২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র পুনরাবর্তনে সাংবাদিকের দায়

গণতন্ত্র পুনরাবর্তনে সাংবাদিকের দায়। -

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে বিস্তৃত সমালোচনা রয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে এই সমালোচনা আরো তীব্র হয়েছে। গুম থেকে ফিরে আসা ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে বলেছেন, ‘এক ধরনের সাংবাদিকরা সুখে আছেন।’ বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তার কথাটি সত্য। এ দেশে সাংবাদিকরা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। একদল অর্থবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। ক্ষমতার সাথী হয়ে তারা নিজেদের জন্য ননি মাখন জুটিয়েছেন। এই সরকারের আমলে অতি ধনী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে একনম্বর অবস্থানে রয়েছে। সরকারি দলের বহু লোকের সম্পদ বহু গুণে বেড়েছে। সাংবাদিকদের যে অংশটি ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়েছে তারাও এই তালিকায় রয়েছেন।

আরেক দল সাংবাদিক নিদারুণ দুঃখে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এর মধ্যে কাজল নিজেও রয়েছেন। দুই ধরনের সাংবাদিকতার বাইরে তৃতীয় একটি শ্রেণীও আছে। তারা অতটা দুঃখ কষ্টে না থাকলেও মন খুলে বলতে লিখতে পারেন না। স্বআরোপিত বাধার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। এটি এমন এক কর্ম বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। এর মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, মজা নেই। এভাবে দায়িত্ব পালন হয় না। এ যেন খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা। এর মধ্যে মৌলিক মানবিকতার স্বাদ নেই। একে কোনোভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা বলা যায় না।

কাজল ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁস করেছিলেন। ওইসব নিয়ে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ কোনো ধরনের তদন্তের প্রয়োজনও মনে করেনি। উল্টো কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা হয়ে গেল। তাকে একদিন প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে গেল। যেভাবে এই সরকারের আমলে শত শত লোককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরপর দুই মাস তিনি গুম। বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে সেই ভয়াল দিনগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। চোখ বেঁধে তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। পিছমোড়া করে বেঁধে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেই অবস্থায় নামাজে সেজদা করেছেন। বহুবার তার মনে হয়েছে গুলি করে হত্যা করা হবে। এমন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখা হয়। শেষে ভারত সীমান্তের কাছে তাকে ফেলে দেয়া হয়। এই সরকারের সময় গুম ব্যক্তিদের জন্য ভারত সীমান্ত যেন একটি ভাগাড়। কাউকে সীমানার এ পাড়ে, কাউকে ওই পাড়ে ফেলা হয়। যেমন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদকে ফেলা হয়েছিল ভারতের বেশ ভেতরে।

সেখান থেকে কাজলকে আবার আটক করে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এবার তিনি বাংলাদেশের কঠিন বিচারব্যবস্থার মুখোমুখি হন। তাকে কারা গুম করেছে, এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন, সীমান্তের কাছে কেন তাকে পাওয়া গেল- এসবের উত্তর জানার কোনো দরকার নেই। তিনি ক্ষমতাসীন রাঘাববোয়ালের তথ্য ফাঁস করেছেন সেটাই শুধু বিচারে বিবেচ্য। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার কোনো মূল্যই দেয়নি বর্তমান সরকার। তাদের কাছে একমাত্র লক্ষ্য ছিল নিজেদের ক্ষমতা। দুর্ভাগ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে এসব প্রশ্ন জড়িত। এভাবে জনসাধারণের জীবন ‘খেলাধুলার’ পাত্র হয়ে থাকাটা সবার জন্য বিপজ্জনক। এতে আজকের ক্ষমতাসীনরাও একদিন বলি হয়ে যেতে পারেন। এর সাথে রাষ্ট্রের মৌলিক নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। এ ধরনের রহস্যজনক গুমের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া দরকার। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও বিদেশীদের ব্যাপক চাপের মুখে এমন ভয়াবহ অপরাধমূলক কর্ম কমে গেছে। কিন্তু যারা এই অপরাধের সাথে জড়িত তাদের শণাক্ত করা না গেলে যেকোনো পরিস্থিতিতে এটা আবার শুরু হতে পারে। এমন অপরাধীদের কাছে কারো জীবন নিরাপদ নয়। সীমান্তের উভয় পাশে মিলে এমন অপরাধী সিন্ডিকেট স্থায়ীভাবে গড়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি।

বেশ কয়েকবার জামিন নাকচ হওয়ায় দীর্ঘ আট মাস পর কাজল মুক্ত হন। জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। আগের পেশায় এখনো তিনি ফিরতে পারেননি। সরকারেরর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন এমন ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপি হাজির করেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন, সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে চাকরি না পাওয়া, চাকরি হারানো, লেখার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি হারানো ও গুম হয়ে ফিরে আসা ব্যক্তিরা। সমাবেশে অংশগ্রহণ করে তারা তাদের অসহনীয় অবস্থা নিয়ে মতামত তুলে ধরেন।

তারুণ্যের সমাবেশে দাঁড়িয়ে কাজল সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘আমরা যারা মনে করি আপস করে সাংবাদিকতা করব, যারা মনে করছি- ফ্ল্যাট, গাড়ি-বাড়ির বিনিময়ে আমরা সুখে আছি, যারা ১৪ বছর সুখে আছেন, দিন গুনুন, আগামী দিন আপনাদের সুখের দিন নয়, আগামী দিন আপনাদের চরম দুঃসময়ের দিন, সমস্ত শক্তি ভেঙে পড়েছে। তাকিয়ে দেখুন, পেছনে তাকান।’ সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে এমন কঠিন সমালোচনার অধিকার কাজলের রয়েছে। তিনি একটি স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থার অধীনে যখন পিষ্ট হচ্ছিলেন তার সহযোগীরা কেউ তার পক্ষে দাঁড়াননি। গুম হওয়ার পর কেউ তার অবস্থান নির্ণয় করতে উদ্যোগী হয়নি। বিচারের আওতায় আসার পর এই প্রহসন নিয়ে শক্ত করে কোনো সাংবাদিক মুখ খোলেননি। সরকারের কাছে সম্পাদকরা দাবি উঠাতে পারতেন, কেন একজন সাংবাদিককে গুম হতে হবে। কেন তার জামিন বার বার নাকচ হবে। রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে তার উত্থাপিত দুর্নীতি অনিয়মের তদন্ত কেন হবে না। এগুলো লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ হতে পারত, টেলিভিশন টকশোতে আলোচনায় আসতে পারত। রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা ছাড়াও আরো বহু পথ পন্থা ছিল সাংবাদিকরা তার একজন সহযোদ্ধার জন্য করতে পারতেন। তা তারা করেননি। বিরোধী দলের লোকেরা যখন খুন গুমের শিকার হয়েছে তখনই সাংবাদিকরা এসব নিয়ে বলতে পারতেন। পরে সাধারণ নাগরিকরাও এসবের শিকার হয়েছেন। তখন সাংবাদিকদের আসলে আর কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না।

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাংবাদিকরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছেন। এমন স্বাধীনতার ভোগ করার পরও খালেদা সরকার সাংবাদিকদের চরম অপছন্দের ছিলেন। সুশীল সম্পাদকরা প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে নিয়মিত তাকে জ্ঞান দিতেন। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস নিয়ে সরকারকে ভর্ৎসনা করতেন। ক্ষমতার শীর্ষ থাকা ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নিয়মিত ঠাট্টা উপহাস করতেন। আর বর্তমান জামানায় একজন সহযোদ্ধা গুম হয়ে যাওয়ার পরও তা নিয়ে দুই কলম লিখার সাহস সুযোগ কোনোটাই হয় না এই সাংবাদিকদের।

গণতন্ত্রের বিভিন্ন মাপনীতে বাংলাদেশ এখন স্বৈরতন্ত্র বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র চালিত শাসন। অবস্থায় এই অবনতির পেছনে মোটা দাগে দেশের সাংবাদিকতার দায় রয়েছে। এ দেশের সাংবাদিকতা সুস্থ ধারায় বিকশিত হয়নি। ফলে সংবাদ মাধ্যমের সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েছে, প্রকৃত গণমাধ্যম বাড়েনি, একই ধারায় বেড়েছে সাংবাদিকের সংখ্যা কিন্তু নেই সাংবাদিকতা। এই সময়ে নাগরিক স্বার্থের প্রধান সব খবর সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া যায়। বড় ধরনের দুর্নীতি অনিয়ম কিংবা দেশের স্বার্থহানিকর খবর প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে আসে, মূল ধারার গণমাধ্যম কিংবা সাংবাদিকরা তা পরে ফলো করেন। বাধ্য না হলে তা তারা প্রকাশ করেন না। মূলত সামাজিক মাধ্যমের চাপে পড়ে তা তারা প্রকাশ করেন। প্রথমে আঁতাতের কারণে সাংবদিকরা সরকারের নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করেননি। এটিকেই সরকার স্বৈরাচারী হওয়ার জন্য কাজে লাগিয়েছে। পরে এতটাই শক্তি তারা অর্জন করেছে সংবাদ মাধ্যমকে টুঁটি চেপে চুপ করিয়ে দিতে পেরেছে।

কাজল বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে আহ্বান রাখেন, ‘আপনারা পাশে থাকলে আমরা মুক্ত হবো, আমরা গণতন্ত্র পাবো, জিতব এবং আমাদের জিততেই হবে।’ গুম হয়ে কারা নির্যাতিত এই মজলুম সাংবাদিকের আহ্বানে সাড়া দেয়া উচিত সবার। মনে রাখতে হবে চলমান স্বেচ্ছাচারিতা একসময় সব কিছু গ্রাস করে নেবে। এ থেকে রেহাই পাবে না কেউ। যারা সুযোগ সুবিধা নিয়ে ভালো থাকছেন তারাও পড়ে যেতে পারেন রোষানলে। এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন দরকার। এই যাত্রায় সাংবাদিকরা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
হামাস ও ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর মধ্যে ঐক্য আলোচনার আয়োজন করছে চীন গফরগাঁওয়ে রাজিব হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার ও বিচার দাবি লক্ষ্মীপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ আটক টিভিতে বিব্রতকর সাক্ষাৎকারের পর অবস্থান পাল্টালেন বিএনপি নেতা শ্বশুরের ঘর থেকে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির কাছে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানে অধ্যক্ষ-চেয়ারম্যান গ্রেফতার আবারো পিএমএল-এনের সভাপতি হচ্ছেন নওয়াজ শরিফ বিষখালী নদী থেকে ২২ ঘণ্টা পর নিখোঁজ জেলের লাশ উদ্ধার ৩ জেলায় বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ছত্তিশগড়ে ২৯ জন মাওবাদী নিহত হওয়ার পর এলাকায় যে ভয়ের পরিবেশ

সকল