর্ভাগ্যক্রমে এখনো হয়নি। আল-আকসা মসজিদ কি শুধু ফিলিস্তিনিদের? মুসলমানদের জন্য তৃতীয় পবিত্র স্থান হলে কেন এই ন্ম্রতা? এর প্রধান কারণ- এই দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য। তারা ধর্মীয়ভাবে, জাতিগতভাবে, রাজনৈতিকভাবে এমনকি গোত্রগতভাবে বিভক্ত এবং সেই বিভাজনটিকে বৃহৎ শক্তিগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য দক্ষতার সাথে ব্যবহার করছে। শিয়া-সুন্নি, আরব-অনারব, খারেজি-রাফেজি, সালাফি, আহলে হাদিস, আহলে কিতাব- এসব বিষয়ে আমরা যতটুকু জানি ইহুদি ও তাদের দোসররা অনেক বেশি জানে। তেলআবিবে রয়েছে প্রকাণ্ড এক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে শুধু ইহুদিরা পড়ালেখা করতে পারে ও ডিগ্রি নেয়।

জাতিসঙ্ঘে সব মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা সাধারণ পরিষদ থেকে নীরবে ওয়াকআউট করেছিলেন ২০০২ সালে যখন জর্জ বুশ ইরাক আক্রমণের জন্য সমর্থন চেয়েছিলেন।
অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে, তাদের প্রজারা কী চিন্তা করে এবং কী চায়, তাদের শাসকরা কী বিশ্বাস করে এবং কী দিচ্ছে তার মধ্যে এক সমুদ্রের ব্যবধান রয়েছে। এ ধরনের ফাঁক সহজেই লক্ষ করা যায় ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের ব্যাপারে। বিশাল আরব ভাষাভাষীর দেশগুলো, যা আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত, শাসন করার জন্য জনপ্রিয় কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং তারা আংশিকভাবে বিদেশী শক্তির সমর্থনে ও আংশিকভাবে তাদের নিজস্ব জেন্ডারমেরির সমর্থনে টিকে আছে। স্বাধীনতাকামী যেকোনো গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে শাসক শ্রেণী ভীত। পশ্চিমারা এই বিষয়টিকেও পুঁজি করে কৌশল ঠিক করে।

ইসরাইল হামাস আন্দোলনকে ধ্বংস করতে চায়। কিছু আরব শাসকও ইসরাইলের সাথে একমত পোষণ করে। তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি ফ্রন্টকে ধ্বংস করতে চায়, যা আরব বিশ্বে পরিবর্তনের দাবিতে একমাত্র প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত। এটি সাধারণত বিশ্বাস করা হয় যে, আরব বিদ্রোহ ও বিপ্লবের পরে আরব বিশ্বে হামাসই একমাত্র ইসলামী আন্দোলন চালু রেখেছে। ইসরাইল ও তার সমর্থকরা আরব বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে, হামাস ইস্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি মনে করে। অন্য দিকে, হামাসকে মধ্যপ্রাচ্যের স্বাভাবিকীকরণ ও রূপান্তরের পথে বাধা হিসেবে বিপক্ষ শিবির বিবেচনা করে।

প্রথম নাকবার সময় ইসরাইলিরা ৭৭৪টি শহর ও গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করেছিল। নাকবাকে সংক্ষেপে দুদর্শার অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রুখে দাঁড়ানোকে বুঝানো হয়। ইহুদিরা ৫৩১টি ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রাম ধ্বংস করে। ইসরাইল বাহিনীর নৃশংসতা হিসেবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ৭০টিরও বেশি গণহত্যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নাকবার সময় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়।

যে এলাকায় ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়, ইসরাইলি বাহিনী সেখান থেকে বেশির ভাগ আরবকে বহিষ্কার করে, প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে অনেকে পালিয়েও যায়।
১৯৪৮-৪৯ এই দু’বছরের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় ৭.৫ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। প্রায় ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি জাতিসঙ্ঘে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। তাদের বেশির ভাগই বাস করে জর্দান, গাজা ভূখণ্ড, পশ্চিমতীর, সিরিয়া, লেবানন ও পূর্ব জেরুসালেমে। তাদের এক- তৃতীয়াংশ বসবাস করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। এই শিবিরগুলোকে যেকোনো দুর্যোগ থেকে নিরাপদ মনে করা হয়। কিন্তু আজ সেখানেও বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের প্রধান দাবি, তাদের জমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার। এই দাবির ভিত্তি হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালে গৃহীত এক প্রস্তাব। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যেসব শরণার্থী তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চাইবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিতে বসবাস করবে তাদেরকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।’ ইসরাইলের বক্তব্য হলো, ৫০ লাখ শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয়া অসম্ভব। কারণ সেরকম কিছু হলে তারাই ৮৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়বে এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের সমাপ্তি ঘটবে। তাই যেভাবেই হোক- হত্যা, নির্যাতন, বোমা মেরে নিশ্চিহ্নকরণ, পানি, খাবারের সঙ্কট সৃষ্টি করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া, আগামীতে বড় হবে এমন শিশুদের হত্যা করা, বাছাই করে মেধাবী ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা- এসব চলছে বিগত ৭০ বছর ধরে। ফিলিস্তিনিদের বিপরীতে ইসরাইল ‘পবিত্র ভূমিতে ফেরার অধিকার’ ও ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ নামে আইন পাস করেছে। সে আইন কার্যকর করার জন্য ফিলিস্তিনিদের ধ্বংসের কর্মসূচি নিয়েছে।

৭ অক্টোবর থেকে প্রায় প্রতিটি মসজিদে জুমার খুতবায় ফিলিস্তিন এবং আল-আকসা মসজিদের ধর্মীয় তাৎপর্য, ইসরাইলি দখলদারিত্ব ও নিপীড়ন, দুর্ভোগের কথা প্রচার হচ্ছে। এই উপদেশগুলোর সাথে ঐশ্বরিক অনুগ্রহের জন্য হৃদয়গ্রাহী দোয়ার মাধ্যমে জুমার কার্যক্রম শেষ হচ্ছে। পরোক্ষভাবে, এই উপদেশগুলোর সাথে আরব শাসকদের অযোগ্যতাও শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তাই আমেরিকার চাপের কাছে ফিলিস্তিনকে কার্যত ইসরাইলের কাছে সমর্পণ করা নিয়ে সাধারণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম দেশ এবং অন্যত্র জনবিক্ষোভ নিয়মিত চলছে। যুদ্ধ দেড় মাস পার হলো, যতটুকু সহায়তা মুসলিম ভাইদের কাছ থেকে পাওয়ার ততটুকু পায়নি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে ‘অচল করে দেয়ার’ কর্মসূচি নিয়েছে ওখানকার সাধারণ জনগণ, এদের মধ্যে অমুসলিম বেশি। এ কারণেই যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না হলে, চলতি হলোকাস্ট থেকে তাৎপর্যপূর্ণ দ্বিতীয় আরব বসন্ত জেগে উঠবে; জেগে উঠবে আরেক আল-নাকবাও।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement