আজকের নিবন্ধের শিরোনাম লিখতে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় তিনটি শব্দ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যাই। শিরোনামের যেখানে ‘রংমহল’ শব্দটি ব্যবহার করেছি সেখানে কি ‘হারেম’ বসালে বেশি অর্থবহ হবে নাকি ‘বাইজিমহল’ বসালে সঠিক হবে তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ- খুব ভালো করেই জানি হারেম শব্দের তাৎপর্য কী এবং বাইজিমহল কাকে বলে। অন্য দিকে, রংমহল বলতে যা বুঝায় তার সঙ্গেও হালআমলের কথিত ভদ্রপল্লীতে স্থাপিত মিনি পতিতালয়ের তেমন কোনো মিল নেই। এখনকার দিনে যেভাবে তথাকথিত মডেল-অভিনেত্রী অথবা বিভিন্ন বয়সের সুন্দরীরা চরিত্রহীন দুর্নীতিবাজ বিকৃত মানসিকতার ধনাঢ্য পুরুষদের লালসা মেটায় এবং যেভাবে তারা একই অঙ্গে রক্ষিতা-বাইজি-বারবনিতা এবং মাদক সম্রাজ্ঞীর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তা কোনো দেশের ইতিহাসে দেখা যায় না।
আগেকার দিনের ‘হারেম’ বলতে বৈধ ক্ষমতাবান এবং ঐশ্বর্যশালী শাসক রাজা-বাদশাহ-নবাব বা সম্রাটগণের রাজকীয় প্রাসাদ বা সরকারি বাসভবনের সেই অংশকে বোঝাত যেখানে রমণীরা বাস করতেন। আগেকার দিনের হারেমকে অনেকে জেনানা মহলও বলতেন। আজকের দিনের হোয়াইট হাউজ, বাকিংহাম প্যালেস, এলিসি প্রাসাদ অথবা গণভবন, বঙ্গভবনের বাসিন্দাদের যে নিরাপত্তা-সম্মান রয়েছে এবং সেখানে যেসব নিয়মকানুন মানা হয় তার চেয়েও সম্মান ও মর্যাদা লাভের পাশাপাশি, হারেমের বাসিন্দাদেরকে কঠোর নিয়মকানুন মান্য করতে হতো। মধ্যযুগের রাজপ্রাসাদগুলোতে যে নিয়মকানুন ছিল তাতে রাজা স্বয়ং এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে সিংহাসনের মনোনীত যুবরাজই কেবল হারেমে প্রবেশ করতে পারতেন। এর বাইরে কোনো পুরুষ সেখানে উঁকি দেয়ার সাহসও করত না।
হারেমের কর্তৃত্ব যার বা এটা যিনি পরিচালনা করতেন তার উপাধি ছিল মালেকা ই আলিয়া। এই পদটি সাধারণত রাজা-বাদশাহ-সম্রাটের মা অথবা সরকারিভাবে ঘোষিত প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত ছিল, যা ইদানীংকালের সাংবিধানিক আইনের মতো তৎকালীন জমানার সর্বোচ্চ আইন দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। স্বয়ং রাজা তো দূরের কথা- ভিনদেশী আক্রমণকারী কোনো সভ্য রাজা যদি কোনো নতুন রাজধানী দখল করতেন সে ক্ষেত্রে তিনিও হারেমের আইন লঙ্ঘন করতেন না। এভাবেই মধ্যযুগের হাজার বছরের ইতিহাসে রাজদরবার বা রয়্যাল কোর্টের মতো হারেমেও নির্ধারিত আইনের অধীনে চলত। একটির পরিচালক ছিলেন সম্রাট আর অন্যটির পরিচালক হতেন সম্রাজ্ঞী। সুতরাং হারেমের সঙ্গে বাইজী মহল-রংমহল বা মিনি পতিতালয়ের মিল খোঁজা যে কতবড় অজ্ঞতা তা ইতিহাসের ছাত্ররা খুব ভালো করে জানেন। বাইজিমহল নিয়ে আলোচনার আগে একটি কথা বলা অবশ্যক যে, মধ্যযুগের রাজা বাদশাহরা ঐতিহ্যগতভাবে বাইজিমহল বা রংমহলে যেতে পারতেন না। তখন অবশ্য এগুলো ছিল না। রাজার বিনোদনের জন্য যদি কোনো নাচ-গান বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো তবে তা দিনে বা রাতে প্রকাশ্য রাজদরবারে অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে রাজপরিবারের সদস্যরা ছাড়াও আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত থাকতেন। রাজা যদি সুরা বা মদ অথবা আফিমের নেশায় আসক্ত হতেন তবে তিনি তার খাস কামরায় বসে নির্ধারিত সময়ে তা গ্রহণ করতেন এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কোনো রাজকর্মে অংশ নিতেন না। তার দাম্পত্য সম্পর্ক অথবা যৌনকর্মও খাস কামরায় হতো। সে ক্ষেত্রে তার ইচ্ছায় বিবিরা-উপপত্নীরা অথবা দাসীরা বিধিমোতাবেক খাস কামরায় হাজির হতেন। রাজপ্রাসাদের নিয়ম মতে- শাসক তার খাস কামরায় বসে মহিলাদের সামনে মদ্যপান করতেন না এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঘনিষ্ঠ মেলামেশা করতেন না।
রাজপ্রাসাদ এবং হারেম সম্পর্কে উল্লিখিত বিধিবদ্ধ নিয়ম এবং প্রথা যেসব রাজপরিবারে কঠোরভাবে মানা হতো তারাই যুগ যুগ ধরে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শাসনকর্মে টিকে থাকত। কোনো অবিবেচক এবং চরিত্রহীন যদি সিংহাসনে বসে হারেমের আইন ভঙ্গ করত; তবে তারা হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে খুন হতো অথবা বহিঃশত্রু দ্বারা অচিরেই ক্ষমতাচ্যুত হতো। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে গেলে আজকের নিবন্ধের পরিধি অনেক বড় হয়ে যাবে। তাই ওদিকে না গিয়ে বাইজিমহল সম্পর্কে কিছু বলি।
বাইজিমহলের ধারণা শুরু হয় মূলত ইংরেজ আমলে ১৭৫৭ সালের পর থেকে। যখন ভারতবর্ষে দিল্লিকেন্দ্রিক কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে বা ভেঙে পড়ে তখন ইংরেজদের মদদে বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় থেকে অসংখ্য ছোট বড় জমিদার-জায়গিরদার-নবাব-রাজা-খান বাহাদুর-রায় বাহাদুর পদ-পদবি সৃষ্টি করা হয় যাদের বিরাট অংশ ছিল লোভী স্বার্থপর-দুর্নীতিবাজ নিষ্ঠুর। তারা ছিল বিকৃত মানসিকতার দেশবিরোধী তথা মানবতাবিরোধী মনমানসিকতায় আক্রান্ত।
উল্লিখিত শ্রেণীটি তাদের বিকৃত যৌনলালসা চরিতার্থ করার জন্য বাইজিমহল তৈরি করেছিল। দেশ বিদেশের সুন্দরী গায়িকা-নর্তকী যারা টাকার বিনিময়ে নাচগানের পাশাপাশি দুর্নীতিপরায়ণদের বিকৃত যৌনলালসা পূরণ করত, তারা বাইজিমহলে এসে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপকর্ম চালাত। বাইজিমহলের মালিক বা অর্থ জোগানদাতা নিজে অপকর্ম করত এবং সঙ্গী সাথীদের নিয়ে নিকৃষ্ট পশুদের মতো একসঙ্গে কুকর্ম করত। এই ধরনের মহলে সাধারণত কোনো স্থায়ী বাইজি থাকত না। তাদের ভাড়া করে আনা হতো। আবার তারা চলে গেলে মহলটি খালি থাকত।
বাইজিমহল ছাড়াও চরিত্রহীন পুরুষরা রক্ষিতা পুষত। তবে ওরা বারবনিতা ছিল না। তারা প্রভাবশালী ব্যক্তির যৌনদাসীরূপে গণ্য হতো। রক্ষিতাদের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী কামুক পুরুষের বৈধ স্ত্রী, পিতা-মাতা বা সন্তানরা সবকিছু জানত। কিন্তু তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় এটা নিয়ে তারা মাথা ঘামাত না। কারণ রক্ষিতা এবং তার গর্ভজাত সন্তানদের কেনো সামাজিক মর্যাদা বা আইনগত স্বীকৃতি না থাকায় তারা কোনো অবস্থাতেই সম্পত্তির ওয়ারিশ হতে পারত না। রক্ষিতার বাইরে কামুক পুরুষেরা গণিকালয় বা বেশ্যালয়ে গমন করত। ইংরেজ আমলে সাধারণ মানুষের জন্য যেমন সাধারণ গণিকালয় ছিল তদ্রূপ ভিআইপি সিআইপিদের জন্য ‘অভিজাত’ গণিকালয়ও ছিল। হিন্দি ছবি ওমরাওজানের চিত্রনাট্যে একটি সাধারণ গণিকালয়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অন্য দিকে ‘পাকিজা’ সিনেমায় যে গণিকালয়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেটিকে এক অর্থে রংমহল বা ধনিক সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত ‘অভিজাত’ বাইজিমহল বলে আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
ইংরেজ আমলের সাধারণ গণিকালয়ে যারা কাজ করত তাদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী গায়িকা বা অভিনেত্রী ছিলেন। এদের যোগ্যতা জীবনযাত্রা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের রূপরেখা বোঝার জন্য আপনারা ইচ্ছে করলে ওমরাওজান সিনেমাটি দেখতে পারেন। বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী রেখা এই সিনেমার নাম ভূমিকায় যে অভিনয় করেছেন তা কেবল ভারতীয় চলচ্চিত্র নয়- বিশ্ব চলচ্চিত্রের মাইলফলকে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক কামাল আমরোহী পরিচালিত ‘পাকিজা’ সিনেমায় বলিউডের ট্র্যাজেডি কুইনখ্যাত মীনা কুমারী যেভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের উঁচুতলার মানুষদের যৌনাচরণ ও মনমানসিকতা এবং বাইজিদের অবস্থা তুলে ধরেছেন তাও বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে।
