০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


পশুরাজের নিরাপত্তা ও দর্শন পাঠের গুরুত্ব

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

অদ্ভুত সব চিন্তা ইদানীং মাথায় হরহামেশা ঘুরপাক খায়। রাস্তায় চলতে ফিরতে যা কিছু দেখি সেসব নিয়ে চিন্তা করলে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। অফিস আদালত, ব্যাংক, বীমাতে গিয়ে যা দেখি বা শুনি ওসবও ভালো কিছু নয়। রাজনীতির ময়দান তো পুরোটাই দুর্গন্ধে ভরা। কেউ যদি হাঁ করে তবে যে আওয়াজ বের হয় বা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে যে দুর্গন্ধ ছড়ায় তা হজম করার মতো শক্তি কয়জনের আছে বলতে পারব না- তবে আমি যে ক্রমশ অসহায় ও দুর্বলতর হয়ে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের হাঁ করা মুখোচ্ছবি, বিষাক্ত কথাবার্তা এবং চরিত্রের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর জমিনে বেঁচে থাকার বিকল্প উপায় খুঁজছি তা হলফ করে বলতে পারি। আর এ কারণে আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতা নিয়ে নতুন করে অধ্যয়ন শুরু করেছি।

আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আমার কর্মকাণ্ডের ধরন দেখলেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি এখন পাগলামোর কোন স্তরে রয়েছি। ইদানীং শুধু ভাবছি- তেলাপোকা-টিকটিকি, ইঁদুর-বাদুর, কেঁচো, শুয়োর-গণ্ডার ইত্যাদির সাথে আমার কি কি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। অথবা পিঁপড়া মৌমাছির সঙ্গে যদি আমি আমার কর্ম-শ্রেষ্ঠত্ব ও অর্জনের তুলনামূলক পার্থক্য নিরূপণের চেষ্টা করি তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যোগ্যতা আমার রয়েছে। আমি যদি নিজেকে রাজা-বাদশাহ-উজির-নাজির, শাহেনশাহ-সম্রাট হিসেবে কল্পনা করি তবে বনের রাজা বাঘ-সিংহের বীরত্ব শ্রেষ্ঠত্ব, নেতৃত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে তুলনীয় কোনো বৈশিষ্ট্য আমার মধ্যে রয়েছে কিনা তা ভাবলে কেন যেন নিজেকে খুব অসহায়, দুর্বল এবং রঙ্গমঞ্চের ভাঁড় মনে হয়।

আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম, আমিসহ অন্যান্য মানুষ প্রধানত চারটি কর্মের জন্য জীবনের নিরানব্বই ভাগ সময় ব্যয় করি এবং যুদ্ধবিগ্রহ, মারামারি, কাটাকাটি, হাসি-মশকরা-রং তামাশায় ব্যস্ত থাকি। খাওয়া-ঘুম-যৌন সঙ্গম ও সন্তান উৎপাদন এবং অতীত ও বর্তমান নিয়ে চিন্তা। তারপর নিয়তির প্রবল টানে মরে যাই। মানবমণ্ডলীর প্রধানতম এই চারটি কাজ তো প্রকৃতির সব দুর্বল-অসহায়, নিন্দিত-নন্দিত জন্তু জানোয়ার, কীটপতঙ্গ, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ারাও করে এবং শেষমেশ মারা যায়। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের তুলনায় কোটি ভাগের এক ভাগের থেকেও কম বুদ্ধি নিয়ে ওরা যদি মানুষের প্রধানতম চারটি কর্ম নির্বিবাদে নির্ঝঞ্ঝাটে এবং সুচারুরূপে করতে পারে তবে আমার শ্রেষ্ঠত্ব কোথায় বা আমার নিকৃষ্টতার পর্যায় কোন স্তরে!

উল্লিখিত চিন্তা করতে গিয়ে আমার মনে মাঝে মধ্যে অদ্ভুত সব রঙ্গরসের সৃষ্টি হয়। এতে করে আমি আপন মনে একাকী বসে প্রাণখুলে হাসতে পারি আবার কখনো কখনো প্রাণ ভরে কাঁদতে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। ফলে স্বৈরাচারী-জুলুমবাজ জাহেলদের সব দুরাচার অথবা দুনিয়ার দুর্দান্ত সব লুটেরার জঘন্যতম কর্মের ওপর থুতু নিক্ষেপ করে আমি মনের জানালা দিয়ে বসন্তের বাতাস ঢুকিয়ে পাখির ক‚জনের ছন্দে চোখ বুজে প্রকৃতির অপার সুধারস আস্বাদন করতে পারি।

আমি বনের রাজা বাঘ-সিংহের কর্মকাণ্ড চিন্তা করতে গিয়ে প্রায়ই ভাবি মানুষ কেন রাজা হয়ে চেয়ারে বসতে চায় আর সেই চেয়ারের নাম কেন সিংহাসন রাখে। অন্যদিকে পশুরাজ কেন মনুষ্যরাজের মতো বডিগার্ড নিয়ে চলে না। তাদের কেন রাজপ্রাসাদ নেই। অথবা মনুষ্যরাজদের মতো পশুরাজদের খাবারকে কেন রাজভোগ নামে ডাকা হয় না। আমি যখন কল্পনা করি যে, কেন পশুরাজ তার নিজের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে একটি নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করেছে, তখন সেই বাহিনীর গঠন-কর্মকাণ্ড-হাঁকডাক, দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে নিদারুণ সব ফ্যান্টাসি সৃষ্টি হয়ে যায়। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে না বললে আমার ফ্যান্টাসির আনন্দ অনুভব করা দুরূহ হতে পারে বিধায় নিম্নের দৃশ্যপট কল্পনা করতে থাকুন।

ধরুন কোনো এক পশুরাজের মনে এলো নিজের নিরাপত্তার জন্য একটি বাহিনী গঠন করার। তারপর নিজের শান শওকত, ফুংফাং এবং হাঁকডাক পশুসমাজে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি তার পাত্র-মিত্র-উজির-নাজির ইত্যাদি পদ পদবিতে পশুদেরকে নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবলেন। তিনি মনুষ্য সমাজের ট্যাংক বাহিনীর মতো করে গণ্ডারদের দ্বারা অগ্রভাগের নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করলেন। গণ্ডারদের অগ্রভাগে রাখলেন বানর বাহিনী যারা তার আগমনীবার্তা নিয়ে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে পুরো বনে তোলপাড় শুরু করে দেবে। গণ্ডারের পেছনে তিনি শুয়োরদের নিয়োগ দিলেন। কারণ বোধহীন গণ্ডারদের নিরাপত্তাব্যূহের পর রুচিহীন, নোংরা অসভ্য শুয়োর দলের ভয়ে রাজার নিরাপত্তাব্যূহের মধ্যে ঢুকে অভাব অভিযোগ পেশ করার রুচি ও অভিপ্রায় কোনো পশুর থাকবে না।

পশুরাজ তার নিরাপত্তার জন্য যে বেষ্টনী তৈরি করবেন সেখানে শুয়োরের পর কুকুর এবং কুকুরের পেছনে থাকবে হায়েনার দল। এরপর ময়ূর, শালিক, টিয়া-কাকাতুয়া প্রভৃতি পাখির একটি চৌকস দলের সদস্যদের নিয়ে রাজসিংহাসনের সম্মুখে একটি মনোরঞ্জক দল গঠন করা হবে যারা নেচে-গেয়ে-পেখম দুলিয়ে রাজার মনে প্রশান্তি দেবে। রাজার দুই পাশে থাকবে কাক ও শকুনের দল আর পেছনে থাকবে সজারু, ভল্লুক এবং শেয়ালের দল। তো এমন একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি না করে পশুরাজ কেন একাকী চলেন। রাতবিরেতে তিনি কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন না। কেন নিরাপত্তা বাহিনীহীন পশুরাজ হাজার হাজার হিংস্রর পশুর মধ্যে নির্ভয়ে হেলেদুলে চলতে পারেন। পশুরাজের কেন কোনো শত্রু থাকে না। প্রতিনিয়ত ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি কেন উন্মাদের মতো আচরণ করেন না। তার মনে সন্দেহ, লোভ হিংসা ইত্যাদি কেন জাগ্রত হয় না। তিনি কেন অবিচার করেন না। জেল-জুলুম হুলিয়া কেন পশুরাজের সংবিধানে নেই- এমনতর চিন্তা মাথায় এলে মনুষ্যরাজ সম্পর্কে আমার মনটা নিদারুণ বিষিয়ে ওঠে।

পশুরাজ ছেড়ে এবার পিঁপড়া ও মৌমাছিদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা যাক। মৌমাছিরা কোন হারাম জিনিস ভক্ষণ করে না। পবিত্র জিনিস থেকে পবিত্র সুধারস এনে নিজেদের পবিত্র দেহে তা ধারণ করে পরবর্তীতে উদগীরণ করার পরও মধু কেন পবিত্র থাকে তা নিয়ে চিন্তা করলে মনুষ্য জীবনের অসত্য ও অসততা এবং লোভলালসার নিকৃষ্টতা প্রকট হয়ে ওঠে। মৌমাছিদের চেয়ে পিঁপড়ার জীবন বৈচিত্র্য আরো মোহময়। পিঁপড়াদের পরিশ্রম করার সামর্থ্য, দলবদ্ধ থাকার নজির, নেতার হুকুমে জীবন দেয়া এবং শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আত্মাহুতি দেয়ার যে নজির পিঁপড়াদের সমাজে রয়েছে তা মানবসমাজে অসম্ভব। পিঁপড়া বাহিনী, পিপড়া, রাজা, সেনাপতি, মন্ত্রী, এমপি এবং পিঁপড়াদের হাটবাজার, বেচাকেনা, ভাগ-বাটোয়ারা এবং মজুদ নীতিমালা সম্পর্কে আপনি যদি জানেন তবে মহান আল্লাহর সৃষ্টির বিশালতা এবং বিচিত্রতা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না।

আলোচনার একদম শুরুতে বলেছিলাম আধ্যাত্মিকতা ও দার্শনিকতা সম্পর্কে। চলমান সময়ের আজাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং অন্যকে রক্ষা করার জন্য দার্শনিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সম্মিলন ছাড়া সম্ভব নয়। দার্শনিকতা দ্বারা আপনি বিচার বিশ্লেষণ করতে পারবেন এবং প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পারবেন কিন্তু সেই সত্য প্রকাশ কিংবা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। কারণ সত্যকে ফুটিয়ে তোলা সত্যের প্রচার এবং সত্যের বাস্তবায়নের জন্য যে সাহস ও কৌশল দরকার পড়ে তা কেবল আধ্যাত্মিকতা দিয়েই সম্ভব। এ কারণে বর্তমানে কিংবা সুদূর অতীতে বহু দার্শনিক বহু সত্য অনুধাবন করেছেন কিন্তু কেবলমাত্র আধ্যাত্মিকতার অভাবে তাদের সেই দর্শনকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি।

দর্শনের জন্য যেমন আধ্যাত্মিকতার প্রয়োজন রয়েছে তদ্রুপ আধ্যাত্মিকতার জন্যও দর্শন শাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি প্রয়োজন রয়েছে। অনেক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন কেবল বাস্তব অভিজ্ঞতা ঘটনার তাৎপর্য এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পারার কারণে। এখন প্রশ্ন হলো দর্শন আধ্যাত্মিকতা কী এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বাংলাদেশে এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমার মতামত ব্যক্ত করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব।

দর্শন বলতে সাধারণত চর্মচক্ষুতে কোনো কিছু দেখাকে বুঝায়। কিন্তু দর্শনকে যদি শাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেন এবং যিনি দেখেন তার মধ্যে দার্শনিকতার গুণাবলী থাকে তবে প্রচলিত সমাজ রাষ্ট্র ও কালকে ত্রিমাত্রিক উপায়ে দেখতে পারার ক্ষমতার নামই দার্শনিকতা। দ্বিতীয়ত, কোনো একটি বিষয় দেখার পর সেটির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ কার্যকারণ নির্ণয় এবং দর্শনীয় বস্তুর ভেতর বাহির পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কেও দার্শনিক তথ্য সংগ্রহ করেন। সুতরাং বর্তমান কালের দার্শনিকরা যদি আওয়ামী সরকারের কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করেন তবে চলমান অনিয়ম দুর্নীতির যে তথ্য প্রমাণ তারা সংগ্রহ করতে পারবেন তা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

এখন প্রশ্ন হলো- দার্শনিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন কিনা। এ ক্ষেত্রে আমার পর্যবেক্ষণ হলো হয়তো অনেকে করছেন। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার শক্তি না থাকার কারণে বেশির ভাগ দার্শনিক বেহড়-বাগী বন্দুকের ভয়ে যেভাবে দর্শনশাস্ত্র ভুলে যাচ্ছেন তাতে করে মনে হচ্ছে নৈতিক সাহস অর্জনের জন্য আধ্যাত্মিকতার চর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে এবং সেই লক্ষ্যে আমার মতো আম-আদমি দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে সামান্য নড়াচড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
বৃহস্পতিবার স্কুল-কলেজ খোলা না বন্ধ, সিদ্ধান্ত জানায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যার সতর্কতা জারি সকল দল-মতের মানুষকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের শফিউল বারী বাবুর জন্মদিনে পানি ও স্যালাইন বিতরণ করল তার দুই শিশু সন্তান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ : আফগান দলে ছয় অলরাউন্ডার কপ-২৯ সম্মেলনে জলবায়ু সহনশীলতা অ্যাডভোকেসি জোরদার করবে বাংলাদেশ : পরিবেশমন্ত্রী সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও নির্যাতন বন্ধের দাবি বিএফইউজে-ডিইউজের সব আদালতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস বাস্তবায়ন করা হবে : প্রধান বিচারপতি ভুল চিকিৎসার অজুহাতে চিকিৎসকের ওপর আক্রমণ ন্যক্কারজনক : স্বাস্থ্যমন্ত্রী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা : অস্ট্রেলিয়ায় পর্ন সাইটেও নজরদারি গাজা যুদ্ধে আরো ৩৩ জনের মৃত্যু : নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৫৬৮

সকল