০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নষ্ট রাজনীতির চাবিকাঠি!

লেখক : গোলাম মাওলা রনি - ফাইল ছবি

সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের কাহিনী দিয়ে আজকের নিবন্ধ শুরু করতে চাই। কেবল ভারতবর্ষ নয়- তামাম দুনিয়ার মধ্যযুগের ইতিহাসের সফলতম শাসকদের শিরোমনি গিয়াসউদ্দিন বলবনকে সুলতান না বলে সম্রাট বলাই উত্তম। বজ্রকঠিন শাসন- ন্যায়বিচার, সাম্রাজ্যের উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং দক্ষতা-অভিজ্ঞতা দিয়ে দিল্লির সালতানাতে তিনি এমন এক বিস্ময়কর বিজয়চিহ্ন অঙ্কন করে গেছেন যা ভারতবর্ষের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে কেউ দেখাতে পারেননি। কিন্তু তার সেই বিশাল সাম্রাজ্য রাজসিংহাসন, রাজকোষ ইত্যাদি সব কিছু কর্পূরের মতো কিভাবে উড়ে গিয়েছিল সেই কাহিনী বলার আগে দুটো প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার।

প্রথমত, কর্তৃত্ববাদী শাসনের কুফল হলো- এ ধরনের শাসনে উপযুক্ত উত্তরাধিকার পয়দা হয় না। ইতিহাসের সব সফল রাজা-বাদশাহ-সম্রাট যারা কি না অতিমাত্রায় কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী ছিলেন তাদের জীবনাবসানের পর তাদের সব কিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেব, তৈমুর লং, সুলতান মাহমুদ, নাদির শাহ প্রমুখ দুনিয়া কাঁপানো শাসকদের উত্তরাধিকারীদের হাতে কিভাবে সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন-পরবর্তী শাসক যিনি সম্পর্কে বলবনের পৌত্র অর্থাৎ নাতি ছিলেন সেই মুইজউদ্দিন কায়কোবাদের জীবনীতে।

দ্বিতীয়ত, মুইজউদ্দিন কায়কোবাদের শাসনামলে তিনি ছিলেন মূলত ক্রীড়নক বা পুতুল। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং চার বছর ইতিহাসের নির্মম শাসনে ভারতবাসীকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে নিজে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সপরিবারে এবং তার মৃত্যুর সাথে সাথে দিল্লির বিখ্যাত দাস পরিবারের শাসনের সমাপ্তি ঘটে যা শুরু হয়েছিল সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের মাধ্যমে। সুলতান কায়কোবাদ শুরু থেকেই ছিলেন পুতুলশাসক। কিন্তু তার পরবর্তী খিলজি বংশীয় সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন দুনিয়ার সফলতম শাসকদের অন্যতম। তার অতি বাড়াবাড়ি, যুদ্ধনীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং সীমাহীন নিষ্ঠুরতার জন্য তিনি বন্ধুহীন হয়ে পড়েন এবং শেষ বয়সে সেনাপতি মালিক কাফুরের ক্রীড়নকে পরিণত হন।

কথিত আছে, মালিক কাফুর বৃদ্ধ সুলতানকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাজদরবারে আনতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করিয়ে আবার অন্দরমহলে নিয়ে বন্দী করে রাখতেন। সেনাপতি কাফুর বৃদ্ধ সুলতানকে রাজ অন্তঃপুরে নিয়ে শিকলবন্দী করে রাখতেন এবং সময়-অসময়ে মারধর করতেন। আলোচনার এই পর্যায়ে সম্মানিত দর্শক হয়তো বুঝে গেছেন যে, আমি আসলে কী বলতে চাইছি! যারা এখনো বোঝেননি তাদের উদ্দেশে বলছি যে- কর্তৃত্ববাদী শাসনের একপর্যায়ে শাসকরা অথর্ব-ক্রীড়নক বা পুতুলে পরিণত হয়ে যান এবং তখন থেকেই শুরু হয় দুঃশাসন। কোনো দেশ-কাল-জাতি যখন দুঃশাসনের কবলে পড়ে তখন সেখানে কী ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে তার আগে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়ে নেই।

সুলতান বলবনের জন্ম হয় মধ্য এশিয়ার বিখ্যাত ইলখানি রাজবংশে। হালাকু খানের বংশধররা ইসলাম গ্রহণ করে ইরান-ইরাক-তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ায় বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই বংশের লোকেরাই ইলখানি বংশরূপে ইতিহাসে সুপরিচিত। রাজপরিবারের সদস্য হওয়া সত্তে¡ও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনি কোনো এক যুদ্ধে বন্দী হয়ে দাসরূপে বিক্রি হতে হতে দিল্লির দাস-দাসীর বাজারে বিক্রির জন্য উপস্থাপিত হন। তার মালিক জামাল উদ্দিন বসরা ৪০ জন দাসকে এক সাথে ক্রয় করেন। সবাইকে উত্তমভাবে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উচ্চমূল্য প্রাপ্তির জন্য দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিসের দরবারে হাজির করেন।

সুলতান ইলতুৎমিস ৩৯ জন দাসকে খরিদ করেন- কিন্তু বলবনকে তিনি ক্রয় করতে মোটেও রাজি ছিলেন না। এমনকি তার মালিক জামালউদ্দিন যখন বিনামূল্যে উপহার হিসেবে সুলতান ইলতুৎমিসের কাছে বলবনকে রেখে দেয়ার আবেদন জানালেন তখনো সুলতান রাজি হলেন না। কারণ, বলবন দেখতে কুৎসিত ছিলেন। বলবনের সঙ্গী-সাথীরা কাঁদতে লাগলেন। কারণ, গত কয়েক বছরে তাদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল এবং ৪০ জন দাসের মধ্যে বলবন ছিলেন সবার নেতা ও সর্বগুণে গুণান্বিত। ঘটনার আকস্মিকতা, অপমান এবং সঙ্গী-সাথীদের কান্নাকাটিতে বিচলিত না হয়ে বলবন উঠে দাঁড়ালেন এবং সুলতান ইলতুৎমিসের সামনে একটি প্রশ্ন করার অনুমতি চাইলেন।

প্রকাশ্য দরবারে একজন ক্রীতদাস ভারতবর্ষের অন্যতম সর্বকালের সেরা শাসক সুলতান ইলতুৎমিসকে প্রশ্ন করবে এবং সুলতান সেই প্রশ্নের উত্তর দেবেন- এমন ঘটনা মধ্যযুগের রাজদরবারে ছিল রীতিমতো অসম্ভব বিষয়। ফলে উপস্থিত আমির-ওমরাহ সেনাপতি কোতোয়াল-পাইক পেয়াদা হায় হায় করে উঠলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বলবনের মালিক জামালউদ্দিনের প্রাণবায়ু বের হওয়ার উপক্রম হলো। সুলতান ইলতুৎমিস বলবনের সাহস দেখে অভিভূত হলেন এবং তাকে প্রশ্ন করার অনুমতি দিলেন।

বলবন সরাসরি সুলতানের কাছে প্রশ্ন করলেন- আপনি যে ৩৯ জন দাস ক্রয় করলেন তা কেন করলেন? সুলতান বললেন, কেন! আমার জন্য ক্রয় করেছি। বলবন বললেন, আপনি যার ক্রীতদাস এবং আমিও যার ক্রীতাদাস সেই আল্লাহর ওয়াস্তে ও সেই আল্লাহকে খুশি কার জন্য আরেকজন অপছন্দের এবং কুৎসিৎ চেহারার দাসকে কি ক্রয় করা যায় না? কারণ আমাকে যে কারণে আপনি অপছন্দ করছেন তার জন্য আমি দায়ী নই- আল্লাহই আমাকে এমন সুরতে তৈরি করেছেন। বলবনের কথা শুনে সুলতান ইলতুৎমিসের আত্মায় রক্তক্ষরণ শুরু হলো। তিনি বহুমূল্যে বলবনকে কিনে নিলেন। সালটি ছিল ১২৩২।

ইতিহাস সাক্ষী- ভারতবর্ষের সর্বকালের ইতিহাসে দাস বংশের শাসনের যে গৌরবোজ্জ্বল কীর্তিগাথা রয়েছে তার বিরাট অংশ তৈরি হয়েছিল বলবনের নেতৃত্বে ৪০ জন ক্রীতদাসের কারণে। রাজপ্রাসাদে বলবনের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল পানি সরবরাহ করা। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সুলতানের খাস লোক বা একান্ত সহকারীরূপে নিয়োগ পান। সুলতানা রাজিয়ার আমলে তিনি মন্ত্রী পদে ভূষিত হন এবং সুলতান নাসির উদ্দিনের জমানায় প্রধানমন্ত্রীরূপে পুরো দুই দশক ধরে ভারতবর্ষ পরিচালনা করেন। আমরা শৈশবকালে যে সৎ নিষ্ঠাবান দিল্লির শাসক নাসির উদ্দিনের কাহিনী পড়েছি তিনি ছিলেন বলবনের নিয়োগকর্তা ও জামাতা। নিঃসন্তান সুলতান নাসির উদ্দিনের মৃত্যুর পর বলবন দিল্লির মসনদে বসেন এবং মোট কুড়ি বছর শাসন করে ৭১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

সুলতান বলবনের জন্ম এবং ১৬ বছরের পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতা অর্থাৎ প্রথমে রাজপুত্র, তারপর ক্রীতদাস। ইরান-তুরানের শাহী প্রাসাদ পাহাড়-পর্বত-নদ-নদী-মরুভূমি পাড়ি দিয়ে তিনি দিল্লির শাহী প্রাসাদে প্রবেশ করেন ১২৩২ সালে। বহু চড়াই উৎরাই পার হয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন ৩১ বছর বয়সে। ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী এবং ২০ বছর সুলতানরূপে বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে ইন্তেকাল করেন ৭১ বছর বয়সে। সুতরাং ভারতবর্ষের রাজনীতি সম্পর্কে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল ৫৬ বছর এবং এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি ক্রীতদাস পানি সরবরাহকারী থেকে সুলতান পদে যেভাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তার দ্বিতীয় নজির ইতিহাসে নেই।

আমরা আজকের আলোচনার শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে উল্লিখিত বিষয়গুলোর একই যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করা যাক। প্রথমত, রাজনীতি যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন রাজনীতির চাবিকাঠি আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না। দেশী-বিদেশী নানা পক্ষ, প্রাসাদের অভ্যন্তরের মালি-বাবুর্চি থেকে শুরু করে মেথররা পর্যন্ত রাজা-বাদশাহদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে রাজা-বাদশাহরা তাদের চাকর-বাকরদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে ধড়িবাজ জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ চরিত্রের লোকজন রাজ্য-রাজা-রাজধানীকে বিদেশীদের কাছে বিক্রি করার হীরাঝিলের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের আদলে একের পর এক কুকর্ম শুরু করে দেয়। ফলে রাজনীতির চাবিকাঠি চলে যায় বহুজন ও বহু পক্ষের কাছে। এখন প্রশ্ন হলো- এমনতর পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়?

আলোচনার শুরুতে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রসঙ্গ টেনেছি। তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের পুরো রাজনীতির ময়দানকে তিনি ফাঁকা বানিয়ে ফেলেন। তিনি যাদেরকে প্রতিদ্ব›দ্বী মনে করতেন তাদের সবাইকে নির্মূল করতেন। তার বিশ্বস্ত ৪০ দাসের ৩৯ সদস্যের একজনকেও তিনি রেহাই দেননি। ফলে তাকে কেন্দ্র করে এমন এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয় যেখানে সুলতানের ভয়ে প্রকাশ্য দরবারে অনেক আমির-ওমরাহ মলমূত্র ত্যাগ করে কাপড় নষ্ট করে ফেলতেন। প্রাসাদের অভ্যন্তরেও একই ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। ফলে তার রাজত্বে সব কিছু ছিল, শুধু যোগ্য উত্তরাধিকারী ছাড়া। এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে তার পৌত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসানো হয় এবং সাম্রাজ্যের আমির-ওমরাহরা তরুণ সুলতানকে পুতুলরূপে ব্যবহার করে ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে দাস বংশকে সমূলে উৎপাটিত করে দেন। ফলে দাস বংশের কবরের ওপর খিলজি বংশের ফুল ফোটে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশ-সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে ইউরিয়া সার কারখানার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন আগামী ২ বছর উন্নয়নশীল এশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৪.৯ শতাংশ থাকার আশা এডিবি প্রেসিডেন্টের চুয়াডাঙ্গায় আগুনে পুড়ে পানবরজ ছাই মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ, রিমান্ডে নেয়া হবে : ডিবি বৃহস্পতিবার সারা দেশের স্কুল-কলেজ বন্ধ ভূরুঙ্গামারীতে চিকিৎসকের কপাল ফাটিয়ে দিলেন ইউপি সদস্য ‘পঞ্চপল্লীর ঘটনা পাশবিক, এমন যেন আর না ঘটে’ টি২০ বিশ্বকাপের পিচ পৌঁছেছে নিউইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামে হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে লাশ উদ্ধার মোরেলগঞ্জে বৃদ্ধের ফাঁস লাগানো লাশ উদ্ধার

সকল