২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পালাবার জায়গাও অবশেষ থাকবে না

- ছবি : সংগৃহীত

গত ২৮ জুলাই ‘বায়োসায়েন্স’ জার্নালে একটি ‘ক্লাইমেট পেপার’ প্রকাশিত হয়েছে। জলবায়ু-বিষয়ক এই গবেষণা প্রবন্ধে মানবজাতির উদ্দেশে বিশ্বের প্রায় ১৪ হাজার বিজ্ঞানীর ভয়াবহ সতর্কবার্তা প্রকাশিত হয়েছে। পেপারটি তৈরি করা হয়েছে ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের নেতৃত্বে। এটি আসলে ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের সম্প্রসারিত ও হালনাগাদ সংস্করণ। ২০১৯ সালের পেপারেই ঘোষণা করা হয়েছিল ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির কথা। তখন গবেষকরা বিশ্লেষণের জন্য বিবেচনায় নিয়েছিলেন ৩১টি চলক তথা ভেরিয়েবল। এগুলোকে প্যারিমিটার বা স্থিতিমাপও বলা হয়। গবেষণার ভিত্তি ছিল তাদের পর্যবেক্ষিত ও মূল্যায়িত পৃথিবী-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলো। সে গবেষণাপত্রে যেসব চলক অন্তর্ভুক্ত করা হয় তার মধ্যে ছিল গ্রিন হাউজ গ্যাস উদগীরণ, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পরিবর্তন, হিমবাহ বরফের ক্ষয়, ঘনবর্ষণ বনাঞ্চল (রেন ফরেস্ট) উজাড় এবং বিভিন্ন আর্থসামাজিক বিষয়াবলি; যেমন- জিডিপি, ফসিল জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ও এমনই আরো কিছু বিষয়।

এই ক্লাইমেট পেপারে এই বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানীর তাৎক্ষণিক তাগিদ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি আমরা। এর ফলে মানবজাতির সামনে যে ধ্বংসযজ্ঞ ওঁৎ পেতে আছে, সে ব্যাপারে চোখ-কান বন্ধ করে থাকার সময় শেষ। সময় এখন গুরুত্বের সাথে জলবায়ু সঙ্কটের বিষয়টিকে আমলে নেয়ার। সম্মিলিতভাবে বিশ্বমানবসমাজের অবশ্য করণীয় হচ্ছে, যাবতীয় জাতীয়তাবাদী সঙ্কীর্ণতা ভুলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে যৌথভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামা। মানুষ যেভাবে তাদের বিবেকহীন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস করে আসছে, তা এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তাই প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। বাড়িয়ে তুলছে মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। মানবজাতির অস্তিত্বও পড়েছে হুমকির মুখে। তাই আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে শতভাগ সচেতনতা নিয়ে ঠেকাতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান প্রবণতা। বিজ্ঞানীদের জোরালো অভিমত, মানুষের হাতে আর বেশি সময় নেই। এই উপলব্ধি নিয়ে সব বিভেদ-বিভাজন ভুলে এ ক্ষেত্রে গোটা মানবজাতিকে একসাথে কাজ করতে হবে।

জাতিসঙ্ঘের ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি) ষষ্ঠ ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্টে মানবজাতির অস্তিত্বের সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। এই রিপোর্ট বিবেচিত হয় জলবায়ু-পরিস্থিতি বিষয়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় মাত্রার ব্যাপকধর্মী প্রতিবেদন হিসাবে। ১৪ হাজার বিজ্ঞানী আট বছর ধরে লাগাতার গবেষণাকর্মের ওপর ভিত্তি করে আইপিসিসির এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এই প্রতিবেদনে মানবজাতির জন্য ভয়াবহ বার্তা উচ্চারণ করা হয়- ‘মানবজাতি জলবায়ু সঙ্কটের কারণে তার অস্তিত্ব নিয়ে শিগগিই ভয়াবহ সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। অতএব, সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ আর আমাদের হাতে নেই।’

আইপিসিসির রিপোর্টে উল্লেøখ করা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওয়ার্মিং মার্ক অতিক্রম করবে। এই রিপোর্টকে জাতিসঙ্ঘ ‘কোড রেড ফর হিউম্যানিটি’ নামে অভিহিত করেছে। এর পরও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস আশাবাদী, বিশ্বনেতারা এবার অন্তত দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওয়ার্ম লিমিট যাতে ছাড়িয়ে না যায়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, আমরা এখন ‘বিপজ্জনক বন্ধের’ খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তিনি বলেন, আমরা যেন আর একটিও কয়লাচালিত কারখানা চালুর কথা না ভাবি। রিপোর্ট মতে, কয়লা ও ফসিল জ্বালানি মানবজাতির কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে পৃথিবী ধ্বংসের অপেক্ষায়।

রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রিন হাউজ গ্যাস উদগীরণের কারণে বিশ্বের কয়েক শ’ কোটি মানুষ এরই মধ্যে হুমকির মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে মানবজাতিই পুরোপুরি দায়ী। রিপোর্টে একবিংশ শতাব্দীর জন্য যথাযথভাবে হালনাগাদ পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে ২০১৩ সালে শেষবার এই কাজটি করা হয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে দু’টি সীমারেখা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। সে মতে, বিশ্বনেতারা তখন সম্মত হয়েছিলেন- তারা সচেষ্ট থাকবেন, যাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২.৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওয়ার্ম লিমিট অতিক্রম না করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ থেকে গত দেড় দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার মাত্রা এরই মধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বা ২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছেছে। সর্বশেষ আইপিসিসি রিপোর্ট বলছে, মানবজাতি জলবায়ু সম্পর্কে যথাসচেতন না হলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যেই দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওয়ার্মিং লিমিট অতিক্রম করবে। তার তখনই মানবজাতির জন্য শুরু হবে চূড়ান্ত বিপর্যয়।

এই রিপোর্টের সহপ্রণেতা ও ইউএস ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমসফরিক রিসার্চ-এর জলবায়ু বিজ্ঞানী লিন্ডা মির্র্নস বলেন, এটি একদম নিশ্চিত, পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। এমন কোনো এলাকা দেখি না, যা এই জলবায়ু সঙ্কট থেকে মুক্ত... দৌড়ে পালাবার মতো কোনো জায়গা নেই। লুকাবারও কোনো জায়গা নেই।

এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বিদ্যমান পরিস্থিতে এমন আশঙ্কাও রয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা একসময় শিল্পপূর্বযুগের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়ে যাওয়ার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তখন তাপপ্রবাহ (হিটওয়েভ) আরো খারাপ পর্যায়ে নেমে যাবে। খরা, বন্যা ও প্রবল বৃষ্টিপাত বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে যাবে। সে ধরনের আলামত বিশ্বের নানা স্থানের খরা, বন্যা ও প্রবল বৃষ্টিপাতের সাম্প্রতিক খবরাখবর থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়। সে বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়: এখন থেকেই কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাসের উদগীরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা নিশ্চিত করা। আইপিসিসির ভাইস চেয়ার ও ‘ইউএস ন্যাশনাল ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর ঊর্ধ্বতন জলবায়ু পরামর্শক কো ব্যারেট বলেন, এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জলবায়ুর সাম্প্রতিক পরিবর্তন খুবই ব্যাপকভিত্তিক; দ্রæত এই পরিবর্তন আরো জোরালো হচ্ছে; হাজার হাজার বছরের পরিবর্তন ঘটছে এখন কয়েক দশকে। এই পরিবর্তন আরো বেশি অনুভ‚ত হবে তাপমাত্রা আরো বেড়ে গেলে।

২৩৪ জন বিজ্ঞানীর প্রণীত তিন হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সতর্কবার্তার তীব্রতা আরো বাড়ছে। কারণ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। সঙ্কুচিত হচ্ছে হিমবাহের বরফ জমার পরিমাণ। তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা, ঝড়, ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় (ট্রপিক্যাল সাইক্লোন) ইত্যাদির তীব্রতাও আরো বাড়ছে। আর্কটিক সাগরেও কমে যাচ্ছে বরফ। ভ‚গর্ভস্থ চিরহিমায়িত অঞ্চলও (ফার্মফ্রস্ট) গলে যাচ্ছে। এসব প্রবণতা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

উদাহরণত রিপোর্টটির মতে- এ ধরনের তাপপ্রবাহ সাধারণত যেখানে ঘটত ৫০ বছরে একবার, এখন দশকে ঘটে একবার। পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি আর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১.৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বেড়ে যায়, এই তাপপ্রবাহ ঘটবে এমনকি প্রতি সাত বছরে দু’বার।

রিপোর্টটির মতে- পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় অনেক স্থানের তাপমাত্রা চরম বেড়ে যাবে। শুধু চরম আবহাওয়া নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ হবে এর যুগপৎ কারণ। লিন্ডা মির্নস বলেন, এমনটিই এখন ঘটছে পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে; সেখানে তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা ও দাবানল একসাথে মিলে এক জটিল পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।

এই সপ্তাহের খবর- জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আমাজানের পর দক্ষিণ আমেরিকার দীর্ঘতম পারানা নদীটি এখন শুকিয়ে যাচ্ছে। আর্জেন্টিনার পারানা নদীর অনেক স্থানেই এখন শুধুই বালুচর। পারানা নদীর এই হাল এর আগে কখনোই দেখেনি সে নদীতীরের মানুষ। এই নদীতে আগে সেকেন্ডে প্রবাহিত হতো ১৭ হাজার ঘনমিটার পানি। এখন তা নেমে গেছে ছয় হাজার ২০০ ঘনমিটারে। এ নদীতে বাণিজ্যিক নৌচলাচল বন্ধ হওয়ার পথে। পানি কমার সাথে সাথে মাছও কমে গেছে। জেলেদের মধ্যে হাহাকার। কোটি কোটি মানুষের সুপেয় পানির উৎস ছিল এ নদী। তা-ও নিঃশেষ হওয়ার পথে। পারানা নদী তীরের বনে আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ তা থেকে দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে। ব্রাজিল থেকে উৎপত্তির পর প্যারাগুয়ে হয়ে আর্জেন্টিনার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে এই নদী। এ নদী চার হাজার ৪৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ। মহাদেশটিতে এর চেয়ে দীর্ঘ নদী কেবল আমাজাননদী। আমাজানের দৈর্ঘ্য সাত হাজার কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ ধ্বংসের প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, পারানা নদীর বর্তমান হাল তারই এক জায়মান উদাহরণ। সম্প্রতি খরার কারণে উত্তর আমেরিকার কলোরাডো নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়াও একই ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ও পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাবের এমনি দৃশ্যমান উদাহরণ অগুনতি। শুধু নদী নয়, সাগর পর্যন্তও শুকিয়ে মরুভ‚মিতে পরিণত হওয়ার উদাহরণও এরই মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।

আইপিসিসির রিপোর্টে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা যেসব ক্ষতির শিকার হচ্ছি, তার মধ্যে আছে- বরফ স্তর গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও সমুদ্রের প্রকৃতি বদলে যাওয়া। সমুদ্রে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে সমুদ্রের পানি ক্রমেই ক্ষারধর্মী (এসিডিক) হয়ে উঠছে। রিপোর্টে উল্লেøখ করা হয়েছে- এই পরিবর্তন ঠেকিয়ে কয়েক শ’ বছরে, এমনকি হাজার বছরেও সমুদ্রকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো ১৫-৩০ সেন্টিমিটার (৬-১২ ইঞ্চি) বেড়ে যাওয়ার সমস্যায় বাঁধা পড়বে আমাদের এই পৃথিবী। বিভিন্ন দেশের বিস্তীর্ণ উপক‚ল অঞ্চল পানির নিচে ডুবে গিয়ে কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতি ঘটবে। পৃথিবীর তেতিয়ে ওঠার জন্য প্রায় সবটুকু দায়ই পড়ে তাপ আটকে রাখার গ্যাস, যেমন- কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেনের ওপর। খুব বেশি হলে এক-দশমাংশ কিংবা বা এক-পঞ্চমাংশ ডিগ্রি তাপ বাড়ার দায়ভার ফেলা যায় সূর্যের মতো প্রাকৃতিক বলের ওপর। বাকিটুকু দায় নিতে হবে মানবজাতিকেই।

রিপোর্টে আরো বলা হয়- আলট্রা-ক্যাটাস্ট্রফিক ডিজাস্টার (অতি-বিপর্যয়কর দুর্যোগ) পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘টিপিং পয়েন্ট’ পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে বরফের স্তর ধ্বংস হয়ে যাবে, সমুদ্রের স্রোত ব্যাপকভাবে এলোপাতাড়ি বাধাগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা কম হলেও, এমনটি যে ঘটবে না- তা নিশ্চিত বলা যাবে না। বহুলালোচিত আটলান্টিক মহাসাগরের স্রোত বন্ধ হয়ে গেলে, জলবায়ু ব্যাপকভাবে পাল্টে যাবে। তবে বর্তমান শতাব্দীতে তেমনটি ঘটবে না বলে মনে করছেন জলবায়ু বিজ্ঞানীরা। হোয়াইট হাউজের ডেপুটি সায়েন্স অ্যাডভাইজার জেইন লুবচেনেকে বলেন, এই রিপোর্ট জরুরি ভিত্তিতে জলবায়ুসম্পর্কিত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়। নতুন পদক্ষেপ হিসেবে বিজ্ঞানীরা জোর তাগিদ দিয়েছেন বায়ুবাহিত মিথেনের মাত্রা কমিয়ে আনার ব্যাপারে। মিথেন একটি ক্ষমতাধর কিন্তু স্বল্পস্থায়ী গ্যাস। এটি এরই মধ্যে রেকর্ড স্তরে উন্নীত হয়েছে। মিথেন গ্যাসের মাত্রা কমিয়ে আনাটা স্বল্পমেয়াদে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠা থামাতে পারে। ১০০টিরও বেশি দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মানবসৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইডের উদগীরণের মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনতে। এর মাধ্যম বিরূপ প্রভাব অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

ক্লাইমেট সায়েন্স পেপারে উল্লেখ করা হয়, পৃথিবীর সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থিতিমাপ তথা প্যারামিটারগুলো গত দুই বছরে আরো খারাপের দিকে গেছে। কারণ ওই সময়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পদক্ষেপের অভাব ছিল। গবেষকরা জানতে পেরেছেন, তাদের বিশ্লেষণের জন্য বিবেচ্য ৩১টি প্যারামিটারের মধ্যে ১৮টি প্যারামিটার হয় রেকর্ড পরিমাণে উঁচুতে পৌঁছেছে, নয়তো রেকর্ড পরিমাণে নিচে নেমেছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের অবাধ ব্যবহার এখন সর্বকালের হাইমার্কে পৌঁছেছে। হিমবাহ বরফের স্তরের পুরুত্ব পরিমাপ করা শুরু হয় ৭১ বছর আগে। বরফস্তরের পুরুত্ব এই সময়ের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। উল্লেখ্য, গ্রিনহাউজ গ্যাসের উদ্গিরণ মাত্রা ছাড়িয়েছে সেই ২০১৯ সালেই। তবে ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে স্বল্প সময়ের জন্য এই উদগীরণ ব্যাপক কমে গিয়েছিল। কিন্তু তা জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরো খারাপ হয়ে যাওয়া খুব একটা থামাতে পারেনি।

সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ‘নেচার’ পত্রিকায়। এতে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন, পৃথিবী টিপিং পয়েন্টের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতে, আমাজন বনাঞ্চল শিগগিরই ‘কার্বন সিঙ্ক’ থেকে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে ‘কার্বন সোর্সে’। অনেকের মতে, তা এরই মধ্যে পরিণত হয়েছে একটি কার্বন সোর্সে। এই গবেষণা প্রবন্ধের লেখকদের অভিমত সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একটা সিদ্ধান্তই দাবি করে : এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে বৈশ্বিক পদক্ষেপের ওপর। এই লেখকরা অবশ্য সূত্রায়ন করেছেন একটি ‘ত্রিমুখী নিকট-মেয়াদি নীতি-পদক্ষেপ’ : জ্বালানি ও অর্থনীতর ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে হবে উল্লেখযোগ্য কার্বনমূল্য; ফসিল জ্বালানি নিষিদ্ধ করতে হবে; কঠোরভাবে প্রাকৃতিক কার্বন সিঙ্ক পুনরুদ্ধার করে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে বিশ্বব্যাপী গড়ে তুলতে হবে কৌশলগত ক্লাইমেট রিজার্ভ। তাদের এই নীতি সূত্রায়ন নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্কট উত্তরণে বৈশ্বিক করণীয় নির্ধারণে জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক প্যানেল তৈরি করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্যানেলই বাতলে দেবে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, যার বাস্তবায়ন করবে বিশ্বের প্রতিটি দেশ। তবেই যদি মানবজাতি জলবায়ু সঙ্কট থেকে মুক্তি পায়। নইলে দুর্ভোগ দুয়ারে দাঁড়িয়ে। তখন কারো পালাবার জায়গাও অবশেষ থাকবে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক; কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement