২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভোটের মালিকানা ফেরানোর লড়াই

জনগণ যাতে ভোট দিয়ে তাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠন করতে পারে সেটাই এক দফার মূল লক্ষ্য। - ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল সম্প্রতি এক সেমিনারে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভুয়া নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। তার এ দাবি যথার্থ এবং যৌক্তিক। কারণ এ দু’টি নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে।

বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংগ্রাম করছে। অন্যদিকে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো সাজানো ছকে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অপচেষ্টায়রত।

বিএনপি ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে বৃহত্তম মহাসমাবেশ করেছে এক দফার সমর্থনে। এই এক দফা হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ। অন্য অর্থে এই এক দফা হচ্ছে জনগণের ভোটের মালিকানা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়া। জনগণ যাতে ভোট দিয়ে তাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার গঠন করতে পারে সেটাই এক দফার মূল লক্ষ্য।

এক দফার সমর্থনে বিএনপির ডাকে ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতে অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়েছে। পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে, নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়। ডিবি প্রধান হারুন বিএনপির আহত নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে তার কার্যালয়ে তুলে নিয়ে আপ্যায়ন করে সামাজিক মাধ্যমে ছবি ছেড়ে দিয়ে ঘটনা অন্যখাতে নেয়ার একটি অপচেষ্টা চালিয়েছেন। একই অপচেষ্টা চালিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এক এপিএস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত নেতা আমানুল্লাহ আমানের শয্যাপাশে ফলের ঝুড়ি রেখে দিয়ে ছবি তুলে গণমাধ্যমে সেই ছবি পাঠিয়ে। বিএনপি ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশে সমাবেশের কর্মসূচি পালন করেছে।

বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলন যৌক্তিক। কারণ এ আন্দোলন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে কোনোভাবে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব হবে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কেবল সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠান সম্ভব।

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে কেন সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়? কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন এর প্রমাণ। ওই দু’টি নির্বাচন এতটাই কলঙ্কজনক ও জঘন্য হয়েছে যে, আজ দু’টি নির্বাচন বাতিলের দাবি উঠেছে। আমরা যদি শুধু ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যালোচনা করি তাহলে কি দেখতে পাই? এ নির্বাচন যার নেতৃত্বে হয়েছিল সেই সিইসি নুরুল হুদার উক্তি ছিল- ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক ছিল না। শতভাগ ভোট পড়ায় আমরা অস্বস্তিতে ছিলাম’।

ওই নির্বাচন সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের উক্তি ছিল- ‘নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়েছে এটি সত্য। আর ২১৩টি কেন্দ্রে যে শতভাগ ভোট পড়েছে তা কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ নির্বাচনের আগের রাতে বাক্স ভর্তি ব্যালাটের ছবি বিবিসি প্রচার করেছে।’

দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ওই নির্বাচনের ৫০টি আসনে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপর অনুসন্ধান ও জরিপ করে বলেছে, ‘এই ৫০টি আসনের ৪৭টিতেই ভয়াবহ অনিয়ম-জালিয়াতি হয়েছে’। সংস্থাটি এই নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ও ‘অবিশ্বাস্য’ বলে উল্লেখ করেছে।

সরকারের সহযোগী জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটি (ভোট দেয়া) করা হয়। হয় মানে কি, আমরাই করাইছি। কি বলব এটি হয়। এটি হয় না, ঠিক না’। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘দিনের ভোট রাতে করে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ’। অন্য কমিশনার বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট দিনেই হবে। রাতে কোনো ভোট হবে না’। অর্থাৎ তারা স্বীকার করলেন- ২০১৮ সালের নির্বাচনে রাতে ভোট হয়েছিল। সিইসি নুরুল হুদা ইভিএম মেশিনে ভোটের ব্যবস্থা সম্পর্কে সাফাই গাইতে গিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছিলেন, ‘ইভিএম মেশিনে যদি ভোটের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে আগের রাতে ব্যালট পেপারের সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না’। সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাদের দলীয় এমপির উদ্দেশ্যে বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে এমপি হয়েছো, আমরাই তো তৈরি করেছি’।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রার্থীরা ধানের শীষ মার্কায় অসংখ্য কেন্দ্রে ‘শূন্য’ ভোট পেয়েছিলেন। এটা কি অবিশ্বাস্য নজির নয়? জনগণের ভোট এভাবে চুরি করা হলো। তাই আজ দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে থেকেও জনগণের ভোটের মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি উঠেছে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফল প্রকাশ করে সেটি দেখলে জালিয়াতির নানা ঘটনায় ধরা পড়বে।

যে কেউ www.ecs.gov.bd ওয়েব সাইটে ঢুকে দেখে নিতে পারেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সারা দেশের কেন্দ্রভিত্তিক ফল। এর বাম পাশে পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচনীয় ফল। সবাই এতে ঢুকে নিজ নিজ কেন্দ্রের ফল দেখতে পারেন। তাহলে ৩০ ডিসেম্বর ওই কেন্দ্রে কেমন ভোট দেখেছেন আর এখন কেমন রেজাল্ট দেখছেন এ দুটো চিত্র মেলাতে পারবেন।

এ নির্বাচনে বেশির ভাগ আসনে জয়ী প্রার্থীদের সাথে পরাজিতদের ভোটের ব্যবধান লাখের ওপরে। সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ঢাকা-১৯ আসনে (সাভার) আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা: মো: এনামুর রহমান। তার সাথে বিএনপির প্রার্থীর ব্যবধান চার লাখ ২০ হাজার ৬৪৮ ভোটের। বিএনপির বড় নেতারাও এই নির্বাচনে হেরেছেন বড় ব্যবধানে।

এই যে ধানের শীষের প্রার্থীর শূন্য ভোট আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এতো এতো ভোট সেখানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে দুই শতাধিক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪১ হাজারের বেশি কেন্দ্রে ভোট হয়। এতে ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। সাত হাজার ৬৮৯ কেন্দ্রে ৯০ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। সংসদ নির্বাচনে গড় ভোট দেখানো হয় ৭৯.৩৬ শতাংশ।

ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর কমিটি মিলে একটি আসনে বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শুধু কমিটিতে থাকা নেতার সংখ্যা অন্তত দশ হাজার। তাদের পরিবারের সদস্য না হয় বাদই দিলাম। সেখানে এই যে ধানের শীষের শূন্য ভোট ও একটি আসনে সর্বসাকুল্যে ৫৭ বা ১২৭ ভোট পাওয়া সেটা কি কোনো হিসেবে মিলে? ধরে নিলাম ওই এলাকায় বিএনপির নেতারাও ভোট দিতে যাননি। তাহলে সেসব কেন্দ্রে আবার শতভাগ বা ৯৮-৯৯ শতাংশ ভোট পড়ল কি করে? আর ভোটার লিস্ট হওয়ার পর কেউ বিদেশে, কেউ অসুস্থ, কেউ নির্বাচনী কাজে অন্য এলাকায় থাকাসহ নানাবিধ কারণে শতভাগ ভোট পড়া একেবারে অসম্ভব। অসংখ্য কেন্দ্রে বিএনপির শূন্য ভোট ও ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া ভুয়া ও নিকৃষ্ট নির্বাচনের প্রমাণ।

শতভাগ ভোট পড়া নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাও অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু প্রিজাইডিং ও রিটার্নিং কর্মকর্তা যেহেতু এ বিষয়ে আগে কিছু জানাননি, তাই এখন ইসির কিছু করার নেই। মামলা হলে আদালত যদি নির্বাচন বাতিল করে ফের নির্বাচন দেন, সেটি আদালতের এখতিয়ার।

ভোট গ্রহণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা আগে জানাননি বুঝলাম কিন্তু ছয় মাস পর তো জানলেন। তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না? আসলে এই সিইসিবাহিনী সবই করেছেন জেনে বুঝে পরিকল্পনামাফিক। তিনি এও জানেন, নির্বাচনে এই ভয়াবহ জালিয়াতি নিয়ে কেউ আদালতে গেলেও তা নিষ্পত্তি হতে হতে সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ততদিনে তিনিও হয়তো আর সিইসি থাকবেন না। তাই সাংবাদিকদের কাছে ছিল তার এ কৌশলী উত্তর।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement