২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যারা দূরে দেখেন, তারাই কি অন্ধ

ড. মাহবুব হাসান - ছবি : নয়া দিগন্ত

গতকালই আবারো সয়াবিন তেল আর চিনির নাম বেড়েছে। লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে দাম এখন ১৯০ টাকা। আর চিনি কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকায় বিক্রি হবে। পত্রিকায় এই সংবাদ পড়ে মনে হলো- চিনি খেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়, তাই না খাওয়াই ভালো। তার বদলে চিনি ছাড়া চা, চিনি ছাড়া পায়েস কিংবা জিরো ক্যালোরির চিনি বা ওই জাতীয় পদার্থ দিয়ে পায়েসান্ন করা যেতে পারে। গত পরশু তো অগ্রহায়ণের প্রথম দিন গেল। নবান্ন উৎসব ঢাকা আয়োজিত হয়েছিল। অনেকেই সেই উৎসবে গিয়েছিলেন নবান্নের স্বাদ নিতে বা উৎসবে মেতে উঠে নগরের দুর্ভোগ ও কষ্ট চাপা দিতে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে আজ আর নবান্ন হয় না। কেন এই সাংস্কৃতিক প্রবাহে ভাটা পড়েছে, তা আমরা জানি না। তবে বোঝা যায়, হেমন্তের এই সোনালি দিনগুলো আর সোনালি স্বপ্ন যেন রচনা করে না। ধানের বহু রকম আমনের গমগমে আবহ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ চিনি কিনতে পারে কি না, জানি না। তবে তারা খেজুর গুড় বা আখের গুড় নিয়মিতই কেনেন। কিন্তু সেই গুড়েও বালি। আগের সেই মজা বা স্বাদ গুড়ে কেন নেই, এই প্রশ্ন কেউ করেন কি না জানি না।

গ্রাম হোক, শহর হোক, দৈনন্দিনের একান্ত জরুরি পণ্য তেল। সেটি আমাদের শৈশবে ছিল ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল, আমাদের যৌবনে এলো সয়াবিন তেল। মেডিক্যাল শাস্ত্রের জ্ঞানীজনরা বললেন, সরিষা ঘন বলে তার অনেক দোষ। আর সয়াবিন হালকা বলে তার দোষ নেই বললেই চলে। এখন এই পড়ন্ত জীবনে এসে শুনছি- সব তেলেই ক্ষতির পরিমাণ বেশি। তেল ব্যবহার কমিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। আসলে সত্য কোথায় লুকিয়ে আছে, তা কে বলবে আর কে মানবে?

প্রতিদিন একজন পূর্ণ বয়সের মানুষের প্রয়োজন ডাক্তারি ভাষ্যে দুই হাজার পরিমাণ ক্যালোরি। ক্যালোরি শরীরের ইঞ্জিন চালাতে লাগে। আর সেই ক্যালোরি জোগান দেয় খাদ্যশস্য, মাছ-গোশত, চিনি ও দুধ। তার সাথে তেলও জড়িত। মানে সহযোগ লাগে সবারই। ফল-মুলাদির সহযোগ তো আরো বেশি প্রয়োজন। তো আমাদের গরিব মানুষরা ওই সব পণ্য কি কিনতে পারবে? রোজ কি তারা দুই হাজার ক্যালোরির খাদ্য খেতে পায়, না খেতে পারে? চিনি যদি ১০৮ টাকায় বিক্রির দাম নির্ধারণ করে দিয়ে থাকেন, কে বা কারা দাম নির্ধারণ করেছেন, নিউজে কিন্তু তার কোনো চিহ্ন নেই।

আমরা জানি, সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজারের পণ্যমূল্য ঠিক রাখার দায়িত্ব পালন করে। তার মানে, বাণিজ্যমন্ত্রীই এই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কেন তিনি চিনির দাম বাড়ালেন? কেন তারা তেলের দাম বাড়ালেন? জানি তিনি বলবেন, আমদানিকারকরা উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে তেল এনে, রিফাইনারিতে পরিশুদ্ধ করে, বোতলজাত করে বাজারে ছেড়েছেন। তাতে তাদের ব্যয় তো আছেই, তার ওপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ধকল আছে, পরিবহন ব্যয় বেড়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানতেই হবে, এর ফলে দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই।

জ্বালানি তেলের বিকল্প কি? জীবাশ্ম জ্বালানি অফুরন্ত নয়, তার লিমিটেশন মনে রেখে কি আমাদের কোনো বিকল্প ভাবনা আছে। বিদ্যুতের মূল শক্তি জীবাশ্ম জ্বালানি। বিকল্প জানি, সৌরবিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ বা বায়ুবিদ্যুৎ আমাদের পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহার করতে হলে নেচারের কাছে ফিরতে হবে আমাদের, এর কোনো বিকল্প আপাতত নেই। এই তিনটির মধ্যে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি লাগে, যা জীবাশ্ম-নির্ভর। পশ্চিমারা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রাগ্রসর চিন্তার ও আবিষ্কারের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আমরা তাদের প্রযুক্তিজ্ঞান আনতে পারি। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি আমাদের যান্ত্রিক জীবনাচারের খেদ ও ক্লান্তি, ভ্রান্তি আর মোহ থেকে মুক্ত করতে পারে।

যখন এই পৃথিবীর মানুষের কাছে আখের গুড় বা তারপর আখ থেকে চিনি উৎপাদনের টেকনোলজি ছিল না, তখন মানুষ কি বাঁচেনি? তখন কি কি খাদ্য তাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি এবং শান্তি এনেছে, কল্পনায়, তাকে আনুন। আজকে হয়তো সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের খাদ্যাভ্যাস চলবে না, তবে ওই সময়কার জীবনের ধারা থেকে আমরা নিজেদের নতুন খাদ্যাভ্যাসে নিয়ে যেতে পারি, যেখানে চিনির মতো ক্ষতিকর ও তেলের মতো ভীতিকর পণ্যমূল্য দেখে আমরা ভিরমি খেয়ে মরব।

২.
খাদ্যদ্রব্যের সাথে আর যাই করা হোক- লোভ আর লাভ যোগ করা অন্যায় অপরাধ। অপরাধ এই কারণে যে, যারা দাম বাড়ানোর ত্বরিকায় বিশ্বাসী তারা লোভী। আর যারা সেই লোভকে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দেন তারা ওই বাণিজ্যের লাভের অংশীদার। না হলে কি করে তারা গণমানুষের নিত্যদিনে ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়াতে সিন্ডিকেটেড ব্যবসায়ীদের পক্ষে কাজ করেন? সেটি কি নির্ধারকদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী মহলের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজন বা অংশীদার।

সরকার যদি জনগণের হয়, মানে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়, তাহলে তাদের স্বার্থ দেখে অহোরাত, আর যদি তা না হয়, তাহলে আমলানির্ভর ও ব্যবসায়ীদের চক্রে ডুবে যায়। এই যে গত ছয় মাস ধরে ক্রমান্বয়ে আমদানিকৃত ও দেশজ পণ্যের দাম নির্ধারণ, পুনর্নির্ধারণ করতে করতে ব্যবসায়ীদের লোভের জিহ্বাকে বাড়িয়ে চলেছেন, এই ক্ষতি সরকারের গায়েই লাগবে গিয়ে, কেননা, সরকারই শপথ করেছিল সব কিছুর দেখভাল করবে।

নাভিশ্বাস এখন জনগণের, সরকারেরও, তবে, সরকার তা স্বীকার করছেন না। স্বীকার করুক বা না করুক, সত্য কিন্তু অসত্য হয়ে যায় না। মিথ্যাও হয় না। যারা কাঁচাবাজারে রোজ যান, রোজ শাকসবজি কেনেন, পারলে কেনেন, না পারলে হতাশ হয়ে ফেরেন, তারা কিন্তু সরকারের দিকেই তাকিয়ে থাকে। কেন সরকার বাজারের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। কেন তারা দামের পাগলাঘোড়াটিকে লালন পালন করছে? কারণ কি এই যে, ওই পাগলা ঘোড়ার মালিক তাদেরই রাজনৈতিক সদস্য, তাদেরই রাজনৈতিক অ্যালি? ওই সিন্ডিকেটেড হোতারা চোখের সামনে থাকলেও সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাদের কীর্তি চোখে দেখে না। তারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তাই তারা সাদা চোখে কিছু দেখে না। এই ধারা আর কতকাল চলবে? ভোক্তা জনগণ কবে তাদের অধিকার ফিরে পাবে?


আরো সংবাদ



premium cement