উল্লিখিত ইতিহাসের সঙ্গে কলিকালের অর্থাৎ হাল আমলের বাংলাদেশের বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন দুর্নীতিবাজ আমলা-কামলা, অবৈধ অর্থের মালিক ব্যবসায়ী এবং ভোট চরিত্রে ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন’ দুর্বৃত্ত প্রকৃতির তথাকথিত ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ, ক্ষমতার আবর্জনা লেহনকারী নামধারী সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার পালের গোদারা যেভাবে কাম ক্রোধ লালসা নেশা দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে দিনের বেলায় সাধারণ মানুষের জীবনে নরক যন্ত্রণা দিতে থাকে, তেমনি রাতের আঁধারে নিজ পরিবারের আপনজনদের নরককুণ্ডে নিক্ষেপ করে নিজেরা নিজেদের তৈরি করা নরকে গিয়ে স্বর্গের সন্ধান করে এবং মদ মেয়ে নৃত্যগীত ইত্যাদির মাধ্যমে জাহান্নামের কীটে পরিণত হয়।
রাজধানীর নব্য ধনীদের এলাকা হিসেবে পরিচিত প্রাসাদসম অট্টালিকাগুলো অথবা পাঁচতারা হোটেলে কিংবা তথাকথিত ক্লাব-রিসোর্ট বা বারে প্রতি রাতে এ যুগের মক্ষীরাণীরা যে মধুকুঞ্জ সাজায় এবং রং-বেরঙের জলসার আয়োজন করে সেসবের সাথে হাজার বছরের পুরনো গণিকালয়ের কার্যক্রম কিংবা ইংরেজ আমলের বাইজিমহলের তুলনা করা চলে না। এ যুগের মক্ষীরাণীরা তাদের মধুকুঞ্জে বসে যেভাবে অস্ত্র-মাদক-নিয়োগ-বদলি-টেন্ডার বাণিজ্য থেকে শুরু করে অপরাধ জগতের খুনখারাবি-চাঁদাবাজি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোর সাথে পৃথিবীর কোনো মাফিয়াতন্ত্রের তুলনা চলে না।
আমরা মারিয়ো পুজোর বিখ্যাত ‘গডফাদার’ উপন্যাসে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের ক্ষমতা-বিত্ত-বৈভব সম্পর্কে যে কল্পিত চিত্রের সন্ধান পাই তা বর্তমানকালের ঢাকার মক্ষীরাণীদের তুলনায় নেহাত নস্যি বা তেজপাতাসম। অন্য দিকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র জিরো জিরো সেভেন সিরিজের জেমস বন্ড ছায়াছবিতে নারী-নেশা ও জুয়াসংক্রান্ত যেসব ভয়াবহ এবং রোমাঞ্চকর দৃশ্য-প্রদর্শিত হয় তা এখনকার ঢাকার বাস্তব দৃশ্যের ভয়াবহতা ও নিকৃষ্টতার সাথে তুলনীয় নয়। জেমস বন্ডের পরিচালক যদি জানতেন যে ঢাকার মক্ষীরাণীরা আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালানের মতো ভয়ঙ্কর কর্মের পাশাপাশি গরুর পশ্চাৎদেশের মধ্যে ইয়াবা ঢুকিয়ে সেই ইয়াবা সীমান্তের অপর পার থেকে নিয়ে আসে এবং একই প্রক্রিয়ায় সারা দেশে বিক্রয় ও বিপণন করে থাকে, তবে চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তিনি ঢাকায় চলে আসতেন।
জেমস বন্ড চলচ্চিত্রের পরিচালক যদি কোনো মধুকুঞ্জের বাস্তব অবস্থা দেখার জন্য মক্ষীরাণীদের আবাসে যেতেন এবং দেখতে পেতেন বড় বড় পদ-পদবির দুর্নীতিবাজ-ভুঁড়িওয়ালাদের উলঙ্গ নৃত্য এবং বিদেশী মদের নেশাকে চাঙ্গা করার জন্য, মধ্যরাতে হঠাৎ জীবন্ত গো বৎস বা গো কন্যাকে হাজির করে সেটির পশ্চাৎদেশ থেকে গোবরযুক্ত গরম গরম ইয়াবা বের করে পরিবেশন করা হচ্ছে এবং ইয়াবা সেবনের পর মদ-কাম-নৃত্য কিভাবে ত্রিমাত্রিক রসায়ন সৃষ্টি করে তা চাক্ষুষ করার পর তিনি নির্ঘাত আত্মহত্যা করতেন। মরার আগে ফুটনোট হিসেবে লিখে যেতেন- ঢাকার মধুকুঞ্জের অভিজ্ঞতা ছাড়া আমি জেমস বন্ড বানিয়ে বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের বঞ্চিত করার অনুশোচনায় আত্মহত্যা করলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা