১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


দেশ জাতি রাষ্ট্র

আওয়ামী সরকার সমর্থনে চীন কি পিছিয়ে গেল

আওয়ামী সরকার সমর্থনে চীন কি পিছিয়ে গেল - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই পাল্টাচ্ছে দেশজ ও বৈশ্বিক সমীকরণ। দেশে ক্রমেই তীব্র হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। সেটি খুব শিগগিরই অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। সব দেশে সর্বকালে বৈশ্বিক রাজনীতি প্রভাবিত হয় দেশজ রাজনীতি দ্বারা। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই। পররাষ্ট্রনীতির মূল নির্ধারক হলো জাতীয় স্বার্থ। এক সময়ের ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী (পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী) লর্ড পামারস্টোন বলেছিলেন, ‘Great Britain doesnÕt have permanent friend or foe but has got permanent interest.’ কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জাতীয় স্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থই পররাষ্ট্রনীতির নির্ধারক। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে ক্ষমতার স্বার্থে ও দলের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে তার যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এখন আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবেশীর তোয়াজ-তোষামোদে ব্যস্ত। ভারত সফরে আওয়ামী লীগের নেতারা চীনা বিতর্কে বিধ্বস্ত হয়েছেন। তারা ভারতকে বুঝিয়েছেন, ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ক আন্তরিক। আর চীনের সাথে সম্পর্ক বাণিজ্যিক। এতে চীনা কর্তৃপক্ষের খুশি হওয়ার কথা নয়। পরবর্তী চীনা রাষ্ট্রদূতের প্রদত্ত বিবৃতিতে এর প্রতিফলন দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিসা বিধি-নিষেধ ঘোষণা করে তখন আওয়ামী সরকারে তোলপাড় শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের বিপরীতে রুশ-চীন সমীকরণ প্রদর্শন করে আওয়ামী লীগ ‘ব্যালেন্স অব পাওয়ার’ দেখানোর চেষ্টা করে। কয়েক দিনের মধ্যেই রুশ ও চীনা দূতাবাস সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপক বিবৃতি দেয়। চীনা বিবৃতিটি ছিল ব্যক্তিক, শক্ত এবং স্পষ্ট। উল্লেখ্য, এর আগে একপর্যায়ে রুশ দূতাবাস থেকে একটি প্রতিবাদী বিবৃতি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘কিছু দেশ, যারা নিজেদের ‘উন্নত গণতন্ত্র’ বলে দাবি করে, তারা অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করে না, এমনকি ব্ল্যাকমেলও করে। যেসব দেশে নিজেদের বিশ্বের শাসক মনে করে তারা যদি কোনো দেশকে পছন্দ না করে তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ছলে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে।

বাংলাদেশ নিয়ে দু’টি দূতাবাসের মধ্যে এ রকম কূটনৈতিক বচসার ঘটনা অতীতে দেখা যায়নি। আরেকটি বচসার ঘটনা ঘটে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, রুশ-চীন বিবৃতি দুটো সরকারের অনুরোধ-উপরোধেই দেয়া। লক্ষ্যণীয়, সময়ান্তরে চীনা রাষ্ট্রদূতের ভাষা মোলায়েম হয়ে আসে। এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে এ দেশের রাজনীতিবিদদের মতপার্থক্য নেই- আজ মঞ্চে উপস্থিত তিনটি দলের প্রতিনিধিরা এর প্রমাণ। তারা সবাই এ সম্পর্কের সমর্থক। চীন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সাথে সম্পর্কে বিশ্বাসী। চীন সবসময় বাংলাদেশের বিশ্বস্ত কৌশলগত অংশীদার। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান চীন সমর্থন করে। ইয়াও ওয়েন এ সময় আরো বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে বাংলাদেশের লোকজনের আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করেছে। ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, সরকারকে ছাড়িয়ে জনগণের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে দুই দেশের স্বার্থ অভিন্ন। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের আরো ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রূপকল্প ২০৪১ ও স্মার্ট বাংলাদেশের অভীষ্ঠ অর্জনে আমরা সহযোগিতা করতে পারি। চীনা রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে চীন হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ২৭ আগস্ট রাষ্ট্রদূত চীনের অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে গিয়ে ‘হস্তক্ষেপ না করার’ নীতি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশীদের দ্বারা নির্ধারিত হওয়া উচিত। আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের নীতি অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা হলো- চীন কখনোই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষায় চীন বাংলাদেশকে সমর্থন করে। চীন দু’দেশের সম্পর্কের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখে।’

মার্কিন ভিসানীতির পর চীনা রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে স্পষ্টত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ওই বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করা হয়। কিন্তু পরবর্তী দুই-তিনটি বিবৃতি বিশেষত বিগত ২৭ আগস্ট প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ভিন্ন অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। সেখানে সমর্থন থেকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং অবশেষে নির্বাচনে চীনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হয়। রাষ্ট্রদূতের ভাষার এই পর্যায়ক্রমিক সরে আসা ক্রমহ্রাসমান সম্পর্কের ইঙ্গিত করে কি না তা অবশ্য একটি বিবেচনার বিষয়। কূটনীতির ভাষায় নেতিবাচককে ইতিবাচক এবং ইতিবাচককে নেতিবাচক ভাষায় প্রকাশ করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার অনেক সময় ঘোষিত রাষ্ট্রিক সম্মান ও সমর্থনকে তাদের দলের সমর্থনে ব্যবহার করে। অনেক সময় এটি প্রতারণামূলক হয়ে ওঠে।

চীন ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে যে টানাপড়েন চলছে তা আরো বোঝা যায় ব্রিকস সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। চীনের দৃঢ় সমর্থন থাকলে বাংলাদেশ অবশ্যই ব্রিকসের সদস্যপদ লাভ করত। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যে, ভারত কিংবা চীন-কেউই বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেনি। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কূটনীতির ভরাডুবি ঘটেছে। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেনের ভাষায় ‘পরীক্ষিত বন্ধুরা হতাশ করেছে বাংলাদেশকে’। প্রধানমন্ত্রী অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করেছেন। সেটুকু প্রচার করে নিজের পরাজয় ঢাকতে চেয়েছেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলেছেন তার অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে নতুন সদস্য দেশকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ের পাশাপাশি ভারসাম্যের ইস্যু থাকতে পারে।’

বাংলাদেশ সরকার ব্রিকস সম্মেলনে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। ‘ত্রিশঙ্কু’ কূটনৈতিক সমীকরণের কারণে এটি ঘটেছে। প্রথমত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয়ত চীন ও তৃতীয়ত ভারত এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার ধারক-বাহক। কুশলতার মাধ্যমে সফলতা অর্জনের জন্য যে কূটনৈতিক নিষ্ঠা ও অভিজ্ঞতা থাকা উচিত, তা এই সরকারের নেই। কে না বোঝে পরস্পর বৈরী চীন ও ভারতের মধ্যে সমন্বয় বিধান অসম্ভব। অবশেষে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ভারতে সমর্পিত হয়েছে তখন চীন যদি রাজনৈতিক সমর্থন থেকে সরে গিয়ে থাকে তা কি খুব অবাস্তব? অবশ্য একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এই ভাষ্যকারকে বলেন, বাংলাদেশে চীনের অবস্থান এক ও অনন্য। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন রীতিমতো চীন নির্ভর। বাংলাদেশের যেকোনো সরকারেরই চীনকে বাদ দিয়ে এগুনো কঠিন। এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক ও সামরিক। সুতরাং কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন না দিয়ে জনগণের সাথে থাকার যে কথা চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন তা-ই সঙ্গত। অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপি সরকারের সময়ও চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই উচ্চপর্যায়ে ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেই সম্পর্কের সূচনা করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পশ্চিমের বিপরীতে জিয়াউর রহমান পূর্বমুখী বা ‘লুক ইস্ট’ পলিসি অনুসরণ করেন। চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো দৃঢ়করণে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়ন কৌশল ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) সহ বিভিন্নভাবে চীন বাংলাদেশে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। দেশটি বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ নতুন জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। একটি বিশ্লেষণে বলা হয়, চীন আমাদের অর্থনৈতিক সুবিধাভোগী। সুবিধাভোগী এ জন্য যে, এখানে প্রায় সব প্রজেক্টে বেশির ভাগ কাজই করছে চীনা কন্ট্রাক্টররা। চীনের স্বার্থ রয়েছে এখানে। আর চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ এবং ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা ইত্যাদি নিয়ে পারস্পরিক বৈরী একটি অবস্থানে আছে। সেক্ষেত্রে চীন রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে। ধরে নেয়া যাক, বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। সেখানে বিএনপি যেমন অতীতের সূত্র ধরে চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারবে তেমনি চীনও তার বাণিজ্যিক স্বার্থে বিএনপি বা যেকোনো ভবিষ্যৎ সরকারকে সহায়তা দেবে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখছি পশ্চিমারা ব্যবহার করছে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো শব্দ।

অন্যদিকে চীন ব্যবহার করল আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণের মতো শব্দ। প্রশ্ন থাকতে পারে, এসব শব্দের আড়ালে তাদের স্বার্থ রয়েছে, নাকি এসব শব্দ যা মিন করে সেটাই তারা চায়। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই চাইবে যে, তাদের সাথে চীনের যে সঙ্ঘাত অথবা চীন-ভারতের যে দ্বন্দ্ব সেখানে চীনের পক্ষে যেন বাংলাদেশ না যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ মধ্যপন্থা অবলম্বন না করে প্রতিবেশী ভারতের পক্ষপুটে আশ্রয় নিয়েছে। জাতীয় স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন বিপরীতমুখী অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান হতে হবে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থে।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বকাপের জন্য পাকিস্তানের ১৫ খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশিত আওয়ামী সরকার দেশে নব্য বাকশালী শাসন কায়েম করেছে : মির্জা ফখরুল শনিবার ১৫ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে : মান্ডা-জিরানী খালপাড়বাসী র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে : যুক্তরাষ্ট্র কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার বাংলাদেশকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে : হামিদুর রহমান আযাদ ইউক্রেনের শতাধিক ড্রোন প্রতিরোধের দাবি রাশিয়ার বাস্তবতা বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর জীবননগরে পাখিভ্যানের ধাক্কায় বাইসাইকেলচালক নিহত আড়াইহাজারে তরুণীকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ

সকল