১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলকদ ১৪৪৫
`


আমার শিক্ষকের স্পর্ধা এবং লালুর সমুচা প্রসঙ্গ

-

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতে গেলাম তার কর্মক্ষেত্র বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য ছিল স্যারের দোয়া চাওয়া এবং পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের নমিনেশনপ্রাপ্তির বিষয়ে তার কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে কি না, সেটির খোঁজখবর নেয়া। স্যার যখন শুনলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে বেশ সফলতা অর্জন করেছি তখন ভারি খুশি হলেন। কিন্তু যখন শুনলেন, আমি রাজনীতি করি এবং আগামী নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়নের জন্য লড়াই সংগ্রাম করছি, তখন তিনি হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন- দেখি তো বাবা! তোমার হাত দু’খানা একটু দেখাও তো- হাতের দাগগুলো কী অবস্থায় রয়েছে তা একটু পরখ করে দেখি। স্যারের বহু গুণ সম্পর্কে আমার একধরনের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল; কিন্তু তিনি হস্তরেখা বিশারদ হতে পারেন এবং জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করেন অমন চিন্তা কোনো দিন মাথায় আসেনি। তাই স্যারের কথায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম এবং একধরনের লজ্জা-ভয়-সঙ্কোচ ও আশা নিয়ে অনুগত ছাত্রের মতো হাত দুখানি তার সামনে মেলে ধরলাম। তিনি বাঁকা চোখে আমার হস্তদ্বয়ের রেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, সর্বনাশ! কিসের রাজনীতি করছ? তোমার রেখাগুলো তো দিবালোকের মতো চকচক করছে এবং খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সুতরাং তোমার দ্বারা কোনো রাজনীতি হবে না, বাপু। রাজনীতিতে সফল হতে হলে চামচাগিরি লাগবে এবং চামচাগিরি করতে হলে নেতার সামনে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ দু’হাত কচলাতে হবে। যখন দেখবে হাত কচলাতে কচলাতে হাতের রেখাগুলো বিলীন হয়ে গেছে তখন বুঝবে যে, তোমার দ্বারা সম্ভবত কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

স্যারের সঙ্গে আমার সে সাক্ষাৎ ঘটেছিল ২০০১ সালের দিকে। আজ দুই দশক পরে যখন দেখি, আমার হাতের রেখাগুলো বিলীন না হয়ে আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তখন নিজের রাজনৈতিক সফলতা যে কোন পর্যায়ে রয়েছে তা আমার মতো আপনারাও হয়তো বুঝতে পারছেন। এতদিন পর স্যারের কথা মনে পড়ল; কারণ মূলত সাম্প্রতিক রাজনীতির বেহাল অবস্থা, প্রশাসনে সীমাহীন অস্থিরতা, অযোগ্যতার দৌরাত্ম্য ও করোনার টিকা নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীর কারসাজি এবং উল্লম্ফন নিয়ে প্রতিদিন যেসব দৃশ্য দেখতে হয় তার বেদনা থেকে বাঁচার জন্য হররোজ যেসব প্রেরণামূলক ভিডিও দেখি সেগুলোর মধ্যে স্যারের বিভিন্ন ভিডিও অন্যতম এবং এমনি একটি ভিডিওর বক্তব্য শোনার পর আজকের নিবন্ধটি লিখার কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।

যে ভিডিওটি নিয়ে আলোচনা করব সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরো দুই একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ এবং ভারতের বিহার রাজ্যের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা লালু প্রসাদ যাদবের বিভিন্ন বক্তব্যেও আমি নিদারুণভাবে অনুপ্রাণিত হই। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো তারাও অভিনব স্যাটায়ার, তির্যক ব্যঙ্গ এবং আত্মসমালোচনার মাধ্যমে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা শুনে স্বল্পবুদ্ধির অনুভূতিহীন চটুল স্বভাবের লোকজন হেসে গড়াগড়ি দিতে থাকে। অন্য দিকে বোধসম্পন্ন মানুষ তাদের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের পর লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকেন। দুটো উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আজ থেকে প্রায় দেড় যুগ আগে লালু প্রসাদ যাদব বিবিসি ইন্ডিয়াকে একটি নাতিদীর্ঘ চাঞ্চল্যকর সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। বিবিসির আলোচিত সাংবাদিক করন থাপার যখন জিজ্ঞাসা করলেন- বিহারের রাজনীতিতে আপনি কতদিন টিকতে পারবেন? লালু জবাব দিলেন- বিহারের জনগণ যত দিন সমুচার মধ্যে এখনকার মতো আলু ঢুকিয়ে গরম তেলে ভাজি করে খেতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত বিহারের রাজনীতিতে লালু থাকবে। তার এই বক্তব্য শোনার পর চৌকস সাংবাদিক করন লা জবাব হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন- লালু রসিকতার ছলে তার গালে কতটা সজোরে চপেটাঘাত করলেন। লালুর সেই চমুচা-তত্ত্বের সাথে যদি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের গর্বের ধন চা-সিঙ্গারা-সমুচাতত্ত্ব পর্যালোচনা করি তবে রসিকতা এবং নির্বুদ্ধিতার প্রতিযোগিতা হাল আমলে কোথায় এসে ঠেকেছে তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারব।

এবার রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের রসিকতা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা এখন ভাইরালরূপে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে। বেশির ভাগ বক্তব্যই অত্যন্ত রসালো এবং অতীব সূ² ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে অলঙ্কৃত। ফলে তার সেসব বক্তব্য শুনে উপস্থিত ছাত্রছাত্রী কিংবা শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী যেভাবে হেসে গড়াগড়ি দিয়েছেন তদ্রুপ কোটি কোটি ইউটিউব বা ফেসবুক দর্শকও অনবরত হেসেই চলেছেন। কিন্তু খুব অল্প লোকই রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের অন্তরালে যে বাস্তব সত্যগুলো লুকায়িত রয়েছে সেগুলো খোঁজার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রপতির ভাষণগুলোর মধ্যে একটি ভাষণের কিছু বক্তব্য আপনাদের শুনালে আপনারা সহজেই বুঝতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি হাস্যরসের অন্তরালে কতবড় চাপা কান্নার ইতিকথা সন্নিবেশিত করেছেন।

রাষ্ট্রপতি তার একটি বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত পাওয়ার পর থেকেই তার বুকের মধ্যে একধরনের ভয়ের কম্পন শুরু হয়ে যায়। কারণ তিনি ভেবে পান না- কেন তাকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয় যেখানে ছাত্রজীবনে শত চেষ্টা করেও যিনি ভর্তি হতে পারেননি। অনেক পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করা রাষ্ট্রপতি দেশের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জ্ঞান-গুণী ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে কী বলবেন এসব চিন্তায় তার পেরেশানি বেড়ে যায়। তার সচিব তাকে যে বক্তব্য লিখে দেন তা পড়তে যেমন তার ভালো লাগে না তদ্রুপ তার বিশ্বাস- রাষ্ট্রপতির দফতরের লিখিত বক্তব্য সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীদেরও ভালো লাগে না। তাই তিনি তোতা পাখির মতো গড় গড় করে লিখিত বক্তব্য পাঠ করার পর নিজের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে যখন ব্যঙ্গ কৌতুক করেন তখন উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা আনন্দে ফেটে পড়েন।

আপনারা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিশ্লেষণ করেন তবে বুঝবেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কটাক্ষ করে বলেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির কেবল পদ-পদবি থাকলে হবে না, তার জ্ঞানগরিমা হতে হবে শিক্ষকদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন। অতীতকালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হতো তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ খুঁজে খুঁজে শ্রেষ্ঠতর জ্ঞানী-গুণীকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের প্রধান মেহমান বানাতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে সব কিছুতে যখন ঘুণ পোকার আক্রমণ শুরু হয় তখন সাবেক প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এবং ক্ষমতা পদ-পদবি ও রাজনীতি দ্বারা প্রলুব্ধ ও প্রভাবিত হতে থাকে যার ইঙ্গিত রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যের মাঝে লুকিয়ে রেখেছেন।

আমরা আজকের আলোচনার একদম প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার একবার বুয়েট তথা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রছাত্রীদের একটি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি কৌতুক করে বলতে আরম্ভ করলেন যে, বুয়েট হলো, দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের একটি প্রতিষ্ঠান। দেশসেরা ছাত্রছাত্রীরা সবার আগে চেষ্টা করে বুয়েটে ভর্তি হওয়ার জন্য। যারা পারে না তারা মেডিক্যাল ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করে এবং সেখানেও যারা ব্যর্থ হয় তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা চান্স পায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাহীনরাই বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে থাকে। আমি সেই বাংলা বিভাগের একজন ছাত্র ছিলাম এবং কর্মজীবনে অন্য কোনো কিছু করতে না পেরে সারা জীবন শুধু বাংলাই পড়িয়েছি।

স্যার এরপর বলেন, আজ বুয়েটের এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য দিতে গিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছে- কেন আমাকে এখানে দাওয়াত করা হলো? দেশের একি অধঃপতন শুরু হলো- দেশের সবচেয়ে মেধাবী লোকদের সামনে বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সবচেয়ে কম মেধাবী একজন মানুষকে। দেশে কি মেধার এত অকাল পড়েছে যে, আমাকেই বক্তব্য দিতে হবে! আগেকার জমানা হলে হয়তো এমন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে সাহস পেতাম না। কিন্তু একটি কারণে ইদানীংকালে আমার স্পর্ধা বেড়ে গেছে। একদিন সচিবালয়ে গিয়েছিলাম এবং সেখানে গিয়ে সে দৃশ্য দেখলাম যার প্রভাবে আমি এখন অনেক কিছু বলার স্পর্ধা দেখাতে পারি। আমার এখন মনে হয়- ও যদি পারে তবে আমি কেনো পারব না? সচিবালয়ের যে দৃশ্যের কথা বলছি সেখানে দেখলাম, সবচেয়ে বড় চেয়ারটিতে একজন বসে আছে এবং তাকে ঘিরে অনেক লোক তটস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে বসে নিবিষ্টচিত্তে হা করে বড় চেয়ারওয়ালার কথা শুনছে। সেখানে যারা সে দিন উপস্থিত ছিল আমি তাদের সবাইকে চিনতাম ও আমার জানা মতে বড় চেয়ারে বসা লোকটি ছিল উপস্থিত সবার চেয়ে মেধাহীন এবং অযোগ্য। সুতরাং এতগুলো মেধাবী লোকের সামনে একজন গর্দভ প্রকৃতির চেয়ারধারী যদি বকবক করতে পারে এবং সবাই যদি তা আবার মনোযোগসহকারে শোনে তবে আমি কেনো পারব না? আসলে সে দিনের সেই দৃশ্য দেখার পর আমার স্পর্ধা অনেক বেড়ে গেছে!

স্যারের কথা শুনে উপস্থিত লোকজন বেজায় হেসেছিলেন। কিন্তু স্যার স্যাটায়ার করতে গিয়ে তার সে দিনের বক্তব্যে যা ইঙ্গিত করেছেন তা মূলত আজকের সমাজের নির্মম বাস্তবতা। ইদানীং আমাদের পরিবার, সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রে যারা উঁচু গলায় কথা বলেন এবং যারা মথা নিচু করে সেসব কোকিলরূপী কাকদের কর্কশ কথাবার্তা শোনেন এবং মান্য করতে বাধ্য হন তা যদি মনুষ্য সমাজের পরিবর্তে গহিন অরণ্য দুর্গম পাহাড় কিংবা ঊষর সাহারা মরুভ‚মিতে বসবাসরত অন্য কোনো প্রাণী বা কীট-পতঙ্গের বেলায় ঘটত তাহলে সেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটত। অর্থাৎ অরণ্যে যদি বাঘ-সিংহদেরকে জড়ো করে শুয়োর-সজারু বা শিয়াল বক্তৃতা দিত তবে পুরো অরণ্য মুহূর্তে মরুভ‚মিতে পরিণত হতো। অন্য দিকে মরুভ‚মির দুরন্ত চিতা, উট কিংবা ঘোড়ার সমাবেশে যদি ভেড়া বক্তব্য দিত তবে মরুভ‚মিতে মুহূর্তের মধ্যে বরফের রাজ্য সৃষ্টি হয়ে যেত। একইভাবে বরফের দেশের মেরু ভাল্লুকের সামনে যদি ছাগল এসে নির্দেশ জারি করত তাহলে সেখানকার সব বরফ উড়ে যেত এবং ভূ-অভ্যন্তরের গলিত লাভা বের হয়ে এসে পুরো অঞ্চলে কিয়ামত ঘটিয়ে দিত।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement