০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালের পাঁচালী

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ফাইল ছবি

১৪২৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের ২১ তারিখে আজকের নিবন্ধটি লিখছি, যা কিনা ইংরেজি সাল অনুসারে ৪ এপ্রিল ২০২৩ সাল। আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৬টায় যখন অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম তখন ড্রাইভার হঠাৎ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, স্যার, আগুন লেগেছে। আমার অফিসটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। আমরা যখন জাতীয় ঈদগাহ পার হয়ে তোপখানার দিকে যাচ্ছিলাম তখন ড্রাইভারের কথা শুনে আমি হকচকিত হয়ে পড়লাম। আমার চোখ বারবার বন্ধ হয়ে আসছিল। কারণ সাহরির জন্য সেই রাত পৌনে ৪টায় জেগেছি। তারপর সাভারের বাগানবাড়ি থেকে ঠিক পৌনে ৬টায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। গাড়িতে বসে আইপ্যাডে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম এবং আধো আধো ঘুমে বারবার ঢলে পড়ছিলাম। আর ঠিক তখনই আগুন! আগুন বলে ড্রাইভারের আর্তচিৎকার!

আমি হকচকিত হয়ে প্রথমেই ভাবলাম, হয়তো গাড়িতে আগুন লেগেছে। কিন্তু সম্বিত ফিরে দেখলাম জাতীয় প্রেস ক্লাব-সিরডাপের পেছনের আকাশে রক্তিম ও কালো ধোঁয়ার অবিরত কুণ্ডলী। আমি আন্দাজ করলাম, চানখার পুল এলাকায় ভয়াবহ আগুন লেগেছে। অফিসে এসে কিছুক্ষণ পর বিভিন্ন গণমাধ্যমের আপডেট দেখে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তদের আহাজারি দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বঙ্গবাজারসংলগ্ন চারটি বড় মার্কেটের তিন হাজার দোকান পুড়ে যাওয়া এবং পাশের কয়েকটি ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়া ও সেই আগুনের লেলিহান শিখা পুলিশের সদর দফতরে পৌঁছে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির প্রচণ্ড ক্রোধের কাছে মানুষ যে কতটা অসহায় তা নতুন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো।

সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছে যে, ফায়ার সার্ভিসসহ সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনীর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও আগুন থামানো যায়নি। উল্টো ফায়ার সার্ভিসের পাঁচজনসহ মোট ১১ জন আহত হয়েছেন। সবকিছু হারিয়ে হাজার হাজার ব্যবসায়ী যেভাবে আহাজারি করছেন তা দেখার পর অন্তর এতটা অস্থির হয়ে পড়ে যে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত আমি কোনো কাজকর্মে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।

নিবন্ধের শুরুতে বঙ্গাব্দের দিনক্ষণ উল্লেখ করার জন্য বেশ কয়েকবার বাংলা মাস এবং ছয়টি ঋতুর নাম স্মরণ করার চেষ্টা করলাম। এটা কি বসন্তকাল নাকি গ্রীষ্মকাল তা বুঝতে আমাকে কয়েক মিনিট সময় ব্যয় করতে হয়। নিজের হতবিহ্বল মন এবং মস্তিষ্কের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপে এটা হচ্ছে। ইদানীংকালে আমার মনে হচ্ছে, কেন জানি আমরা সবাই প্রকৃতির রোষানলে পড়েছি। কারণ আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি সমাজ-সংসার সর্বত্রই প্রবল মরুঝড় শুরু হয়ে গেছে। আমাদের বিশ্বাস অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-গরিমা-শিক্ষা-দীক্ষা-নীতি-নৈতিকতাগুলো ওজন হারিয়ে একটি অপরটির সাথে সঙ্ঘাত শুরু করে দিয়েছে। মহাশূন্যের যে অঞ্চলে মাধ্যাকর্ষণ কিংবা মহাকর্ষণ শক্তি নেই সেখানে একজন মানুষ যেরূপ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে শূন্যে ভাসতে থাকে ঠিক তদ্রুপ আমার চেনাজানা সবাই নিয়ন্ত্রণহীন বিচ্ছিন্ন এবং কর্মহীন-উদ্যমহীন-শক্তিহীন হয়ে শুধু ভাসছে। মহাশূন্যে যেমন শব্দ হারিয়ে যায় অর্থাৎ বিশেষ যন্ত্র ছাড়া যেমন কারো কথা শোনা যায় না তদ্রুপ চলমান সময়ে আমাদের হাসি-কান্না-বেদনার-সুর অন্যের কর্ণ কুহুরে প্রবেশ করছে না।

আমি গত তিন দশক ধরে ব্যবসাবাণিজ্য করছি এবং শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে রয়েছি। জীবনে বহুজনের উত্থান যেমন দেখেছি তেমনই পতনের দৃশ্যও কম দেখিনি। শৈশবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক জটিলতা-নিপীড়ন এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সীমাহীন অরাজকতা এবং সামরিক শাসন থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছি। কিন্তু চলমান সময়ের বিরূপ পরিস্থিতির মতো দুর্বিষহ সময় আমার জীবনে ইতঃপূর্বে কখনো আসেনি। আমার পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে দৃশ্যত আমিই সব দিক থেকে ভালো আছি, তো আমার যদি এ অবস্থা হয় তবে যারা বিপদ-বিপত্তিতে রয়েছেন তাদের মনে কী পরিমাণ জাহান্নামের আগুন জ্বলছে সেই চিন্তার সাথে বঙ্গবাজারের আগুনের লেলিহান শিখার আঁচ লাগার কারণে শরীর-মনে যারপরনাই অস্থিরতা শুরু হয়।

এবারের মাহে রমজান-বসন্তকাল এবং রাজনীতির ছলচাতুরীর কবলে পড়া অর্থনীতি আমাদের জনজীবন জটিল ও কুটিল বানিয়ে ফেলেছে। ফলে সবকিছু চলছে কিন্তু কিভাবে চলছে তা আমরা অনেকে টের পাচ্ছি না। আমরা সবাই পাগলের মতো ছুটছি- কিন্তু কোথায় ছুটছি, কেন ছুটছি তার কিছুই জানি না। মানুষের দীর্ঘশ্বাস-আহাজারি এবং অভিশাপে আকাশ-বাতাস ক্রমেই ভারী হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের এই ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মানুষের প্রতি চন্দ্র সূর্য- তারকারাজির যে বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রিক আকর্ষণ রয়েছে তা আমাদের কর্মের কারণে বিচ্ছিন্ন-এলোমেলো এবং ক্ষেত্র বিশেষে উল্টো হয়ে যাচ্ছে। একই মাটির সাথে আমাদের যে ম্যাগনেটিক ও চৌম্বক শক্তির মাধ্যমে সংযোগ রয়েছে তাও ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক। বিস্তারিত না বললে অনেকেই হয়তো বুঝবেন না।

বিজ্ঞানের সূত্র মতে, মহাকর্ষণ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে পৃথিবীর সবকিছুতে ভারসাম্য বিরাজ করছে। এই দুইটি আকর্ষণের কারণে আমরা যেমন মাটির বুকে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে চলাফেরা করি তদ্রুপ একই শক্তির কারণে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরের সকল শক্তির নিয়মিত চার্জ হয়ে থাকে। পৃথিবীর মহাকর্ষণ ও মহাকর্ষণের মতো আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে দুই ধরনের শক্তি রয়েছে। যথা-চৌম্বক শক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তি। আমরা চন্দ্র-সূর্য-তারকা থেকে শরীরের বৈদ্যুতিক শক্তি পাই এবং মাটি থেকে পাই চৌম্বক শক্তি। শরীরের অভ্যন্তরের চৌম্বক শক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তির চার্জ-রিচার্জ ও ডিসচার্জের ওপরই মানুষের বেঁচে থাকা- সুস্থ থাকা- ভালো মন্দ চিন্তা ইত্যাদি সবকিছু নির্ভর করে।

উল্লিখিত বৈজ্ঞানিক সূত্রের সাথে সকল ধর্মের আধ্যাত্মিকতার মর্মবাণী এবং আধুনিক যোগ ব্যায়াম-ধ্যান-সাধনা ইত্যাদির মর্মকথা হলো- মানুষ যখন কুকর্ম করে, কুচিন্তা করে তখন তার আত্মা-নফস নষ্ট হয়ে যায় এবং নষ্ট আত্মার শরীরের চৌম্বক শক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তিতে প্রায়ই শর্ট সার্কিট হয়ে যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট কুপ্রবৃত্তির মানুষের জীবনে দেখা দেয় ভারসাম্যহীনতা, অসারতা ও অসংলগ্নতা। এই সব মানুষ যদি কোনো দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকে তবে তাদের কুকর্মগুলো ভাইরাস আকারে সমাজ-সংসারে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়।

ওজোন স্তরে ছিদ্র হয়ে গেলে যেভাবে মহাজাগতিক ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীতে আসে অথবা পৃথিবীতে প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করলে যেমন আবহাওয়া বা জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট হয় তদ্রুপ মানুষ যখন তার নিজের আত্মিক ক্ষতি করে তখন প্রকৃতির ক্ষতিকর আলো-বাতাস এবং ঘ্রাণ মানুষকে পাকড়াও করে তোলে। ফলে জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে মানুষ ক্রমাগত বিপদ-বিপত্তির দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়।

আমাদের দেশে গত কয়েক দশকের মানবতাবিরোধী রাজনৈতিক জুলুম-অত্যাচার, বিবেকহীন নৃশংসতা, পাশবিক নিষ্ঠুরতা আমাদের সমাজের সব হার্ডওয়্যার বা কলকব্জা এবং সফটওয়্যার বা সূত্রগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে আমরা অনেকে বিকল হয়ে পড়েছি- অনেকে হয়েছি অবশ এবং বেশির ভাগ হয়ে পড়েছি ভাইরাস আক্রান্ত। আমাদের দেশের বড় বড় ক্ষমতার উৎসমূলে যেভাবে ভাইরাসের মেগা প্রকল্পের বিশাল বিশাল কলকারখানা অনবরত চলছে তাতে প্রকৃতির চৌম্বক শক্তি ও বৈদ্যুতিক শক্তি আমাদের নসিব থেকে উঠে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় জীবনে ঘটে চলছে একটার পর একটা বিপদ-বিপত্তি এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও দুর্ঘটনা।

আমরা সবাই কিয়ামতের কথা জানি। কিয়ামত সংঘটিত হবে হজরত ইসরাফিল আ:-এর সিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে, যার প্রচণ্ড শব্দে প্রকৃতির সব ম্যাগনেটিক ও বৈদ্যুতিক শক্তি শূন্য হয়ে যাবে। ফলে হিমালয় পাহাড় ওজন হারিয়ে তুলার মতো উড়তে থাকবে এবং সাগর-মহাসাগরের পানির উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে সব পানি গ্যাস হয়ে উড়ে যাবে। সুতরাং কেয়ামত সংঘটনের জন্য তিনটি উপকরণ অপরিহার্য। যথা- একটি প্রচণ্ড শব্দ, বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক শক্তি শূন্য হয়ে যাওয়া এবং সকল তরল পদার্থ বায়বীয়তে রূপান্তরিত হওয়া। এখন কেয়ামতের অপরিহার্যতার সাথে যদি বর্তমান জমানার মানুষের কর্মকাণ্ড এবং সেই কর্মকাণ্ডের বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক সমীকরণ মেলাতে চেষ্টা করি তবে কী ফলাফল বের হবে তা সম্ভবত সম্মানিত পাঠক ইতোমধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছেন।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির একটি বক্তব্য দিয়ে নিবন্ধ শেষ করব। রুমি বলেন, এক হাজার যোগ্য ব্যক্তির মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয় তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয় যখন কোনো অযোগ্য ব্যক্তি ক্ষমতায় আসে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
থাইল্যান্ড সফর নিয়ে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনিপন্থী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান, প্রশংসা ট্রাম্পের আজ আধাবেলা বাস চলাচল বন্ধ থাকবে মিয়ানমার : যুদ্ধ আর জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে শরণার্থীদের সীমান্ত পাড়ি যেভাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়েছিল মালদ্বীপ ভারত থেকে চীনমুখী হওয়ার গতি বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে সন্ধ্যায় হাসপাতালে নেয়া হবে খালেদা জিয়াকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ, ব্যাপক গ্রেফতার নাটোরের লালপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বছর বর্ণাঢ্যভাবে উদযাপন করবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে লড়ছেন না প্রিয়ঙ্কা!

সকল