১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

চীনের জায়গায় জাপান হলেও দুঃখ যাবে না

চীনের জায়গায় জাপান হলেও দুঃখ যাবে না - ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৬ মার্চ ঢাকায় আসছেন সেটা নিশ্চিত করতেই নাকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর গত ৪ মার্চ এক দিনের ঢাকা সফর করে গেলেন। কিন্তু এই সফরের যেসব মিডিয়া কাভারেজ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে বাংলাদেশে বা ভারতে, তা দেখে আমরা পরিষ্কার যে, দুই দেশের মিডিয়াই পুরা বিভ্রান্ত। জয়শঙ্কর কেন এসেছিলেন? যেমন- প্রথমত তার এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হওয়ার কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অতিথি হিসেবে মোদির বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করা। কিন্তু প্রায় সব মিডিয়া রিপোর্টই এমন যে, এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা কোথাও আছে কি না তা খুঁজে দেখতে হবে। এমনই অবস্থা!

তাহলে রিপোর্ট বা শিরোনাম কী নিয়ে? দুই দেশেরই বেশির ভাগ মিডিয়ার শিরোনাম ও রিপোর্টের ফোকাস হলো- সীমান্ত হত্যা। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আর ভারত নাকি একমত হয়েছে যে, সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে তাই হত্যা করতে হচ্ছে। অপরাধ ও হত্যা, একে অপরের রিমেডি! এই প্রসঙ্গে বড় করে জয়শঙ্করের বাণী সামনে এনেছে বিডিনিউজ২৪। জয়শঙ্করের বরাতে লিখেছে, আমি মনে করি, আমরা একমত হয়েছি, যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। কিন্তু আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে, সমস্যাটি কেন হচ্ছে এবং আমরা জানি, সমস্যাটি কী। সমস্যা হচ্ছে অপরাধ।... সুতরাং আমাদের মিলিত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ‘অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন’ সীমান্ত। আমি নিশ্চিত, আমরা যদি এটা করতে পারি, অপরাধহীন ও মৃত্যুহীন সীমান্ত, তাহলে একসাথে এই সমস্যার সমাধান করতে পারব।

লক্ষণীয় ‘সীমান্ত হত্যা’ নিয়ে জয়শঙ্কর কথা সাজিয়ে এসেছিলেন ভালোই, বলতে চেয়েছেন সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে তাই হত্যা করতে হচ্ছে। কিন্তু হত্যা হচ্ছে মানে ভারতীয় বিএসএফ হত্যা করছে- এটা স্বীকার করা হয়ে যায়। তাই এবার শব্দ বদলে এক চাতুরী করা। ‘হত্যা’র বদলে ‘মৃত্যু’ শব্দ ব্যবহার করেছেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ‘নো ক্রাইম নো ডেথ’ এটাই নাকি তাদের সীমান্ত-নীতি। মানে কিল, না ডেথ। আর তাতে মানে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশী হতভাগ্য নাগরিক-ব্যক্তিটার কেন সীমান্তে মৃত্যু হয়েছে, কে গুলি করেছে, এটা জয়শঙ্কর জানেন না বা সেটা যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। অথবা ওই লোক যেন নিজেই বিএসএফকে গিয়ে বলেছেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলতে! ব্যাপারটা এটাই দাঁড়িয়েছে এখন।

কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি কী করছিলেন? মি. মোমেন যদি বুঝেই থাকেন যে তিনি জয়শঙ্করের সাথে বাতচিতে বাংলাদেশীদের সীমান্তে হত্যা ঠেকাতে পারবেন না, এ নিয়ে কথা তুলেও সুবিধা করতে পারবেন না, তাহলে এটাকে তিনি তাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ইস্যু করলেন কেন, হতে দিলেন কেন? কেন রাজি হয়েছেন এতে? এটা আলোচনার ইস্যু না করলে আমাদের কী (বাড়তি) ক্ষতি হতো? তিনি কী ব্যাখ্যা করতে পারবেন? এ ছাড়া এখন এর চেয়েও বড় একটা প্রশ্ন উঠেছে!

প্রশ্নটা হলো- বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অপরাধ যদি করেও থাকে তাহলেই কী তাকে খুন-হত্যা করতে পারেন? করা যায়? তাকে হত্যা বা খুন করে ফেলবেন? এই হত্যাকে লুকিয়ে একে ‘মৃত্যু’ বলে ডাকতে পারেন? আপনি এটাকে মৃত্যু বলে ডাকার কে? কেন একে ‘মৃত্যু’ বলতে জয়শঙ্করকে সম্মতি দিয়েছেন? এর জবাব কী?

বর্ডার গার্ড (সাবেক নাম বিডিআর) ও বিএসএফ এ দুটোই পড়শি দুই দেশে সিভিলিয়ান ফোর্স হিসেবেই গণ্য, অর্থাৎ এটা যার যার দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মানে সামরিক বাহিনীর মতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। বরং এটা পুলিশের সমতুল্য এক সিভিল প্রশাসন যাদের কাজ অপরাধীকে ধরে আদালতে পেশ করা। আত্মরক্ষার মতো পরিস্থিতি ছাড়া অতিরিক্ত (অ্যাকসেসিভ ফোর্স) বলপ্রয়োগ না করা। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তাই থানার মাধ্যমে আসামিকে আদালতে পেশ করতে পারে। সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিষয়ক দুই দেশের চুক্তি (যেটা পাকিস্তান আমল থেকেই চালু হয়েছিল আর স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাকেই রিনিউ করে নেয়া হয়েছে) করার উদ্দেশ্যই ছিল মূলত দুটা। এক. সীমান্ত অপরাধের ইস্যুগুলোকে যেন সিভিল প্রশাসনের অধীনে রেখে পরিচালনা করা যায়; দুই দেশের নাগরিকের মধ্যে সদ্ভাব থাকে; দুই সীমান্ত রক্ষীবাহিনীই যেন অযথা এবং ‘অতিরিক্ত’ শক্তিপ্রয়োগ না করে। দুই. এতে সুবিধা হলো, দুই দেশের সেনারা সীমান্ত থেকে বহুদূরে (সম্ভবত ২৫ কিলোমিটারের বাইরে) ব্যারাক গড়ে থাকতে পারে। এতে সীমান্তে টেনশন কমানোর সহায়ক পরিবেশ পাওয়া যায়। সেনাবাহিনীর এনগেজমেন্টের রুল ভিন্ন এবং তা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে। একটা দেশের শত্রুর ব্যাপারে যেভাবে আচরণ করা উচিত সেভাবে। আর এখানে সবার ওপরের কথা হলো, সামরিক স্ফিয়ারের কোনো খুন বা ছোট-বড় গোলাগুলির ঘটনা কোনো দেশের আদালতে তোলার বিষয়ই নয়, আর তা এখতিয়ারেরও বাইরে। বড় জোর, নিজ নিজ দেশের সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোর্ট অব এনকোয়ারি হতে পারে; তাও বিশেষ ক্ষেত্রে। তাই দেশের সীমান্ত যদি সেনাবাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মানেই হলো, সীমান্ত-সম্পর্কিত অপরাধী আদালত-বিচার ইত্যাদির সুবিধা পাবে না। তা দেয়া যাবে না।

এসবের সার কথাটা হলো, ভারত-বাংলাদেশ উভয়েই নিজ সেনাবাহিনীকে সীমান্তের ২৫ কিলোমিটার দূরে ব্যারাকে রেখে এবার নিজ নিজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত ও পরিচালিত নিজ নিজ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী দিয়ে উভয়েই সীমান্ত নিরাপত্তা পরিচালনা করার চুক্তি করা মানেই, সীমান্তে কোনো অপরাধ ঘটলে তা গুলি করে সমাধান করা যাবে না। অপরাধ মানেই, গুলি করে হত্যা বা মৃত্যু নয়। কারণ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনী নয়। তারা অপরাধীকে প্রতিপক্ষ দেশে হস্তান্তর করতে পারে প্রটোকল থাকলে, চাই কী নিজ দেশের আদালতে পেশ করতে পারে। তাতে রায় সাপেক্ষে আসামিকে শাস্তি পেতে হতে পারে। তবে তা আর সীমান্ত বাহিনীর এখতিয়ারই নয়। তাহলে মি. মোমেন কিভাবে ‘নো ক্রাইম নো ডেথ’-জয়শঙ্করের এই সীমান্তনীতিতে সায় দিয়েছেন? এ প্রসঙ্গে, বিডিনিউজের রিপোর্ট দাবি করছে মোমেনকে পাশে নিয়ে জয়শঙ্কর বলেছেন ... ‘আমরা একমত হয়েছি’...। তাহলে নিজের হাত পরিষ্কার রাখতে মি. মোমেনের উচিত নিজে থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া, কেন তিনি একমত?

দুই দেশেরই মিডিয়ায় দ্বিতীয় গুরুত্বের ফোকাস ছিল ‘কানেকটিভিটি’। তাও অনেক মিডিয়া রিপোর্টে আবার ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটাই নাই অথবা অর্থহীনভাবে দু-এক শব্দে আছে। যেমন- ভারতের দক্ষিণী- দৈনিক দ্য হিন্দু, যা গত দুই জোড়া বছর ধরে মোদির জাতিবাদের বড় প্রবক্তাই শুধু নয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের খোদ ‘সাফাইদাতা মুখপত্র’ যেন এমন ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে সুহাসিনী হায়দার বা কল্লোল ভট্টাচার্যের লেখাগুলো; বলাই বাহুল্য, যা বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বলার কথা সেই দায়িত্ব অযাচিত হয়ে একটা মিডিয়া পালন করতে পারে না। এটা মারাত্মক দৃষ্টিকটু শুধু নয় এটা সরকারের তোষামোদ। আর যা তোষামোদ করা তা আর ন্যূনতম কোনো স্বাধীন মিডিয়া কি না সে প্রশ্ন ওঠে। দ্য-হিন্দুর অবস্থা এমনই! সময়ে মনে হয়েছে জার্নালিজমের ভূমিকা ভুলে গিয়ে ‘অতি দেশপ্রেমী-জাতিবাদী হিটলারের’ ভাই দ্য-হিন্দুর ওপর ভর করেছে। আমাদের চলতি সরকার ২০১৯ সালে গঠন হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত দ্য-হিন্দু অবলীলায় এ কাজ করছে, যা তার কাজই নয়। কিন্তু তামাসার দিকটা হলো, মনে হচ্ছে এবার জয়শঙ্করের সফরে দ্য-হিন্দুকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় ‘বেওয়াফা’ করে ছেড়েছেন, মানে ভাগাড়ে নামিয়ে দিয়েছেন। দ্য-হিন্দুর রিপোর্টে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটা অকিঞ্চিতকরও অর্থহীন, তবে আছে। অথচ এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপের মিডিয়াতেও তা যথেষ্ট অর্থপূর্ণভাবে রয়েছে।

বলা যায় ‘কানেকটিভিটি’ ট্যুর
সত্যিকারভাবে বললে, জয়শঙ্করের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল খুব সম্ভবত-চীনের বদলে জাপান! এ কথার মানে কী? মানে হলো, গত ১২ বছরের শুরু থেকেই ঢাকা সরকার চীনের একটা হাত ধরে রাখা না হলেও অন্তত একটা আঙুল ছুঁয়ে থাকা এই ছিল আমাদের সরকার, বিশেষত ২০১০ সালে সরকার প্রধানের চীন সফরের পর থেকেই। অথচ বিপরীত দিকটা হলো, ‘প্রো-ইন্ডিয়ান’ হয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। আর তাতে সরকারের দিক থেকে ভারতকে এই সাফাই-ব্যাখ্যা দেয়া হতো যে (২০১২ সালে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে লোন বাতিল এর পর থেকে), বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিপুল ঋণ পাবার উৎস হিসেবেই বিশ্বব্যাংকের বিকল্প চীনের সাথে এত যোগাযোগ। এমনকি ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর বাংলাদেশে সফর থেকে বাংলাদেশ প্রথম ২০ বিলিয়ন ডলারের নানান অবকাঠামো ঋণের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। সেটা ২০১৯ সালের মধ্যে বরং বেড়ে ২৬ বিলিয়নে পৌঁছেছিল; যদিও সব প্রকল্পের সব অর্থ খরচ হয়ে যায় নাই, তবে সব অর্থ বরাদ্দ হয়ে গেছে ও প্রকল্প চলমান। তাই এমনকি গত বছর আরো প্রায় ৬-১০ বিলিয়ন ডলারের নতুন প্রকল্প নেয়ার কথা চলছে। সারকথায় বাংলাদেশের চীন-ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণটা ভারতকে মেনে নিয়েই এতদিন চলতে দেখেছি আমরা।

২০১৯ সালের শুরু থেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশের আরো দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যেটা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের মে মাসে যখন সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘আমি ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে।’ একটা ক্ষোভ থেকে এটা বলা হয়েছে হয়তো। এরই বাস্তবায়নের শুরু ২০১৯ সালের জানুয়ারি। এটা যতটা ভারত থেকে দূরে ততটাই যেন চীনের সাথে আগের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া। তিস্তা নদীর নাব্যতা বা ধারণক্ষমতা বাড়ানোর প্রায় বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেখানে। ইতোমধ্যে আমেরিকায় বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে আমরা লক্ষ করেছি আরো বেশি করে চীনকে আঁকড়ে ধরা।

কিন্তু এই সব কিছুকে উলটে দিয়ে দুই সপ্তাহ আগে আমরা শুনলাম- চীনের হতাশ করা কথাবার্তা যে, আমরা আর কখনো জুট বা জুট মিল (পুনর্বাসন) এবং বস্ত্রখাতে বাংলাদেশকে সহযোগিতার কথা তুলব না; যদিও একটা পত্রিকা ছাড়া আর কোথাও এই খবরটা দেখা যায় নাই। কিন্তু এর পরপরেই বিবিসির রিপোর্টে পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্পের চীনা ঠিকাদারকে বিল পে না-করা নিয়ে সরকারের সাথে কথিত বিরোধ আমরা দেখতে পাই। এটা খুবই অস্বাভাবিক কিন্তু চরম বিরোধের আভাস দেয়। তখন থেকেই অনুমান বেড়ে চলছিল, এটা আবার চীনের থেকে বাংলাদেশের অনেক দূরে চলে যাবার ইঙ্গিত হয় কি না! আর এখানেই জয়শঙ্করের এই সফরকে ঠিক মোদির সফরের আগমনবার্তার বাহক যতটা না, এর চেয়ে বেশি এটা ‘কানেকটিভিটি’ ট্যুর মনে হচ্ছে! কিন্তু ‘কানেকটিভিটি’ কেন?

কারণ ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার আগে এই শব্দটা বাংলাদেশে পরিচিত শব্দটা ছিল না। তখন সুনির্দিষ্ট করে এই শব্দের অর্থ ছিল- ভারতের পুরা নর্থ-ইস্ট থেকে বাংলাদেশের পশ্চিমে, পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংযোগ করে দেয়া (এটাই কানেকটিভিটি) এবং সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে এবং বিনাপয়সায় গড়ে দেয়া। আর সেটা আকাশ, রেল, সড়ক, মাটির নিচে পাইপ লাইনে, বিদ্যুতের খুঁটি দিয়ে এবং নদী ও সমুদ্রপথে- সম্ভাব্য প্রায় কিছুই বাদ না রেখে।

সবচেয়ে অবাক কাণ্ড হলো, আমাদের মন্ত্রীরাও ‘কানেকটিভিটি’ ‘কানেকটিভিটি’ বলে বেড়াতেন এমনকি কেউবা সার্ভিসের অর্থ বা ভাড়াটাও ‘চাওয়া লজ্জার’ বলে দাবি করেছেন। অথচ ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের সব কিছুই ছিল ভারতের চাহিদাপূরণ এবং তা নিজের অসুবিধা করে। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত পরশু এসে আবার জয়শঙ্কর ‘কানেকটিভিটি’ শব্দ আওড়াতে শুরু করেছেন। কেন?

এবার তিনি নতুন কিছু চাচ্ছেন যার সাথে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটার আবার কোনোই সম্পর্ক নেই। যেমন ‘প্রথম আলো’ প্রথম দিন মানে ৪ মার্চেই যে রিপোর্ট করেছে- তাতে সে ‘কানেকটিভিটি’ শব্দটা নতুন কিছু আভাস পাবার মতো, সে কথাই লিখেছে। যেখানে বাংলাদেশের অন্য মিডিয়ারা কিছু তেমন লিখে নাই বরং উপেক্ষা করে গেছে। প্রথম আলো জয়শঙ্করের ভাষ্যে লিখেছে, ‘এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা একসাথে কাজ করছি না। যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ৫০ বছর পার হয়েছে এবং পরের ২০ বছর কী করা যেতে পারে, আমি বলব সংযুক্তি (‘কানেকটিভিটি’)। আমাকে আপনাদের প্রধানমন্ত্রী উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, সংযুক্তি হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। যদি আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সংযুক্তি ঠিকমতো করতে পারি, তবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূঅর্থনীতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর খুব কার্যকর। আমরা দুই পক্ষই বিশ্বাস করি, এটি করা সম্ভব।’

আরো লিখেছে, সংযুক্তি প্রসঙ্গে এস জয়শঙ্কর বলেন, আজকের বৈঠকের বড় একটি সময় তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তৃতীয়পক্ষকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। সম্ভাব্য দেশ হিসেবে জাপানের নাম এসেছে। কারণ, জাপানের সাথে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বঙ্গোপসাগরে জাপানের সংযুক্তি প্রকল্প রয়েছে। সম্পর্কোন্নয়নে তিনি সংযুক্তিকে বড় লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন।

প্রথম কথা হলো, ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের আড়ালে এতদিন ভারত যেভাবে তার নর্থ-ইস্টকে ভারতের বাকি অংশের সাথে সব মাধ্যমে একপক্ষীয় সুবিধায় বিনাপয়সায় জুড়ে নিয়েছে, এর অর্থ সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এবারের ‘কানেকটিভিটি’ শব্দের সাথে আগেকার ‘কানেকটিভিটি’ অর্থের কোনো মিল নাই। দ্বিতীয়ত, এর সাথে কথিত ‘তৃতীয় পক্ষ’ জাপানের সম্পর্ক কী? এর ন্যায্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা কী, তা জয়শঙ্কর দেখাতেই পারেন নাই।

তাহলে কিছু তাকে বলতেই হতো। তিনি অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে ফেলেছেন। তিনি দাবি করছেন, ‘আজকের বৈঠকের বড় একটি সময় তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তৃতীয় পক্ষকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার বিষয়েও তারা আলোচনা করেছেন। সম্ভাব্য দেশ হিসেবে জাপানের নাম এসেছে।’

তবে জয়শঙ্করের এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না যে ওই দিনই মানে বিমান থেকে তিনি নামার পর মাত্র এক ঘণ্টার আলাপের মধ্যে সব আলাপ করেছেন- না এটা মেনে নেয়া গেল না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের মন্ত্রী আমাদেরকে আগে কিছুই জানালেন না। অথচ জয়শঙ্করের মুখেই প্রথম কথাটা শুনতে হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী বলতে চান বা বলেছেন তিনি?

সম্ভবত জয়শঙ্কর বলতে চান, ‘জাপানের সাথে তার কথা হয়েছে। বাংলাদেশ যেন তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো-ঋণ চীনের বদলে জাপান থেকে নেয়।’ এ কথাটাই কীভাবে বলবেন বুঝতে না পেরে এটাও নাকি ‘কানেকটিভিটির’ আলাপ এই সূত্র ধরে বলতে গিয়েছেন। তাহলে জয়শঙ্করের ‘কানেকটিভিটি’ মানে হলো, চীন বাদ আর এর বদলে জাপানি ঋণ নিতে হবে- এই অনুমান সত্য ধরে নিয়ে এবার কিছু আলাপ করা যাক।

এক কথায়, এটা সুবিধাজনক নয়, তাই অকার্যকর হয়ে পড়বে। জাপান নিজেও জানে, তার সুদের হার চীনের চেয়ে বেশি। আর জাপানের সাথে আমাদের দেশের সম্পর্ক সেই জিয়ার আমল থেকেই সব আমলেই ভালো। জাপান আমেরিকার ‘ছায়ায় থেকে চলে’ বলে রাজনৈতিক দিকের দায় সব আমেরিকার। যেমন বাংলাদেশে জাপানি গাড়ির চাহিদা বাড়াতে গেলে এখানে রাস্তাঘাট, ব্রিজ অবকাঠামোর উন্নতি লাগবে। আবার বাংলাদেশে প্রজেক্ট না নিলে, মানে তাতে ঋণ না দিলে জাপানি কোম্পানিগুলো সরাসরি কিংবা তাদের শেয়ার কেন কোরিয়ান কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো এ দেশে কাজ পাবে না? এসবই হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানি সম্পর্কের ভিত্তি। এটা বহু আগে থেকেই অনেক গভীর সম্পর্কের। কাজেই এখানে তৃতীয় পক্ষ ভারতের ভূমিকা নিষ্প্রয়োজন ছাড়া কী? জয়শঙ্করও ভারতের ক্ষেত্রেই জাপানি ঋণ প্রসঙ্গে এসব প্রশ্নের জবাব নিশ্চয় জানেন। যেমন- অবকাঠামো খাতে জাপানের চেয়ে চীনা ঋণ বেশি কেন? মোদিই সবার আগে চীনকে ভারতে ডেকে আনেন। কারণ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকে তিনি চীনা অবকাঠামো ঋণ নিয়ে সম্পর্ক করেছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হলে সে ঋণ-গ্রহীতা সম্পর্ক আরো বাড়ে। মোদি জাপানি ঋণে আগ্রহী হন নাই কেন?

বুঝলাম এটা চীনবিরোধী রাজনৈতিক ক্লাব গড়ার স্বার্থে; ধরেই নিলাম কোনো কথিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আলাপ’। ভারতের (সাথে জাপানের) হাত ধরলেই কি বাইডেন কোলে উঠিয়ে নেবেন?

তাহলে বাইডেনের কাছে, যে কাশ্মিরের হিউম্যান রাইটস কিংবা মুসলমান নির্যাতনের ধর্মীয় স্বাধীনতার কালো রিপোর্ট মোদির নামে আছে যা অসংখ্য কাঁটাযুক্ত, তার কী হবে? হিউম্যান রাইট নিয়ে একই অবস্থা আমাদেরও!

তাহলে ব্যাপারটা শুধু চীনের চেয়ে জাপানের একটু না হয় সুদের হার বেশি, তা নয় বা ঋণ কতটা দিতে পারবে সে বিষয় আছে। কিন্তু এগুলোর চেয়ে বড় বিষয় হলো বাইডেনের ‘গায়ে কাঁটার’ জন্য ওর কোলে ওঠার সুযোগই নাই, এর কী হবে?

আবার যদি ধরা যাক কোনো জাদুবলে বাংলাদেশ বাইডেনের আমেরিকার কোলে উঠেই গেল? কিন্তু বর্তমান সরকার কী আমেরিকাকে আস্থায় নিতে পারবেন? কাজেই এটা শেষে আবার কিছু দিন-বছর ভারতের উদ্যোগে নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরানো ছাড়া কিছুই হবে না। মনে হচ্ছে অপরিষ্কার অংশ পরিষ্কার দেখতে আমাদের আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement