২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সময়ের কৌতূহলোদ্দীপক শব্দাবলি

- ফাইল ছবি

প্রচার ও অপপ্রচার শব্দ দু’টি পরস্পর বিপরীতমুখী। তবে হালে শব্দ দু’টি কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠ বিষয় বা তত্ত্ব-তথ্য সবার কাছে হাজির করার মধ্য দিয়েই প্রচার শব্দটি একটি ইতিবাচক রূপ লাভ করে থাকে। অন্যদিকে অপপ্রচার শব্দটির অর্থ হতে পারে অসত্য ভাষণ, কুৎসা রটনা, পরনিন্দার চর্চা। অপপ্রচার চালানোর লক্ষ্য যদি মানুষকে বিভ্রান্ত করা, পথভ্রষ্ট করা হয়, তবে শব্দটিকে নেতিবাচক বলতে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। অর্থাৎ, দেখতে নারী তার চলন বাঁকা।

যাই হোক, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচার তথা ইতিবাচক কাজের কণ্ঠ এখন একেবারেই ক্ষীণ। পক্ষান্তরে অপপ্রচার তার ডালপালা মেলে এখন মহীরুহে পরিণত হতে চলেছে বা সেটি সমাজে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো বিস্তৃত হচ্ছে। শব্দ দু’টির মধ্যে প্রচারের কণ্ঠ ক্ষীণতর হওয়ার হেতু হয়তো এ কারণে যে, সব ধরনের মিডিয়া তার প্রতি বৈরী। পক্ষান্তরে অপপ্রচারকেই পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হচ্ছে, অর্থাৎ মিডিয়ার একটি বড় অংশই একপেশে ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে এটি ঠিক, ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ শক্তিকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা, হীনবল, নাজেহাল ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে এসব করা সত্তে¡ও জনগণ অত্যন্ত পরিপক্বতার পরিচয় দিয়ে এসব অপপ্রচারে কান দেয়নি এবং বিভ্রান্তও হচ্ছে না।

এমন সব দ্বিমুখী শব্দের পাশাপাশি আরো একটি শব্দ এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল ঢেউ তুলছে। শব্দটি ইংরেজি শব্দভাণ্ডার থেকে এলেও তা এখন বাংলা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছে। শব্দটি হলো- প্রোপাগান্ডা। এই শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ এমন হতে পারে, ‘তিলকে তাল’ করে তোলা এবং খেয়ে না খেয়ে ‘ঢোল ডঙ্কা’ বাজিয়ে মানুষের কানের ওপর চাপ তৈরি অর্থাৎ শুনতে বাধ্য করা। তবে প্রোপাগান্ডাকে কেউ যদি মনে করেন আরো একটু পরিশীলিত ও কোমল করে উচ্চারণ করবেন- হয়তো তাকে বাগাড়ম্বর বলা যেতে পারে। কিন্তু বাগাড়ম্বর শব্দটি প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বাক্যবাণ ছোড়া হচ্ছে, অসত্যকে পাল্টে দেয়ার যত বক্তব্য দেয়ার চেষ্টা চলছে, সেখানে বাগাড়ম্বর শব্দটি তেমন জুতসই নয়; বরং প্রোপাগান্ডাই যথার্থ বলে অনেকে মনে করেন।

এদিকে প্রধান প্রতিপক্ষ দলের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত যে সব কথাবার্তা ও আচার-আচরণ এবং অসত্যের ফেরি করা হচ্ছে, সেটি আসলে ইতিহাসের বিকৃতি, চরিত্রহননের যত প্রয়াস বলে মনে করাই সঙ্গত। এসব পরিবেশকে প্রতিকূলেই নিয়ে যাবে। একটি প্রবাদ আছে, ঢিলটি ছুঁড়লে পাটকেলটি খেতে হয়। কিন্তু তার পরও এখনো প্রধান বিরোধীদল ও তাদের প্রায় অর্ধশত সহযোগী সংগঠন একেবারেই মূক ও বধির হয়ে আছে শত গঞ্জনার মুখেও। এ থেকে মনে হয় সেই প্রধান প্রতিপক্ষও তাদের সহযোগীদের ধৈর্য্য ও সহ্যের বাঁধ মজবুত এবং সেটি এখনো ভেঙে পড়েনি। তারা শান্ত রয়েছেন। এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। শাসক দলের অনেকে সভ্যতা সৌজন্যের সব সীমা অতিক্রম করার পরও তারা তেমন কোনো বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। যদি একটু স্থিরভাবে ভাবা হয় তবে এটিকে কিছু পরেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে হবে।

দেশের হাল অবস্থা গত প্রায় দেড় দশক থেকে ধীরে ধীরে সব ক্ষেত্রেই নিম্নগামী হতে থাকায় আজকে মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। প্রশাসনের উপর্যুপরি অক্ষমতা অদক্ষতা ও দূরদৃষ্টির অভাবজনিত কারণেই ঘরে-বাইরে এখন দুর্যোগের যত ঘনঘটা। সুশাসন এখন জরাগ্রস্ত, সঠিক বিবেক বিবেচনা ফিরে গেছে আতুরঘরে। দেশ থেকে গণতন্ত্র, জবাবদিহির সংস্কৃতি উঠে যাওয়ার পথে। সর্বত্র এখন চলছে লুটপাটের মহোৎসব, উচ্চ আদালত সামগ্রিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এখন ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে আছেন। অর্থ সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের যে ধারণা ছিল সেটি এখন অতীতের কাহিনী। বর্তমানে সে চেষ্টার বিপরীতে সংযোজিত হয়েছে অর্থপাচার। ব্যাংকের ঋণকে মনে করা হচ্ছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পৈতৃক সম্পদের হিস্যা। উচ্চবিত্তের পরিবারের বখে যাওয়া কোনো ‘পুত্ররত্ন’ যেমন আপন খেয়ালখুশিমতো দুই হাতে অর্থে ব্যয় করে, ব্যাংকের ঋণ সেভাবেই এখন যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, পাচার করা হচ্ছে। এই পুত্ররত্নদের মন ও মস্তিষ্কে নেই দশ ও দেশের কথা। তারা আত্মসুখের উল্লাসে মেতে আছে। তাদের এই অপার স্বাধীনতার মদদ শক্তি সাহস যারা জোগাচ্ছেন সেই প্রশাসন। কাদের অর্থ কোন সে অদৃশ্য শক্তি এভাবে উড়াচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। জিজ্ঞাসা করাও মুশকিল।

প্রশাসনের যে হালহকিকত, তারা মানুষের মন ও দেহভঙ্গিমা থেকে উপলব্ধিই করতে পারছে না যে, তারা জনগণের হৃদয়ের মণিকোঠায় এখন আর নেই। সে জন্য জনগণকে বিভ্রান্ত করার পথ অনুসরণ করা হচ্ছে। এ কাজে তাদের একমাত্র হাতিয়ার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে অপপ্রচার বিষোদগার ধারাবাহিকভাবে প্রোপাগান্ডার কার্যক্রম জারি রাখা। এসব নেতিবাচক প্রচারে, যার সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই, প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নের একটি পিঠ দেখানো হচ্ছে। আর সব ‘কাহিনী’ মাত্র। উন্নয়নের যে সার্বিক ধারণা তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

প্রশাসনের উন্নয়ন-ভাবনার সাথে, উন্নয়নের সর্বজনীন যে ধারণা তার কোনো সামঞ্জস্য নেই। উন্নয়নের সর্বজনীন যে কথা সেটি বহু বিস্তৃত, তথা বহু বিষয় তার সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু প্রশাসনের ধারণায় আশ্রয় পেয়েছে ‘কিছু বড় প্রকল্প’ আর সামান্য কিছু অন্য প্রকল্প। কোনো কোনো মহল মনে করছে, এসব প্রকল্পের কতকটা বৃহত্তর জনস্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত আর কতকটা ঠিকাদারদের অসাধু স্বার্থের সাথে। শুধু তাই নয়, আরো ফাঁকফোকরের কথা শোনা যায়। কেউই এসব বৃহৎ অবকাঠামোকে উপেক্ষা করবে না ঠিকই, তবে এগুলো হলো উন্নয়নের দ্বিতীয় স্তরের বিষয়। প্রথমেই যে সব নিয়ে মাথা ঘামানোর বিষয় এখন সেগুলো মাথায় নেই। সে জন্য এসব পদক্ষেপ আসলে গাড়ির আগে ঘোড়া জুড়ে দেয়ার শামিল। আরো কিছু কথা বলা যায় এসব প্রকল্প নিয়ে। যেমন- আমাদের সবার বিবেচনায় এটি আছে যে, ক’টার ট্রেন ক’টায় যাত্রা শুরু করবে। সঠিক সময়সূচি অনুসরণ করা হয় না। আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, কোনো প্রকল্প কখনোই যথানিয়মে নির্ধারিত সময়ে শুরু ও শেষ হয় না। এর অনিবার্য ফল হলো প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দ বাড়তে থাকে, প্রকল্প থেকে জনগণ যে উপকার পেতে পারত সেটি পেতে বহু সময় অপেক্ষা করতে হয়, তেমনি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় তা কখনো কখনো মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। তার বহু উদাহরণ ঢাকা মহানগরীতেই রয়েছে।

এখন দেখা যেতে পারে উন্নয়নের প্রকৃত ধারাকে কীভাবে কতটা ‘বাইপাস’ করা হচ্ছে। সাধারণ ধারণা হচ্ছে, উন্নয়নকে আমরা সামগ্রিকভাবে জনমানুষের জীবনমানের উন্নয়ন বলতে পারি। আরো সহজ করে বলা যায়, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা, সুপেয় পানির জোগান দেয়া, শিক্ষার সমান নিশ্চিত করা, মানুষের চলাচলের বা ভ্রমণ করার যথেষ্ট সুযোগসহ নিরাপত্তা বিধান, দূষণহীন নির্মল পরিবেশ তৈরি করা। অর্থাৎ সবার জন্য অন্ন-বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করা, সেটি সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে প্রাধান্যের দাবি করে। সর্বোপরি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা। এখন যদি ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোকে সামনে এনে দেখা হয়, তবে তাকে কী বলা যাবে? উপরোল্লিখিত বিষয়গুলোর ওপর মানুষের অধিকার পূরণ করা কতটুকু সম্ভব হয়েছে। যদি না-ই হয়ে থাকে তাহলে সবাইকে বাধ্য হয়ে বলতে হবে, প্রশাসন উন্নয়নের প্রথম স্তরের অনুশীলনেও ব্যর্থ হয়েছে। এসব পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরের বিষয় নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে তথা অতিরঞ্জন করার পথ ধরা হয়েছে। অনেকটা অন্ধকে হাতি দেখানোর মতো।

অনেকেই এমন সমালোচনা করেন, প্রশাসনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের নিজ নিজ এলাকায় তাদের চলাচল সুগম করা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের ব্যবস্থাই কেবল করা হচ্ছে বেছে বেছে প্রকল্প হাতে নিয়ে। এটিকে যদি সর্বজনীন বলা হয়, তবে সেটি নিছক বাগাড়ম্বর বলেই মনে করতে হবে। আর এসব করার জন্য যে অর্থ ব্যয় হয় তা কিন্তু এ দেশের বঞ্চিত জীর্ণশীর্ণ ও শোষণের শিকার সাধারণ মানুষের প্রদত্ত ট্যাক্সের অর্থই।

দেশের আর্থ-সামাজিক যে চিত্র তুলে ধরা হলো সেটি কিন্তু কর্তৃত্ববাদিতার এক সাধারণ কার্যক্রম বলে বোদ্ধা সমাজের অভিমত। এটিই আমাদের সমাজ কাঠামোর চিত্র। যার সাথে গণতান্ত্রিক সমাজের কোনো যোগসূত্রই আবিষ্কার করা যায় না। যে সমাজের বিন্যাসের সাথে সাধারণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না- এমন একটি ব্যবস্থায় দেশের সব শ্রেণীর মানুষের অধিকার নিশ্চিত না হলেও সাধারণ মানুষকেই কিন্তু ওপর তলার মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের ব্যবস্থা করে দিতে হচ্ছে। এখানে সাধারণ মানুষ শুধু যে বাঁধা পড়ে আছে তা নয়; যে সব বৈদেশিক ঋণ নিতে হচ্ছে প্রশাসনকে, ওপর তলার মানুষের সুখ ভোগের জন্য- উচ্চ সুদসহ আসল ও নিম্ন আয়ের মানুষকে জোগান দিতে হবে। যেসব প্রকল্পকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপে রাখার কথা বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে, এখন সেগুলো প্রথম স্তরে নিয়ে আসার জন্য ৫,৫৬৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন অর্থ ঋণ করা হয়েছে। যা কিনা বৈদেশিক ঋণের ৬২ শতাংশ। ফলে এই ঋণ শোধের ভার সেই দুর্বল দুস্থদের মাথার ওপর পড়বে। কিন্তু এ জন্য কারো সহানুভূতি তাদের জন্য নেই।

আসলে এখন সবাই দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে নানা টানাপড়েন তৈরি হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারা তার অন্যতম কারণ। আন্তর্জাতিক বলয়েও সেই একই রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বলয়ে এখন পরিস্থিতি বুঝতে না পারার কারণ এবং সঠিক বা প্রকৃত বন্ধু নির্বাচনে যথেষ্ট বিবেচনার অভাবহেতু দ্বিমুখী প্রবল স্রোতের টানে দেশ আজ অথৈ সাগরের মোহনায় পৌঁছে গেছে। এ থেকে বেঁচে আসার সম্ভাবনা কতটা তা এ মুহূর্তে বলা শক্ত।


ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বিতর্কিত ক্যাচের ছবির ক্যাপশনে মুশফিক লিখেছেন ‘মাশা আল্লাহ’ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি মিরসরাইয়ে অবৈধ সেগুনকাঠসহ কাভার্ডভ্যান জব্দ মানিকগঞ্জে আগুনে পুড়ে যাওয়া মলিরানীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বরেকর্ড ইন্দোনেশিয়ার নারী ক্রিকেটার রোহমালিয়ার ‘এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব’ যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে ২ ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ শ্রীলঙ্কাভিত্তিক এয়ারলাইন্স ফিটসএয়ারের ঢাকা-কলম্বো সরাসরি ফ্লাইট চালু রোহিঙ্গা ইস্যুতে একসাথে কাজ করবে ঢাকা-ব্যাংকক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল