২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উম্মাহর ঐক্যের অতীত দৃষ্টান্ত : অনৈক্যের পরিণতি

উম্মাহর ঐক্যের অতীত দৃষ্টান্ত : অনৈক্যের পরিণতি - নয়া দিগন্ত

উপমহাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন মাসলাক ও চিন্তাধারার ওলামা ও মাশায়েখ ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে জমায়েত হয়ে অভিন্ন কর্মসূচি দেয়ার এক গৌরবদীপ্ত নজির স্থাপন করেছেন, যা আগামী দিনে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে ভূমিকা রাখবে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের ক্ষমতার ভার এমন ব্যক্তিদের প্রতি সোপর্দ করা হয়; যারা মুখে ইসলামের কথা বললেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন না। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল তাদের মধ্যে অনেকের ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা ছিল অস্পষ্ট। ইসলামী জীবনপদ্ধতি অনুশীলনে তারা ছিলেন অনভ্যস্ত। আমলারা ছিলেন কমবেশি সবাই ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামের ভূমিকার ওপর তাদের বিশ্বাস সুদৃঢ় ছিল না।

ক্ষমতার বাগডোর হাতে আসার পর তৎকালীন পাকিস্তানের নেতারা বিশেষত মুসলিম লীগাররা ইংরেজ কায়দায় সরকার পরিচালনা করেন। দেশের জন্য স্থায়ী সংবিধান রচনা সম্ভব হয়নি। ধন-বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে, গোলামি যুগের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে নতুনভাবে গড়ে তোলা যায়নি। স্বাধীনতা আটকে পড়ে রইল একটি ভূখণ্ড ও একটি পতাকায়। ক্ষমতাসীন নেতারা প্রতিশ্রুত ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বারবার ওয়াদা খেলাপ করেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের জিন্দাদিল ওলামায়ে কেরাম নিশ্চুপ বসে রইলেন না। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা দিয়ে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ওলামাদের অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগ কাজে লাগান পুরোপুরি। তাদের ধারণা ছিল ওলামারা এক হতে পারবেন না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনে তৎকালীন পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম ভুল করেননি। বিভিন্ন মাসলাক ও মতাদর্শের ৩১ জন ওলামা সময়ের চাহিদা পুরোপুরি বিবেচনায় এনে ঐক্য ও সংহতি গড়ার পদক্ষেপ হাতে নেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে করাচিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ওলামাদের সম্মেলনে ২২ দফা শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি রচিত হয়।

সিদ্ধান্ত হয়, সৃষ্টিকর্তা ও আইনদাতা একমাত্র আল্লাহ। রাষ্ট্রের সব আইন-কানুন কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত হবে। এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না অথবা অর্ডার বা অর্ডিন্যান্স জারি করা যাবে না, যা কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী হয়। যদি দেশে আগে থেকে এমন কোনো আইন জারি থাকে যা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী, তবে পরিষ্কার ভাষায় এ কথা স্বীকার ও ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই সব শরিয়তবিরোধী আইন ক্রমে সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যে রহিত করা হবে অথবা শরিয়তসম্মতরূপে পরিবর্তিত ও সংশোধিত আইন রচনা, প্রবর্তন ও জারি করা হবে। রাষ্ট্র ভৌগোলিক সীমা, বর্ণ, বংশ বা অন্য কোনো বস্তুবাদ বা জড়বাদের ভিত্তির ওপর গঠিত বা পরিচালিত হবে না; বরং রাষ্ট্র হবে আদর্শবাদী ও আদর্শের ভিত্তি হবে ইসলাম এবং ইসলামের জীবনপদ্ধতি।

১৮ জানুয়ারি সংসদে এটি গৃহীত হয়। ২২ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের ইসলামী সংবিধান রচিত হয়। অবশ্য নানা টালবাহানা করে ক্ষমতাসীনরা ইসলামী সংবিধান চালু করতে এগিয়ে আসেননি। স্বার্থান্বেষী মহল সামরিক শাসন জারি করে। সাংবিধানিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দেয়। আশির দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনের নিগড়ে পাকিস্তানের জনগণ যখন বন্দী তখন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মুফতি মাহমুদ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সাথে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (পিএনএ) নামক ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম। মাওলানা মুফতি মাহমুদ পিএনএর চেয়ারম্যান হিসেবে গণআন্দোলন সৃষ্টি করে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পিএনএ পরবর্তীতে ‘তাহরিকে নিফাজে নিজামে মুস্তাফা’ নামে ইসলামী আন্দোলন জোরদার করেন।

বাংলাদেশের বিবেচনায় ইসলামী শক্তির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অতীতের যেকোনো পরিস্থিতি ও সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, দেশীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এবং ভৌগোলিক অবস্থানে ইসলামী শক্তির একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম একান্ত প্রয়োজন। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশে ইসলামী শক্তির এক মজবুত ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ আলেম, ইসলামী স্কলার, ওয়ায়েজ, হক্কানি পীর-মাশায়েখ আছেন; যাদের সাথে তৃণমূলের সংযোগ রয়েছে। এসব দ্বীনি ব্যক্তিত্বের মেহনতের ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী দ্বীনমুখী হয়েছে। ইসলামের বুনিয়াদি ইলম, সংগ্রামী ও আখিরাতের চেতনায় জনগণ উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। দ্বীনের মুহাব্বত ও ইসলামী আদর্শের চেতনাবোধ জনগণের মধ্যে এত প্রবল যে, কোনো ধর্মদ্রোহী ইসলাম, কুরআন বা মহানবী সা: সম্পর্কে বিষোদগার করতে ভয় পায়। কদাচিৎ অশালীন মন্তব্য করলেও বিশ্বাসী জনগণ প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

কিন্তু বাংলাদেশের ইসলামী শক্তিগুলো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। এ সুযোগে চিহ্নিত ইসলামবিরোধীরা নানামুখী চক্রান্ত, ভ্রান্ত মতবাদ ও অপসংস্কৃতিতে সমাজকে বিষিয়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। ইসলামী ব্যক্তিত্বদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। সেবার নামে চালু করা হয়েছে মহাজনি প্রথা, নারীর ক্ষমতায়নের নামে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বেলেল্লাপনা। বিভিন্ন মাসলাকের অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন খাতে যেভাবে ইখলাসের সাথে দ্বীনের যতটুকু খিদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন, সবার খিদমতের কদর করা প্রয়োজন। নিজেদের প্রচেষ্টাকে ইসলামের একমাত্র খিদমত মনে করলে এবং অন্যদের খিদমতকে মামুলি ও নগণ্য মনে করলে ঐক্যপ্রক্রিয়া হুমকির সম্মুখীন হবে। সবার খিদমত একে অপরের পরিপূরক ও সম্পূরক। সবাই একই লক্ষ্যের অভিসারী, একই মনজিলের অভিযাত্রী। মাদরাসা, মসজিদ, খানকাহ, ওয়াজ, দারুল ইফতা, হালকায়ে জিকির, তাবলিগ, দ্বীনি সাহিত্য ও সংবাদপত্র ইসলামী রাজনীতির খিদমতের সাথে জড়িত, সে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে জমায়েত করে যদি সংগঠিত করা যায় তাহলে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত। গলিত সিসার প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ প্রচণ্ড ইসলামী শক্তির মোকাবেলা করা ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদি অপশক্তির এদেশীয় দোসরদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বাড়াবাড়ি ও অহংবোধের শিকার হয়ে আমরা যেন মহান আল্লাহর রাসূল সা:-এর ঐক্যের সে ঐতিহাসিক বাণীগুলো ভুলে না বসি।

‘মুমিনগণ এক দেহের মতোই তার চোখ যখন আক্রান্ত হয় তখন পুরো শরীর ব্যথা অনুভব করে, মাথায় যখন ব্যথা অনুভূত হয়, তখন পুরো শরীর যন্ত্রণায় কাতর হয়। এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য প্রাসাদস্বরূপ, প্রতিটি ইট একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে।’

স্মর্তব্য, যে মুসলিম সমাজ ও উম্মাহর ধ্বংস ও বিপর্যয় বিভেদ ও অনৈক্যের মধ্যে নিহিত। হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন, ফার্র্র্ডিন্যান্ডের হাতে স্পেনের পতন, লর্ড ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন ছিল মুসলমানদের কলহ, বিভেদ ও অনৈক্যের অনিবার্য ফল। মুসলমানরা যখন ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তখন তাদের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারেনি। রোমান ও পারস্য সভ্যতা মুসলমানদের পদচুম্বন করেছে। ক্রুসেড বিজয়ী বীরযোদ্ধা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবির হাত থেকে জেরুসালেম নগরী উদ্ধার করতে জার্মানির সম্রাট ফ্রেডারিকা বারবারোসা, ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড, ফ্রান্সের রাজা ফিলিপস অগাস্টাস, কারাকের শাসনকর্তা রেজিন্যান্ড সম্মিলিত যুদ্ধ চালিয়েও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির হাতে পরাজিত হয়েছেন। মুসলমানরা বুকের তাজা খুন দিয়ে খ্রিষ্টান সেনাপতি রিচার্ডের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করে দিয়েছে। ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের ফলে ভারতের বুক থেকে ইংরেজ শক্তি বিতাড়িত হয়েছে। সুতরাং ইতিহাস প্রমাণ করে, ঐক্য ও সংহতি ইসলামের বিজয় নিশ্চিত করে আর দলাদলি, অনৈক্য ও কলহ মুসলিম উম্মাহর পতন ত্বরান্বিত করে।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
drkhalid09@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement