২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
অন্য দৃষ্টি

প্রপাগান্ডায় সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা

প্রপাগান্ডায় সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা - নয়া দিগন্ত

চরম রাজনৈতিক অচলাবস্থায় আমাদের সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের ‘ভুতুড়ে’ খবর আমদানি হচ্ছে। এসব খবরের প্রধান লক্ষ্য সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলকে সমর্থন ও শক্তি জোগানো। আস্থার সঙ্কটে থাকা সরকার ও তার সহযোগীরা প্রতিদিন নতুন নতুন চাপে পড়ছে। এ অবস্থায় সরকার সমর্থক প্রশাসন ও দলের নেতাকর্মীরা দিশেহারা। তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে প্রয়োজন পড়েছে কিছু খবর। ভুতুড়ে খবর খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে তারা নিজেদের ভয় তাড়ানোর চেষ্টায় রত।

এসব খবরের উৎস প্রতিবেশী দেশ ভারতের মিডিয়া। ক্ষয়িষ্ণু আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান টাইমস কিংবা অখ্যাত সব পত্রিকার খবর ছেপে সেগুলো চালান করে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের মিডিয়ায়। এগুলো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ছাপছে আমাদের পত্রিকা। গত সোমবার বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্য হিন্দুর’ এক খবরে বলা হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় হলে কেবল ভারতের জন্য উদ্বেগের নয়, এতে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহিংসতা ও অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রতিবেদনের সারমর্ম, চলমান সরকারের সাথে ভারতের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এর মাত্রা এতটা মধুর যে, মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ড নিয়ে একটু ভিন্নমত কিংবা অস্বস্তি প্রকাশ করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পত্রিকা এই যুক্তি দিয়েছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে নিখোঁজ হওয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। তারা গুম খুনসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকারকে এমনভাবে চাপ প্রয়োগে বাধ্য করতে চায়; যাতে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় এসব কথাও । এর পরেও প্রতিবেদনে এ অবস্থানই সমর্থন করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রকে এ চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তাদের মত হলো, বাংলাদেশী জনগণের ভালো হলেও আমেরিকার তা করা উচিত নয়!

এর আগে আনন্দবাজারও প্রায় একই ভাষায় প্রতিবেদন ছাপে। পত্রিকাটির ভাষা আরো কদর্য এবং এ দেশের মানুষের ব্যাপারে কোনো ধরনের মর্যাদা বোধ করে না। রিপোর্টে সরাসরি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিষোদগার করা হয়েছে। ইসলামের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং ‘পাকিস্তানপ্রীতির’ জন্য তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছে। অথচ এ ধরনের অভিযোগ আনার অগে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত কিংবা রেফারেন্স তারা দেয়নি। যেমন তারা ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের বার্তা’ দেয়ার যে গল্প ফেঁদেছে, তাতেও কোনো তথ্য সূত্রের উল্লেখ নেই। এ প্রতিবেদন নিয়ে বিবিসি একটি রিপোর্ট করেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরটি যে ভিত্তিহীন তা সেই দেশের বিদেশ মন্ত্রকের ভাষ্যে সংবাদমাধ্যমটি প্রমাণ করে দিয়েছে। তাদের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি এসব প্রতিবেদনকে ‘অতি তাত্ত্বিক’ বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে বোঝা গেছে যে ভারত সরকার বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এ ধরনের কোনো বার্তা দেয়নি। ভারতের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়া বেপরোয়া প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এগুলোই আমাদের মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে ছাপছে। এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। এতে করে অলীক কল্পনাপ্রসূত খবর ও বিশ্লেষণ করতে ভারতীয় মিডিয়ার উৎসাহ আরো বাড়ছে ।

সরাসরি গুম চলতে থাকুক, মানুষের ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গোল্লায় যাক, তা সমর্থন করতে পারছে না ভারত সরকার । মূলত যুক্তরাষ্ট্রের শক্ত অবস্থানে ভারত তা করতে পারছে না। তাদের মিডিয়া এসব গালগল্প রচনা করে কিছু অর্থকড়ি কামিয়ে নিচ্ছে কিনা সেই আলোচনা উঠেছে। তবে ভারতীয় মিডিয়ার এসব আবর্জনা ছেপে আমাদের সংবাদমাধ্যম আসলে কার উদ্দেশ্য সাধন করছে? এটা বাংলাদেশী পাঠকদের মিসগাইড করছে, পত্রিকাগুলো এরপরও কেন এমনটা করছে সেটি বুঝা কঠিন।

একই ধরনের প্রপাগান্ডার সর্বশেষ সফট ভার্সন নিয়ে এসেছে ভারতীয় পত্রিকা টেলিগ্রাফ। তারা দ্য হিন্দু ও আনন্দবাজারের অবস্থান থেকে একটু পিছু হটে বলছেন, ভারত এই সরকারকে দু’টি স্পষ্ট বার্তা দেবে। প্রথমটি হচ্ছে, একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক জনপ্রিয় নেতাদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে। এর সাথে আরো কয়েকটি বিষয় তারা জুড়ে দিয়েছে, দুর্নীতিবাজ ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, পণ্যমূলের দাম কমাতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। আওয়ামী লীগের ভাষ্যের সাথে এটি আংশিক মিলে যায়। তবে ভারত সরকারের এই ধরনের অবস্থান গ্রহণ যে আওয়ামী লীগের জন্য চরম অবমাননাকর সেটি পত্রিকাটির বুদ্ধিজীবীরা বোঝার ক্ষমতা রাখেন না।

আওয়ামী লীগকে এবার ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মীয় লোকদের সঙ্গ ছাড়তে হবে। অথচ এই সরকারের সময় ধর্মীয় লোকেরা সবচেয়ে বেশি পীড়নের শিকার হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে দুই ডজন ধর্মীয় প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয়েছে। নানা ছুতায় আলেমদের বিরাট একটি অংশকে জেলে পুরে রেখেছে। ইসলামী দলগুলোকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ দেখা গেল মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দলটির যারা শোক প্রকাশ করেছে কিংবা সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে, কারো কারো বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থাও নিয়েছে। অথচ মানুষ মারা গেলে শোক প্রকাশের রেওয়াজ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কখনো কেউ শত্রু-মিত্র বিবেচনা করে না। এরপর আর কিভাবে আওয়ামী লীগ ‘মুসলমানদের সঙ্গ ছাড়া’র প্রমাণ দেবে? এক পর্যায় কি তাদের ওপর এই চাপ আসবে যে, তোমরা মুসলমান কেন? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সুযোগ বুঝে তারা দলটিকে চাপে ফেলে আরো বেকায়দা অবস্থা করতে চাচ্ছে। ভারত আওয়ামী লীগের কেমন বন্ধু, দলটির বিপদের মৌসুমে প্রমাণ করে দিলো। পত্রিকাটির এই ভাষ্য, ‘ভারত সরকারের মতামত নয়’ এ ব্যাপারে বিজেপি সরকারকে মুখ খুলে বলা উচিত। টেলিগ্রাফকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ দেয়া উচিত।

তবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। দলটি তাদের একমাত্র পছন্দ, এখানে কোনো বিকল্পের চিন্তা তারা করে না। টেলিগ্রাফের প্রচারণায় তারই সুর বাজছে। প্রতিবেদনে তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যে প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে তাতে, দেশে আবার বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় চলে আসবে। এতে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই, সংবিধান অনুযাযী নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটের আয়োজন করতে হবে। টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনের সবচেয়ে বড় গল্পটি হচ্ছে- উপরোক্ত ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের নাকি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাকি শুধু শেখ হাসিনাকে জানানো। আসন্ন ভারত সফরে তাকে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হবে।

জাতীয় পার্টির মালিকানায় থাকা একটি পত্রিকায় গুরুত্ব দিয়ে টেলিগ্রাফের ওই রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে হাসিনা সরকারকে টার্গেট করে যুক্তরাষ্ট্র এতদিন যেসব জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে সব ভেস্তে যাবে। আবারো ক্ষমতায় আসবে বর্তমান সরকার। সেই ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় লোকদের বাদ দিয়ে চীনের সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার ভারতীয় প্রেসক্রিপশন মেনে চললেই আওয়ামী লীগের মুশকিলে আহসান হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে। এর ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে এ দেশের সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে প্রশস্তি গাইবেন তার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। মনে হবে এটি একমাত্র দেশ যার গঠনে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান প্রজন্ম এই সংবাদমাধ্যমকে দেখছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। তারা দেখছে কিভাবে একটি দেশের মিডিয়ার মূলধারা নিজে থেকে একটি স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করেছে। পরে নিজেরাই তাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে হাঁসফাঁস করছে। তবু ভারতীয় মিডিয়ার প্রচারণায় হাওয়া দিয়ে নিজেদের গলার ফাঁস আরো শক্ত করছে নিজেদের অজান্তেই।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement