২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সবকিছু ছাড়িয়ে আবার করোনা

-

প্রতিবেশী ভারতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি নেমে এসেছে। গত বছর ইউরোপ ও আমেরিকায় ঠিক এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। বিশেষ করে ইউরোপের ইতালি ফ্রান্স ও স্পেনে হাসপাতালগুলো করোনা রোগী সামাল দিতে পারেনি। তাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নিতান্ত অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যবিধি লকডাউন কিছুতেই কিছু হয়নি। ভারতেও তখন করোনা সংক্রমণ ঘটেছে। সংক্রমণের গতি ও মৃত্যুহার দুটোই ইউরোপের তুলনায় অনেক কম ছিল। এটা ভারতের জন্য ছিল স্বস্তির কারণ। ২০২১ সালে এপ্রিলে এসে বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। করোনার থাবা প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করেছে ভারতে। গত বছর রাজধানী দিল্লিতে জরিপ চালিয়ে দেখা গিয়েছিল, বেশির ভাগ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। কারো কারো দেহে করোনার সংক্রমণ রোগ হিসেবে প্রকাশ করলেও সেটা অনেক কমসংখ্যক মানুষের জন্য ভয়াবহ হয়েছে কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়েছে। এখন সেই দিল্লির হাসপাতালগুলো রোগীদের জায়গা দিতে পারছে না। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে বেশুমার। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য রাজ্যের প্রতি সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন।

মহারাষ্ট্রের সাশন জেনারেল হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ভারতের করোনা কতটা ভয়ঙ্কর আঘাত হেনেছে সারা বিশ্বের কাছে সে ব্যাপারে এক বার্তা পাঠিয়েছে। সম্ভবত বার্তাটি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি। সেখান থেকে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ডা: প্রদীপ সিনহা ইংরেজি ওয়ার্নিং শব্দটি দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেছেন। তিনি লিখেছেন, কোভিড-১৯ এর নতুন ধরনটি সংক্রমিত ব্যক্তির নাক থেকে নেয়া নমুনা পরীক্ষায় ভুয়া নেতিবাচক ফল দেখাচ্ছে। এটি এখন সরাসরি ফুসফুসে আক্রমণ করছে। আক্রান্তের শরীরে জ্বর কিংবা কফের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শরীর দুর্বল অনুভব হচ্ছে, ক্ষুধামন্দা হচ্ছে, প্রাথমিক অবস্থা থেকে মাত্র ৮-১০ ঘণ্টার ব্যবধানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যাচ্ছে রোগী। গত বছর যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন তারা নুতন করে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। তারা করোনার কোনো নতুন মিউটেশনে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর হার বেশি হচ্ছে।

ডা: প্রদীপ আরো লিখেছেন, আমরা সারা ভারত থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, বিপর্যয়কর। আমরা আশঙ্কা করছি, পাকিস্তান আফগানিস্তান ও বাংলাদেশেও অচিরেই ভারতের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে যাচ্ছে। ছোট ছোট শহর, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আমাদের সহকর্মীরা বলছে, এটা এমন এক যুদ্ধ, যাতে আমরা হেরে গেছি। এখন এর ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করা যায়, যতটা সম্ভব মানুষের জীবন বাঁচানো যায়। আমরা ৪৪০টির বেশি শিশুর মৃত্যু দেখেছি মাত্র ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে। প্রাথমিকভাবে তাদের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের অক্সিজেন লেবেল পড়ে গেল আর তারা মারা গেল। আমরা এমন কিছু রোগী দেখলাম যারা বিদেশ থেকে মুম্বাইতে এসেছে। যারা আগেই টিকা নিয়েছিলেন। দেখা গেল, মুম্বাইতে আক্রান্ত হওয়ার পর মারা গেলেন। বিদেশফেরত এই ধরনের অন্তত ২৮ টিকা পাওয়া লোকের মধ্যে ১৭ জনকে মারা যেতে দেখা গেল।

শেষে তিনি মন্তব্য করেছেন, সরকারি বেসরকারি উভয় স্বাস্থ্য খাত ভারতে ভেঙে পড়েছে। ধনী, মধ্যবিত্ত, গরিব সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন এবং দ্রুত অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে এ ভাইরাস। এটা প্রত্যেকের জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতাসঙ্কেত। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্য। প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশ যাদের স্বাস্থ্যসেবা দুর্বল দয়া করে লিখে নিন যে এটা আমাদের সামর্থ্যরে বাইরে। এখন আসুন সবাই আমরা এর সংক্রমণ রোধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিই।

একটি ভাইরাসের কাছে কিভাবে মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে সেই চিত্র ফুটে উঠেছে এই ডাক্তারের ভাষ্যে। তিনি অগ্রিম প্রস্তুতির অভাব, দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে বেশি দায়ী করেননি। তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন, মানুষ অদৃশ্য একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের কাছে স্রেফ নস্যি। টিকাও যে কোনো কাজে আসেনি সেই উদাহরণও তিনি দিয়েছেন।

দেশটিতে দিনে সাড়ে তিন লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যু প্রতিদিন তিন হাজারের ওপরে। আমরা যদি প্রতিদিন মানুষের স্বাভাবিক গড় মৃত্যু দেখি তাহলে এই পরিসংখ্যান হয়তো খুব বড় কিছু নয়। বড় ব্যাপার হচ্ছে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। অক্সিজেনের অভাবে তড়পাতে তড়পাতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। চিকিৎসা পেতে মানুষ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছে। অবশেষে রাস্তায় ছটফট করতে করতে মরে যাচ্ছে। তার চেয়েও বড় ভীতিকর পরিস্থিতি। চিকিৎসা না পাওয়ার ভীতি, অক্সিজেন না পাওয়ার ভীতি।

ধনীদের একটা অংশ ভারত ছেড়ে পালাচ্ছেন। প্রাইভেট জেটে যাচ্ছেন অনেকে। অনেকে গ্রুপ করে বিমান ভাড়া করে যাচ্ছেন। এজন্য তারা উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে কার্পণ্য করছেন না। তাদের লক্ষ্য সহজে দুবাই পৌঁছা। যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশেও তারা পালিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ভারত ছেড়ে যাওয়া মানুষের পরিসংখ্যান দিয়েছে বিজনেস ইনসাইডার। কত টাকা খরচ হচ্ছে সেটাও উল্লেখ করেছে। কিন্তু এভাবে পালানো স্থায়ী সমাধান নয়। মৃত্যু সুরক্ষিত কেল্লাতেও হাজির হতে পারে।

ডাক্তার প্রদীপের হুঁশিয়ারি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশেও গত বছর করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ইউরোপ, আমেরিকার তুলনায় একেবারে কম ছিল। আমরা স্বস্তি বোধ করেছি যে, করোনা আমাদের দেশে ভয়াবহ হবে না। কিন্তু চলতি বছর করোনার সংক্রমণের হার ও মৃত্যু দুটোই বেড়েছে। পরিস্থিতি যেকোনো সময় ভারতের মতো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। ভারতের জন্য সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। সৌদি আরব জাহাজে করে ৮০ টন অক্সিজেন পাঠিয়েছে। বড় দুর্যোগ মোকাবেলায় ধনী দেশগুলোর সাথে ভারত বাংলাদেশের পার্থক্য আছে। যুক্তরাষ্ট্রে তিন কোটি ২৮ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের জরুরি চিকিৎসা দেয়ার জন্য দেশটিকে অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয়নি। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য রোগীকে কাতরাতে হয়নি। জরুরি আইসিইউ, ভেন্টিলেটর কিংবা অন্য কোনো জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য তাদের কারো কাছে হাত পাততে হয়নি।

বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীলরা করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করেন। তারা প্রায়ই বলেন, করোনা মোকাবেলায় তারা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। এ জন্য তারা প্রতিনিয়ত কৃতিত্ব নিয়ে থাকেন। বাস্তবতা হচ্ছে, কেউই করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জনগণ পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা বা লকডাউন কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার উন্নত ব্যবস্থাপনা দিতে পারেনি। বরং অব্যবস্থাপনা যদি করোনার কারণ হতো তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি শোচনীয় হতো। সুতরাং কম সংক্রমণ বা কম মৃত্যুর জন্য শাসকরা কোনো কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না।

পৃথিবীতে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যারা করোনা নিয়েও ব্যবসা করেছে। ভুয়া করোনা সনদ দেয়ার রেকর্ড বিশ্বে কেবল বাংলাদেশেরই রয়েছে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার গোটা হাসপাতাল উধাও হয়ে যাওয়া। ঠিক প্রয়োজনের সময় দেখা গেল করোনার জন্য নির্মিত হাসপাতালের অস্তিত্ব নেই। করোনার সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। হাসপাতালে কেনাকাটায় বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। জরুরি পণ্য না কিনে বিল করে নেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় বলতে হয়, সরকারের কৃতিত্ব নয় বরং পরম করুণাময় ¯্রষ্টা আমাদের এ পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। ডাক্তার প্রদীপ যে সতর্কতাবার্তা দিয়েছেন তাতে আশঙ্কা হচ্ছে আমাদের ওপরও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

এ বছরে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের আগ্রহ লকডাউনে। সরকার এর মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ লকডাউনের ঘোর বিরোধী। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ অস্তিত্বের প্রয়োজনে এটি মানতে পারছে না। জনসাধারণের বিপুল একটা অংশের ঘরে খাবার নেই। রোগীর জন্য ওষুধ পথ্য নেই। এই অবস্থায় যারা বেঁচে আছে তাদের কাছে লকডাউন মৃত্যুর নামান্তর। দরিদ্র মানুষ প্রতিদিন খিদের জ্বালায় পুড়ছেন। পেটে ভাত না থাকলে তারা লকডাউন কিভাবে মানবেন। বেসরকরি সংস্থা ব্র্যাক, সানেমের জরিপে দেশে দরিদ্র বাড়ার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। করোনার আগে গরিবের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৪৬ লাখ। করোনায় নতুন করে গরিব হয়েছে দুই কোটি ৪৫ লাখ।

লকডাউনে এই বিপুল দরিদ্র মানুষের আহাজারি দেখতে পাচ্ছি। লকডাউনে গরিব অসহায় মানুষের ওপর পুলিশের খড়গের চিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রিকশা ভ্যানওয়ালারা পুলিশের প্রধান টার্গেট। রাস্তায় রাস্তায় রিকশা উল্টে রাখা হয়েছে। চাকা ফুটো করে দেয়া হচ্ছে। তাদের ঘরে খাবার নেই। তারা করোনায় আক্রান্ত হননি। খিদের জ্বালা তারা সহ্য করতে পারছে না তাই বেরিয়ে পড়ছে। পুলিশও তাদের রিকশা ভ্যান ছিনিয়ে নিতে বেশি উৎসাহী। একজন ট্যাক্সিচালক রাস্তায় চিৎকার করছেন। তিনি বলছেন, আমি এই এলাকায় বাস করি। ট্যাক্সিতে করে এক রোগীকে বহন করেছি। পুলিশ আমাকে জরিমানা করেছে। ঘরে খাবার নেই। অন্যদিকে গাড়ি চালাতে পারছি না। জরিমানার টাকা পরিশোধ করব কোথা থেকে। এই ধরনের অসংখ্য মানুষের আর্তনাদে এবারের লকডাউনে সারা দেশের আকাশ ভারী হয়েছে।

আরো একটি লক্ষণ ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধে এই লকডাউন কতটুকু কাজে এসেছে বলা মুশকিল। তবে সরকার এই বন্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনেককে গ্রেফতার করেছে। সবাইকে বাসায় থাকার নির্দেশ জারি করে সরকার নিজে প্ল্যান করে এই মানুষদের ধরেছে। পুলিশের বিশাল বহর বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়েছে বিরোধী মতের লোকদের ধরার জন্য। করোনা যদি সত্যিই আমাদের দেশে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে তখন দেখা যাবে সরকারের আসল প্রস্তুতি নেই। সরকার এ পর্যন্ত যা করেছে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে করেছে।
jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement