০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং রাজনীতির নয়া হিসাব

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

আমেরিকা ও প্রথম আলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমাকে যারপরনাই বিস্মিত ও হতবাক করেছে। আমাদের দেশে যেহেতু বঙ্গবন্ধু পরিবার নিয়ে খোলামেলা আলোচনা অসম্ভব সেহেতু স্বপ্ন পরিসরে যতটুকু সম্ভব ততটুকু আলোচনা করে আজকের শিরোনামের যথার্থতা বর্ণনার চেষ্টা করব। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেছেন, আমেরিকা ইচ্ছে করলে কোনো দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে। দ্বিতীয়ত প্রথম আলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি পত্রিকাটিকে অতিশয় বা অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী বলে বর্ণনা করেছেন।

জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী যখন উল্লিখিত বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন আমি অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম, এও কী সম্ভব! কারণ ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের মুখপাত্ররূপে যারা কথাবার্তা বলেন তারা সবাই সময়-সুযোগ পেলে আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন। অন্য দিকে প্রথম আলো- ডেইলি স্টার পত্রিকাও আওয়ামী লীগের দু’চোখের বিষ বলে সর্বজনবিদিত। চানক্যের নীতি অনুসারে, শত্রুকে সর্বদা দুর্বল ও অসহায় হিসেবে প্রচার করা এবং উঠতে বসতে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার যে রীতি হাজার বছর ধরে অনুসৃত হয়ে আসছে তা হাল জমানায় এসে আওয়ামী লীগ কিভাবে অনুসরণ করে চলেছে তা আমরা কমবেশি সবাই দেখেছি এবং আওয়ামী প্রচারে আমাদের মধ্যে অনেকেই যখন প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, পৃথিবীর কোনো শক্তিই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদেরকে হতবাক করে দিয়েছে এবং কোটি কোটি আওয়ামী লীগের কর্মীর অন্তর ভেঙেচুরে খান খান করে ফেলেছে।

প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে বক্তব্য পেশ করছিলেন তখন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে ব্যস্ত। আমরা সবাই জানি, আওয়ামী লীগের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো না। শুধু ভালো না বললে সত্যের অপলাপ হবে। সম্পর্কটি অহিনকুল দা-কুমড়া, সাপে-নেউলের পর্যায়ে অতিক্রম করে রীতিমতো বিশ্রী একটি অবস্থা অতিক্রম করেছে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনো দেশের সাথে এমনতর সম্পর্ক হয়েছে বলে শুনিনি। অন্য দিকে, আমেরিকাও বাংলাদেশকে নিয়ে যে অস্বস্তিকর ও অপমানকর পরিস্থিতিতে পড়েছে তা তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে কেবল উগান্ডার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। সেখানকার স্বৈরশাসক ইদি আমিন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে খুবই অবমাননাকরভাবে উগান্ডা ত্যাগে বাধ্য করেছিলেন এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদেরকে ডেকে এনে তাদের পালকীর বাহক বানিয়ে সেই পালকীতে চড়ে শহরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এবং সবশেষে সবাইকে পত্রপাঠ বিদায় করেছিলেন। উগান্ডাতে আমেরিকার কী সমস্যা ছিল তা আমরা অনেকেই জানি না। আবার ইদি আমিন কর্তৃক আমেরিকাকে চরম শিক্ষা দেয়ার খেসারত কী হয়েছিল তাও আমাদের জানা নেই। তবে সত্তর দশকের আমেরিকার চেয়ে হাল আমলের আমেরিকা যে অনেক বেশি যুদ্ধংদেহী, কর্তৃত্বপরায়ণ ও অসহিষ্ণু তা আমরা ইরাক-আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরান, ইয়েমেন প্রভৃতি দেশের সাম্প্রতিক দুরবস্থা দেখলে বিলক্ষণ বুঝতে পারি। আর সে কারণেই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ আমেরিকার মেজাজ মর্জিকে তোয়াজ করে এবং তাদের ক্রোধকে ভয় পায়। ফলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রী, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর, প্রেসিডেন্ট প্রমুখ যখন বাংলাদেশ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেন তখন তা আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
আমাদের দেশের ইতিহাসে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুরুত্ব কোন পর্যায়ে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তবে আওয়ামী জমানায় সেই গুরুত্ব বারবার ধাক্কা খেয়েছে। তিনজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে অসহায় ও অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে পড়েছিলেন তা তারা যেমন ইহজনমে ভুলতে পারবেন না তদ্রুপ তাদের রাষ্ট্রের বাহাদুরির ইতিহাসে তাদের সেসব অবমাননা রীতিমতো চপেটাঘাত হিসেবে মহাকালের ইতিহাসে আলকাতরার অক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু এত কিছুর পরও আমরা আওয়ামী লীগকে টলতে দেখিনি। উল্টো আমেরিকাকে দেখেছি প্রধানমন্ত্রীকে তোয়াজ তদবির করতে। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে আমেরিকার চাপ আওয়ামী লীগ শুধু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়নি; বরং উল্টো আমেরিকাকে বকাঝকা করে এবং ড. ইউনূসকে দৌড়ের ওপর রেখে নিজেদের অপরাজেয় শক্তিমত্তার মাইলফলক স্থাপন করেছে।

উল্লিখিত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সাহস-শক্তি সম্পর্কে সাধারণ জনগণ যেমন ইতিবাচক চিন্তা করতে বাধ্য তদ্রুপ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের নেত্রীকে কিংবদন্তির মহাশক্তিধর অতি মানবী বলে বিশ্বাস করে ফেলেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যখন অপকটে আমেরিকাকে বকাঝকা দেন তাদের দেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে ঝাঁঝালো বক্তব্য দেন তখন তার কর্মী-সমর্থকরা পঞ্চমুখে মারহাবা বলতে বলতে খুশিতে আটখানা হয়ে গড়াগড়ি দেন এবং নিজেদের মন-মস্তিষ্কে এই বিশ্বাস পাকাপোক্ত করে ফেলেন যে, তাদের নেত্রীর সামনে কথা বলার ক্ষমতা স্বয়ং জো বাইডেনেরও নেই। অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লিখিত চিঠিতে যেভাবে জয় বাংলা বলেছেন, তাতে করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রচলিত বিশ্বাস ও আস্থা আকাশ মহাকাশ ফুঁড়ে আরো ঊর্ধ্বলোকে গিয়ে নতুন এক বিশ্বাসের পাহাড় রচনা করেছে।

আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা মার্কিন প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে প্রথম আলো নিয়ে কিছু সাদামাটা কথা বলব। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো নিয়ে আওয়ামী মহলে ক্ষোভ-বিক্ষোভের শেষ নেই। যার কার্যকারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে নিবন্ধের পরিধি অনেক বড় হয়ে যাবে। প্রথম আলো ও তাদের সহযোগী ডেইলি স্টার সম্পর্কে নির্ভেজাল সত্য কথা হলো, দেশের প্রধানমন্ত্রী ওই দুটো পত্রিকা পড়া তো দূরের কথা এদের নাম পর্যন্ত শুনতে পারেন না। এই পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ ও এখানে কর্মরত সাংবাদিক-সম্পাদক গণভবন, বঙ্গভবনে নিষিদ্ধ। ফলে পত্রিকা দু’টিতে কর্মরত সংবাদকর্মীদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ-দুর্দশার মধ্যে দিন পার করতে হয় তা সাম্প্রতিককালে রোজিনা ও শামসুজ্জামানের কারাবাস, সম্পাদক মতিউর রহমান বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা এবং প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে।

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রধান অভিযোগ হলো, এই পত্রিকাটি কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেন ডেকে এনেছিল। এরাই ড. ইউনূস ও আমেরিকাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে জনগণের কাছে পূজনীয় করে তুলছে এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে। এরা সরকারের উন্নয়নকর্ম চোখে দেখে না। উল্টো নানা ছলছুতো বের করে আওয়ামী লীগের দুর্নাম-বদনামকে মহামারী রূপ দিয়ে তা দেশ-বিদেশে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে দেয়। তারা তাদের সৃষ্ট কথিত বুদ্ধিজীবী-কথিত রাজনীতিবিদ, কথিত আমলা-কামলা-কবি-নায়িকা-গায়িকাদের দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে ওয়ান-ইলেভেনের নতুন ভার্সন আমদানির চেষ্টা করছে। এ কারণে প্রথম আলো সংশ্লিষ্ট সবাইকে দাঁতভাঙা শিক্ষা দেয়ার জন্য গোপন-প্রকাশ্য আকারময় ইঙ্গিতময় সব তৎপরতাই গত একযুগ ধরে ত্রিমাত্রিক উপায়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কখনো ওষুধ কখনো ইনজেশন আবার কখনো সাপোজিটর থেরাপির মাধ্যমে প্রথম আলোকে জ্বরমুক্ত করার অবিরত চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু কোনো চেষ্টাই সফল হচ্ছে না- উল্টো দেশের আবহাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের গরম ক্রমশ বেড়েই চলছে।

আমেরিকা-প্রথম আলো ও ড. ইউনূস ছাড়াও আওয়ামী লীগের আরেকটি অ্যালার্জির নাম তারেক রহমান। এর বাইরে জঙ্গিবাদ-জামায়াত ইত্যাদি নিয়ে তাদের কতটা অ্যালার্জি রয়েছে তা বলতে পারব না- তবে জঙ্গিবাদ ও জামায়াত প্রপাগান্ডা তাদের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার যা তারা অত্যন্ত সফলতার সাথে ব্যবহার করে ক্ষমতার যে পিরামিড রচনা করেছে সেই পিরামিডের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেছে। তাদের গত এক যুগের কীর্তিকলাপ, কলাকৌশল ও নিজেদের ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছার সফলতা সম্ভবত হাল আমলে এসে বড় রকম ধাক্কা খেয়েছে। এখন কেউ আর জঙ্গি-জঙ্গি খেলা, মৌলবাদের ধুয়া ও উন্নয়নের জয়গান শুনতে চায় না। সবাই সমস্বরে যেভাবে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র, সুশাসন ও নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি তুলছে তার পুরো সুযোগ নিয়ে আমেরিকা এবং প্রথম আলো প্রখর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যে দাবার চাল চেলে যাচ্ছে তা লগি বৈঠা-কোদাল, কুড়াল-চাপাতি-রামদা দিয়ে আর মোকাবেলা করা যাচ্ছে না।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য যা দিয়ে নিবন্ধ শুরু করেছিলাম তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। প্রধানমন্ত্রীর সহজাত অভ্যাস হলো, প্রতিপক্ষের প্রশংসা না করা। তার শত্রুদের শক্তিমত্তাকে তাচ্ছিল্য করে নিজের কর্মী-সমর্থকদের সব সময় চাঙ্গা রাখার যে কৌশল তিনি এতদিন করে আসছিলেন তার সাথে সাম্প্রতিক বক্তব্যের কোনো অন্তর্গত মিল পাওয়া যায় না। আমেরিকার শক্তিমত্তা প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বলতে চেয়েছেন কিংবা যা বোঝাতে চেয়েছেন তা বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়েছে। তার বক্তব্যের পর সরকারবিরোধীরা আরো বেশি মাত্রায় আমেরিকার প্রতি ঝুঁকে যাবে এবং প্রথম আলোও আশকারা পেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক লেভেলে এমন দাবার চাল চালবে যা সামাল দেয়া তো দূরের কথা বুঝতেই কয়েক মাস সময় পার হয়ে যাবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
আমরা আরো কঠোরভাবে ফিরে আসব : কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা স্মিথকে বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দল ঘোষণা পেটের দায়ে কাজে আসছি থাইল্যান্ড সফর নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, প্রশংসা ট্রাম্পের আজ আধাবেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকবে মিয়ানমার : যুদ্ধ আর জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে শরণার্থীদের সীমান্ত পাড়ি যেভাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়েছিল মালদ্বীপ ভারত থেকে চীনমুখী হওয়ার গতি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়া হবে খালেদা জিয়াকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ, ব্যাপক গ্রেফতার

সকল