২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইতিহাস সৃষ্টিকারী গর্বাচেভ

ইতিহাস সৃষ্টিকারী গর্বাচেভ - ছবি : সংগৃহীত

মিখাইল গর্বাচেভ ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ৯১ বছর বয়সে মারা গেলেন। তাকে তার প্রিয় স্ত্রী রাইসা গর্বাচেভের কবরের পাশে মস্কোর নোভোডেভিচি কবরস্থানে সমাহিত করা হচ্ছে। গর্বাচেভ ১৯৮৫ সালে ৫৪ বছর বয়সে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হন। তিনি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, দৃঢ়তা, অসাধারণ বুদ্ধি এবং কমিউনিস্ট সিস্টেমের মধ্যে থেকেও মানুষের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান ও নিষ্ঠার মাধ্যমে, একজন বড় মাপের রাশিয়ান নেতা হওয়ার বাসনাকে জয় করতে পেরেছিলেন। নিকিতা ক্রুশ্চেভ, কোসিগিন, ব্রেজনেভের মতো কট্টরপন্থী রাশিয়ান নেতাদের ঐতিহ্য থেকে তাকে আলাদা করে বাছাই করা যায়। একজন আদর্শবাদী এবং সংস্কারক হওয়ার কারণে, তিনি একটি মিশ্র উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। যদিও তিনি এমন একজন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন যিনি বিশ্বকে শান্তি ও সৌহার্দ্যরে দিকে এক ধাপ এগিয়ে এনেছিলেন। তবে তিনি তার নিজের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের বেদনাদায়ক পতনের জন্যও দায়ী। সংস্কারের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থবিরতার অবসান ঘটানোর উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল তার মানসে, তবে সংস্কারপ্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব ছিল। তার ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক নীতির কারণে বৈশ্বিক বিষয়গুলোতে মহাকাব্যিক পরিবর্তন ঘটে। তার কারণেই বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলনের পথ প্রশস্ত হয়। তিনি কখনোই সোভিয়েত ইউনিয়নে উত্তেজনা ও অস্থিরতা তৈরি করতে চাননি, তবে গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে অস্ত্র প্রতিযোগিতার বোঝা বহন করতে ব্যর্থ অর্থনীতির অক্ষমতা তাকে অনেকাংশে বেকায়দায় ফেলে দেয়।

জীবনে এবং মরণে গর্বাচেভের জন্য প্রকৃত এবং অপ্রতিরোধ্য প্রশংসা পশ্চিমাদের কাছ থেকে এসেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, ফ্রান্সের ম্যাক্রোঁ, জাপানের কিসিদা, ‘সাহসী গণতান্ত্রিক সংস্কার’ প্রবর্তনের জন্য তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কোল্ড ওয়ার বা ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটান এবং বিশ্বকে নিরাপদ করে তোলার জন্য তাকে ‘হিরো’ আখ্যা দিয়েছেন। মার্কেলা বলেছেন, তিনি ‘ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন’। বাইডেন বলেছেন ‘একজন সত্যিকারের নেতা’। গর্বাচেভ ১৯৮৭ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৮৯ সালের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন যে, রাশিয়া আফগানিস্তানে হেরে যাওয়া যুদ্ধে লড়াই করছে। তার মেয়াদকালে রাশিয়ান বাহিনী আফগানিস্তানে অবস্থান করতে ব্যর্থ হয়। ‘মুজাহিদিন’দের জিহাদি যুদ্ধে অবিরাম মার্কিন সহায়তা রুশদের ‘ভালুকের ফাঁদ’ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে পিছনে ফেলে যায়, যার কারণে গোষ্ঠীগত জঙ্গিবাদ এবং তালেবানাইজেশনের জন্ম হয়। তালেবানদের নীতিকে বহিঃবিশ্ব ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যা দিয়ে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। বিশ্লেষকের মতে আফগান বিপর্যয় রাশিয়ার পতনকেও ত্বরান্বিত করতে অবদান রাখে।

গর্বাচেভের মৃত্যুর পর পশ্চিমারা তার জন্য যেমন প্রশংসা করেছে তেমনি অনেকে পুতিনের সাথে তুলনা করে তাদের ঘৃণা প্রকাশ করেছে। রাশিয়ার পুতিনপন্থীরা বলছেন, গর্বাচেভ যা ভেঙেছেন পুতিন সেটিকে ‘ইন সিটু’ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

গর্বাচেভ ভালো কার্ডগুলো খারাপভাবে খেলেছিলেন, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বলতে গেলে নিজেরও সব কিছু হারিয়েছিলেন। তিনি যা কিছু করেছিলেন তা পাশ্চাত্যকে উপকৃত করেছিল। তার ক্ষমতা ত্যাগের পর ইউরোপ ও পশ্চিমারা রাশিয়ার টুঁটি চেপে ধরছে বলে পুতিন অনেক বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন।

গত ২ মার্চ মিখাইল গর্বাচেভের বয়স যখন ৯১ বছর তখনো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। তার শেষ করা ক্লোল্ড ওয়ারের ৩০ বছর পর একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ মোটেই দেখতে চাননি। গর্বাচেভ ২০১৭ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমার মা ছিলেন ইউক্রেনীয়। আমার স্ত্রী রাইসাও ইউক্রেনের নাগরিক।’ তিনি কখনো চাননি রাশিয়া ও ইউক্রেনের সম্পর্ক খারাপ হোক। যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনে বসবাসরত কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। সে মর্মবেদনা সেটি তিনি প্রকাশ করেছেন নতুন লেখায়। ‘পৃথিবীতে মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নেই,’ তিনি যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য লিখেন ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং স্বার্থের স্বীকৃতির ওপর ভিত্তি করে আলোচনা এবং সংলাপ সবচেয়ে তীব্র দ্ব›দ্ব এবং সমস্যার সমাধান করার একমাত্র সম্ভাব্য উপায়।’ মস্কোতে গর্বাচেভ ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে যুদ্ধ স্থগিত ও শান্তি আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানায়।

১৯৯০ সালে গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মানবাধিকার ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তাই হচ্ছে গ্লাসনস্ত। স্ট্যালিনের জমানা থেকেই লৌহযবনিকার বেষ্টনীতে সোভিয়েত সমাজ আবদ্ধ থাকে।

বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মের কারণে একসুতোয় বাঁধতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার রাষ্ট্রের কাছে ন্যস্ত হয়। যাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। ধর্মালয়ের প্রভাব নানা কৌশলে বন্ধ করা হয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে গ্লাসনস্ত নীতি এনেছিলেন গর্বাচেভ। পেরেস্ত্রইকা অর্থ পুনর্গঠন। আর্থিক ও সামাজিক সংস্কার করতে ১৯৯০ সালে এই নীতি প্রবর্তন করেন প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। তিনি মনে করেছিলেন, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হালকা হলে জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত হবে। মূলত পশ্চিমা গণতন্ত্র ও উদারবাদ তাকে মোহিত করেছিল।

গর্বাচেভ সংস্কার শুরু করেছিলেন সোভিয়েতকে আরো মজবুত করতে। কিন্তু এতে বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবার সংস্কারবিরোধীদের বিক্ষোভে পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃত্বে পূর্ণমাত্রায় বাজার অর্থনীতিসহ উদারীকরণ এবং রুশ কমিউনিস্ট পার্টিকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে রূপান্তরের দাবি জোরালো হয়। গর্বাচেভের সাথে মতপার্থক্যের জেরে মস্কোর পার্টিপ্রধানের পদ থেকে বরিশ ইয়েলৎসিনকে বহিষ্কার করা হয়। পার্টির নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার জন্য গর্বাচেভকেই বিরোধীরা দায়ী করে। চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের লাল ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। ১৯৮৬ সালে, যখন তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, চেরনোবিলে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে। এই বিপর্যয়ও পারমাণবিক অস্ত্র বিলোপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনায় অবদান রেখেছিল। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সাথে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। কেননা থ্যাচার পারমাণবিক প্রতিরোধের সমর্থক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে বলেছিলেন ‘পারমাণবিক যুদ্ধ গ্রহণযোগ্য নয় এবং পারমাণবিক যুদ্ধে কোনো বিজয়ী থাকবে না।’ মাল্টা সম্মেলনে গর্বাচেভ বুশকে বলেছিলেন, ‘আমরা আমেরিকাকে আমাদের শত্রু মনে করি না।’ এতে বুশ উঠে দাঁড়িয়ে পুরো প্রস্থের টেবিলের ওপর তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন করমর্দনের জন্য। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য তিনি কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেছিলেন। বলেছিলেন তার বক্তব্য ‘অশালীন’। তিনি ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘৩০ বছর ধরে চলমান একটি চুক্তিতে মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর জন্য আপনাকে কখনই ক্ষমা করব না।’ মূল রুশ ভূখণ্ডে বরিশ ইয়েলৎসিনের উসকানিতে রুশ প্রজাতন্ত্রের বিচ্ছিন্নতার দাবি বেশ জনপ্রিয় হয়। জর্জিয়া, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া প্রভৃতি প্রজাতন্ত্রগুলো বিচ্ছিন্নতার দাবি নিয়ে হাজির হয়। মুসলিম অধ্যুষিত আজারবাইজানে খ্রিষ্টান জনগণ বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলে এবং কিছুদিন পরেই সেখানে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় যার ওপর মস্কোর কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না। গর্বাচেভ যখন ক্রিমিয়ায় অবস্থান করছিলেন তখন সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি সম্মিলিতভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে।

তিনি চাননি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাক। দেশটিকে পরিবর্তন করার জন্য লৌহ যবনিকা উন্মুক্ত করে দেয়ার ফলে যে গতি শুরু হয়েছিল সেটিকে স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও রাশিয়ার পতনের দিকে পরিচালিত করা থেকে বিরত রাখা যায়নি। এগুলো সর্বদা তাকে কিছুটা অসন্তুষ্ট এবং বিরক্ত করে রেখেছিল। কিন্তু তিনি কি তার মৌলিক সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হয়েছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি একবার বলেছিলেন : ‘যদি আমি এটি আবার করতে চাই, তবে আমি সম্ভবত নিজেকে আরো ভালো করতে সক্ষম হবো না।’ গর্বাচেভের নীতির ফলে বিপুলসংখ্যক রাশিয়ানের ভিতর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, শক্তিধর একটি দেশে পতনের অনুভূতি তৈরি হয়। গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কট, আংশিকভাবে তেলের দামের পতন, খাদ্যসঙ্কট, দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা আইটেমের অভাব, বড় আকারের গৃহযুদ্ধ, চেচনিয়ায় স্বাধিকারের আন্দোলন ও তিক্ত যুদ্ধ পতনের গতিপথ প্রশস্ত করে।

গর্বাচেভের নেতৃত্বে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারগুলো রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে শুরু হয়েছিল, আগ্রাসীভাবে ‘নতুন চিন্তাভাবনা’ প্রচার করেছিল এবং ক্রমাগত সোভিয়েত ইউনিয়নের পিপলস ডেপুটিদের কংগ্রেসে দলের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। তিনি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পর দেশ বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হতে শুরু করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ার সাথে সাথে বাল্টিক দেশগুলো এবং ককেশাসে সঙ্কীর্ণ মনের জাতীয়তাবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি প্রজাতন্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সাথে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা কামনা করে।

সেই ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রগুলোতে জাতীয়তাবাদ ও রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের জাগরণকে উদ্দীপিত করেছিল। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্রীকরণের সংমিশ্রণ অনুরণিত হয় এবং অবশেষে তিনটি প্রধান প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশ ‘স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর কমনওয়েলথ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ হয়ে যায়, গর্বাচেভ পদচ্যুত হন। রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তম উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র। এর জনসংখ্যা ইউএসএসআরের প্রায় অর্ধেক। রাশিয়ান সমাজ সোভিয়েত সমাজের চেয়ে ‘মুক্ত’। বহুদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে, এটি পশ্চিমা শিবিরে একীভূত হতে চেয়েছিল এবং একবার জি-৮ এর সদস্য হয়েছিল। কিন্তু দেশটি পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পথ আগলে রাখে। ওয়াশিংটনের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে এটিকে দুর্বল করা এবং ন্যাটোর পূর্বদিকের সম্প্রসারণ।
পিছনে তাকালে দেখব, সোভিয়েত ইউনিয়ন যথেষ্ট প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনক্ষমতার অধিকারী ও শক্তিশালী ছিল। বিশ্বে প্রথম মনুষ্যসৃষ্ট উপগ্রহ এবং প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃতিত্ব। ওই সময় দুর্বল কৃষি এবং হালকা শিল্প ছিল এক সমস্যা, প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব সমাধান করা যেত। কিন্তু গর্বাচেভ সমস্যাগুলোকে ভুলভাবে বিচার করেছিলেন, সংস্কারের ভুল পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ছিল। তিনি স্পষ্টতই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন এবং তিনি সেই সময়ে পশ্চিমা জনমত তাকে যে প্রশংসা করেছিল তা নিয়ে যত্নশীল ছিলেন এবং উপভোগ করেছিলেন। পরবর্তীতে দেখা যাচ্ছে তিনি মূলত পশ্চিমাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন।

গর্বাচেভ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান করেন এবং বিশ্ব শান্তিকে উন্নীত করেছিলেন। তিনি পূর্ব-পশ্চিমের তীব্র উত্তেজনার সময় পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতেও সহায়তা করেছিলেন। সেই সময় বিশ্বের প্রায় ৪০ হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেড সমৃদ্ধ ছিল এবং মানবজাতির সম্ভাব্য ধ্বংসের কাছাকাছি ছিল বলে সমরবিদরা প্রমাদ গুনতেন। তিনি উভয় পক্ষের পারমাণবিক অস্ত্রাগার হ্রাসের আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন যার ফলে কৌশলগত অস্ত্র সীমাবদ্ধতা আলোচনা ঝঅখঞ এবং ভুল ও যোগাযোগের অভাবের কারণে সৃষ্ট বিপর্যয়ের সম্ভাবনা হ্রাস করার জন্য যাচাইযোগ্য পারস্পরিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

গর্বাচেভকে কি ইতিহাসে শান্তি ও মানব স্বাধীনতার অন্যতম মহান ব্যক্তি হিসেবে স্মরণ করা হবে, নাকি তাকে এমন একজন ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হবে যিনি একটি বিশাল শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করেছেন। যদিও গর্বাচেভ তার শেষ বছরগুলোতে একটি পরিত্যক্ত সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছিলেন, তথাপি তিনি তার বৃদ্ধ বয়সে ইউক্রেনে রাশিয়ান অ্যাডভেঞ্চারের সমালোচনা এবং তিরস্কার করার জন্য তার দৃঢ় প্রত্যয় সাহসিকতার সাথে ধরে রেখেছিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গর্বাচেভ সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্বনেতাদের একজন। তিনি তার স্বদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্যের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তার কারণে পশ্চিমারা বেশি নিরাপদ হয়ে ওঠে। একটি বাইপোলার বিশ্বের এক মেরুর বিচ্ছিন্নতা বিশ্বব্যাপী কৌশলগত পরিবর্তনকে চালিত করে এবং এর প্রভাব শত শত বছর ধরে বিস্তৃত হয় এবং বিভিন্ন দেশ থেকে এটি সম্পর্কে অনুভূতি এবং মূল্যায়ন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে। যদি মানুষ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে যে, নেতাদেরকে কেবল তাদের নিজের দেশের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করা উচিত, তবে মানব ইতিহাসজুড়ে গর্বাচেভের মূল্যায়ন আরো আকর্ষণীয় হতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement