২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীন-ভারত সঙ্ঘাতে কৌশলগত সমীকরণ

চীন-ভারত সঙ্ঘাতে কৌশলগত সমীকরণ - ছবি : সংগৃহীত

সাড়ে চার দশক পর ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সঙ্ঘাতে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। আবার সেটি ঘটেছে সবচেয়ে সংবেদনশীল অঞ্চল কাশ্মিরের লাদাখে। এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত কতটা গভীর ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী হতে পারে সে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এ ঘটনায় একজন কর্নেলসহ অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং ৪৩ জন চীনের সেনা নিহত হয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে। বেইজিং প্রশাসনের মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসের প্রধান সম্পাদক টুইট করে জানিয়েছেন, এতে চীনের সেনাও মারা গেছে। আর রিপোর্টার ওয়াং ওয়েনওয়েন টুইট করে বলেছেন, চীনের পাঁচজন সেনা মারা গেছে। তবে চীনের সরকার বা সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি। এএনআই-এর দাবি, চীনের রেডিও ইন্টারসেপ্ট করে ভারতীয় সৈন্যরা জানতে পেরেছে অন্তত ৪৩ জন চীনা সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে বহু। এ ধরনের খবরের সূত্রকে অবশ্য নির্ভর করার মতো মনে করা হয় না। এ সংক্রান্ত সব সূত্রের খবরাখবর পর্যালোচনা করলে মনে হবে চীনের তুলনায় ভারতের ক্ষতি অনেক বেশি আর ঘটনাটি ঘটেছে চীনাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডে।

কেন সঙ্ঘাত?

দু’দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সর্বশেষ প্রাণঘাতী সঙ্ঘাত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। সে সময় অরুণাচল প্রদেশে ভারত-চীন সীমান্তের খুব কাছে চীনা বাহিনীর চালানো এক হামলায় ভারতের আসাম রাইফেলসের চারজন জওয়ান নিহত হয়। এবারের সংঘর্ষ নিয়ে দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগ এনেছে।

ভারতের অভিযোগ, চীন একতরফাভাবে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিল, অন্য দিকে চীন ভারতকে অভিযুক্ত করে বলেছে, তারাই চীনা বাহিনীর সদস্যদের আক্রমণ করেছিল।
পিপলস লিবারেশন আর্মির পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের মুখপাত্র ঝ্যাং শুইলিকে উদ্ধৃত করে পিপলস ডেইলি লিখেছে, ভারতীয় সৈন্যরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আবারো প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে বেআইনি কাজ চালাচ্ছিল। তারা ইচ্ছা করে প্ররোচনা দেয় ও চীনা বাহিনীকে আক্রমণ করে। তারই ফলে দু’পক্ষের মধ্যে ‘ভয়ঙ্কর’ শারীরিক সঙ্ঘাত হয় এবং হতাহত হয়।
গ্যালাওয়ান উপত্যকার সঙ্ঘাতের ব্যাপারে চীন ও ভারতের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য থেকে প্রকৃত ঘটনা কিছুটা আন্দাজ করা যায়। পিপলস ডেইলির মালিকানাধীন ট্যাবলয়েড পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ বুধবার সম্পাদকীয়তে লিখেছে, চীন-ভারত সীমান্তে সব সময়ই উত্তেজনা বিরাজ করার পেছনে ভারতের দম্ভ আর অদূরদর্শী মনোভাবই দায়ী। সম্প্রতি নয়াদিল্লি সীমান্ত ইস্যু নিয়ে একটা কঠোর মনোভাব নিয়েছে, যা দুটি ভুল মূল্যায়নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তারা মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপের ফলে ভারতের সাথে সম্পর্ক তিক্ত করতে চাইবে না চীন। তাই ভারতের তরফে প্ররোচনা দেয়া হলেও হয়তো চীন প্রত্যাঘাত করবে না।

এ ছাড়াও ভারতের কিছু মানুষের মনে ভুল ধারণা আছে যে, তাদের নিজেদের বাহিনী চীনের বাহিনী থেকে বেশি শক্তিশালী। এই দুটি ভুল ধারণাই ভারতের মতামতের যৌক্তিকতাকে প্রভাবিত করে চীন সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের সময়ে।
ঘটনার দু’দিন পর বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে চীনা কর্মকর্তা ঝাও বলেছেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) চীনা অংশে ঘটা এ ঘটনাতে স্পষ্ট হয়েছিল এখানে চীনের দায় নেই। পুরো ঘটনাটি ভারতের অ্যাডভেঞ্চারিজমের ফল এবং ভারতকে এর দায় নিতে হবে। এটি ভারতের জন্যও একটি সতর্কবাণী যে, আরো অ্যাডভেঞ্চারিজমের ফলে আরো বেশি দাম দেয়া হবে।
চীনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার ব্যাপারে যতটা স্পষ্ট বক্তব্য দেয়া হয়েছে ততটা দিল্লির পক্ষ থেকে আসেনি। শুধু বলা হয়েছে চীনা পক্ষ স্থিতাবস্থা পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। তবে এনডিটিভির দেয়া একটি তথ্যে এর কারণ পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে, আগে ভারতের সীমান্ত এলাকা বছরের পর বছর ধরে অবহেলিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০২২ সালের মধ্যে চীনা সীমান্তে ৬৬টি নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে। তার মধ্যে গ্যালওয়ান উপত্যকার কাছে একটি রাস্তাও তৈরি হয়ে গেছে যা দৌলত বেগ ওল্ডি বিমান ঘাঁটির সাথে সংযোগ স্থাপন করে, রাস্তাটি গত বছরের অক্টোবরেই উদ্বোধন করা হয়।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এই রাস্তা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণই মূল বিরোধের সূত্রপাত। সীমান্তে একটি পক্ষ যখন এ ধরনের ‘বিতর্কিত সীমান্তে’ অবকাঠমো নির্মাণ করে তখন পাল্টা অবকাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টা দেখা যায়। আর তা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ২০১৭ সালের দোকলামের ঘটনাটিও ছিল চীনের এ ধরনের পাল্টা অবকাঠামো নির্মাণে ভারতের বাধাদানকে কেন্দ্র করে। গ্যালাওয়ানের ক্ষেত্রে চীনা ক্যাম্পে গিয়ে ভারতীয় সেনাদের বাধা দেয়ার বিষয়টি শোনা যায়।

সম্ভবত বিমান ঘাঁটি বরাবর সড়ক নির্মাণের যে তথ্য এনডিটিভি দিয়েছে, তার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা চীনারা নেয়ার উদ্যোগ নিতে পারে, যাতে ভারতীয় পক্ষ থেকে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
উভয় দেশ এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সামরিকীকরণের মাধ্যমে অঞ্চলগুলোতে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। দু’পক্ষই রাস্তাঘাট, ফাঁড়ি স্টেশন এবং টেলিফোন লাইনের মতো অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি করছে। সৈন্যরা বিতর্কিত সীমান্তে নিয়মিত টহল দেয়। চীন পূর্ব হিমালয়ের ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং পশ্চিমে আরো ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি দাবি করে, ভারতেরও পাল্টা দাবি রয়েছে।

উত্তেজনায় আগ্রহ কোন পক্ষের?

লাদাখের এ ঘটনায় উত্তেজনা সৃষ্টির একটি প্রয়াস যে রয়েছে সেটি বোঝা যায়। সেই প্রচেষ্টাটি আসলে কোন পক্ষের এবং কেন? এ ব্যাপারে ভারতীয় সরকারি বক্তব্য অথবা গণমাধ্যমের খবরে চীনের বিরুদ্ধে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের সাদামাটা বক্তব্যের বাইরে সুস্পষ্ট কিছু না থাকলেও চীনা গণমাধ্যম এবং থিংক ট্যাংকগুলোর বক্তব্যে স্পষ্ট একটি ব্যাখ্যা রয়েছে, যা ভারতীয় পক্ষকে খণ্ডন করতে দেখা যাচ্ছে না।
চীন পাবলিক লিবারেশন আর্মির মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল জাং শুইলির বক্তব্য অনুসারে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ভারতীয় সেনারা সোমবার সন্ধ্যায় গ্যালওয়ান উপত্যকা অঞ্চলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণের সীমানা পেরিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উসকানিমূলক হামলা চালিয়েছিল, ফলে গুরুতর শারীরিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

তিনি উল্লেখ করেন, গ্যালওয়ান উপত্যকা অঞ্চলে চীন সর্বদাই সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেছে এবং ভারতীয় সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীর এ ব্যাপারে বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ আর তা উভয় দেশ যে চুক্তিতে পৌঁছেছে তাকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। সেনা কমান্ডার-স্তরের আলোচনায় গৃহীত ঐকমত্যকেও তা মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করেছে।
বেইজিংভিত্তিক সামরিক বিশেষজ্ঞ ওয়েই দোংক্সু বুধবার বলেছেন, চীনা সেনারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিক্রিয়া চালিয়েছিল, চীন পরিস্থিতি বাড়িয়ে তোলেনি এবং উভয়পক্ষ সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করতে ইচ্ছুক হলে এখনো এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ওয়েই বলেন, ভারতীয়পক্ষও বুঝতে পেরেছে যে সীমান্ত অঞ্চলে একটি বৃহত্তর এবং তীব্র সঙ্ঘাত হলে দু’দেশের সম্পর্কের ওপর তার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছোট আকারের সঙ্ঘাত সম্ভবত সংঘটিত হতে থাকবে, তবে বড় আকারের সামরিক সঙ্ঘাত হবে না।

উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা

সোমবারের মারাত্মক সংঘর্ষ সত্ত্বেও চীন ও ভারতের মধ্যে সর্বশেষ সীমান্ত বিরোধগুলোর সম্ভবত আগের মতোই ‘নরম অবতরণ’ দেখা যাবে, কারণ উভয় দেশই নিয়ন্ত্রণমূলক বিবৃতি দিয়েছে এবং উভয় দেশই সঙ্ঘাতে বন্দুক ব্যবহার করেনি।

বুধবার একটি নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝা লিজিয়ান বলেছেন, চীন ও ভারত উভয় কূটনৈতিক ও সামরিক উভয় চ্যানেলের মাধ্যমেই প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য নিবিড় যোগাযোগে রয়েছে।
বুধবার রয়টার্স ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি বিবৃতি উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, উভয় দেশের সেনা সদস্যরা শান্ত রয়েছে। উভয়পক্ষের বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, পরিস্থিতির উত্তেজনা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।
থিংক ট্যাংক গ্র্যান্ডভিউ ইনস্টিটিউশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট টিয়ান শিচেন বুধবার বলেছেন, তিনি আগামী দিনে পরিস্থিতি কিভাবে বিকশিত হবে সে সম্পর্কে আশাবাদী এবং চীন ও ভারত উভয়ই বড় শক্তি হওয়ায় তারা এ ঘটনার সমাধানের জন্য কাজ করবে বলে প্রত্যাশা করছেন।
ঘটনার দু’দিন পর বুধবার চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ঝি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। গ্যালওয়ান উপত্যকার বিষয়ে উভয়পক্ষই পরিস্থিতি শীতল করার জন্য তাদের সামরিক নেতাদের দ্বারা ঐকমত্যকে মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন।

কিভাবে এই জাতীয় দ্বন্দ্বের বারবার সংঘটন এড়ানো যায় এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধ করা যায় তা চীন-ভারত সম্পর্কে এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পেছনে চীন-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধ?

এর আগে ২০১৭ সালের দোকলাম সঙ্কটে আড়াই মাসব্যাপী দু’পক্ষের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার পর সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে বড় রকমের রক্তক্ষয়ের ঘটনা ঘটল। এটিকে নিছক কোনো সীমান্ত বিরোধ বা উত্তেজনা বলে মনে হয় না। এর পেছনে রয়েছে আরো গভীর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সমীকরণের বিষয়। যদিও আপাতত দু’পক্ষের মধ্যে সীমান্ত বৈঠক অথবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত হবে। তবে এর রেশ সামনে চলতে থাকবে যদি দুই দেশের যে কৌশলগত নীতি ও সমীকরণ বারবার উত্তেজনাকর অবস্থা সৃষ্টি করছে তাতে পরিবর্তন না আসে।
উভয় সরকারের শীর্ষপর্যায়ের মধ্যে কথাবার্তা এবং সমঝোতায় মনে হয়েছে এ সংঘর্ষ এখনই বিস্তৃত হবে না। তবে দু’দেশের মধ্যে এমন কিছু বিরোধ অতি গভীরে শেকড় গাড়তে করতে শুরু করেছে যাতে মনে হয় পররাষ্ট্রনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল পুনর্বিবেচনা করা না হলে এ সঙ্ঘাত থামবে না। এ উত্তেজনার পেছনে এশিয়ার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের নেতৃত্বের মানসিক গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিন যেমন তার আগেকার চীনা নেতৃত্বের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তেমনিভাবে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর তার শীর্ষ সহযোগীদের দৃষ্টিভঙ্গি আগের সরকারগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা। এমনকি বিজেপির বাজপেয়ী সরকার যে নীতি কৌশল নিয়ে ভারত পরিচালনা করেছে এখনকার নীতি তার চেয়েও মৌলিকভাবে ভিন্ন বলে মনে হয়।
গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ভারতের সাথে সংঘর্ষে জড়াতে চায় না চীন। তারা আশা করে দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই মেটানো যাবে। তবে এটা চীনের বদান্যতা, দুর্বলতা নয়। ভারতীয় সমাজকে বুঝতে হবে যে চীন ভারতের সাথে বন্ধুত্বের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী আরেকটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতকে সম্মান করে। ভারতের প্রতি চীনের মূল নীতি হলো চীন-ভারত সম্পর্ক এবং সীমান্ত অঞ্চল স্থিতিশীল রাখা। দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে, তবে এমন একটি ব্যবস্থাও বিকাশ করেছে যার ফলে কয়েক দশক ধরে সীমান্তে সাধারণ স্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে।

এ প্রক্রিয়াটি অবলম্বন করা এবং এটি ধ্বংস করার পরিবর্তে এর উন্নতি হলো দু’পক্ষের ঘাটতি দূর করার একমাত্র উপায়। ভারতকে কখনোই ছাড় দেয়ার জন্য চীনকে চাপ দেয়ার বিষয়ে ভাবা উচিত নয়, কারণ চীন তা করবে না। তদুপরি, চীনের পাল্টা ব্যবস্থার ব্যয় যাই হোক না কেন কখনোই তাতে দেরি হবে না।
এরপর আরো বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত ভারতীয় ধারণাগুলো স্পষ্টভাবে চীনকে টার্গেট করে। এ ধারণা অনুসারে, ওয়াশিংটনের চীনের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য ভারতের মতো দেশ দরকার হবে।

মার্কিন জনগণ এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু ব্যক্তির পক্ষপাতিত্বের কারণে ভারতীয় জনগণকে মাতাল করা সরকারের উচিত নয়। নয়াদিল্লি যদি এ ধরনের ভূমিকা পালন করার জন্য উদ্যোগী হয় তবে কৌশলগতভাবে সক্রিয় হওয়ার চেয়ে দেশটির নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে। এটি একটি বড় দেশ হওয়ার উচ্চাভিলাষ ত্যাগ করে ভারতকে তথাকথিত জোটের একটি সরঞ্জামে পরিণত করবে।
গ্লোবাল টাইমসে বলা হয়, আমরা লক্ষ করেছি যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত থেকে চীন সম্পর্কে অনুকূল মতামত খুব কমই শোনা যাচ্ছে, আর মূল্যবোধভিত্তিক জোট এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের স্বর আরো জোরালো হচ্ছে। এটি কি ভারতের উত্থানের ইচ্ছাকে দৃঢ় কোনো কৌশলগত সহায়তা দিতে পারবে?


চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে চীন-এর বিরুদ্ধে ভারতের সাম্প্রতিক উসকানির বিষয়টিও অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন। ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে খুশি করতে চাইছে। ঘটনার আগেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, দোকলাম স্ট্যান্ড অফের চেয়ে আরো গুরুতর সমস্যা তৈরি করা ভারতের প্রথম লক্ষ্য হতে পারে।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্ঘাত এখন অনেকখানি মতবাদগত বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। চীন ২০৩০ সাল নাগাদ আমেরিকান অর্থনীতিকে বেইজিং ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।

এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে চীন আরো বেশি মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করতে পারে। ২০৫২ সাল নাগাদ তারা এখনকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হতে চায়। আর যুক্তরাষ্ট্র তখন এখনকার অন্য বৃহৎ শক্তির মতো একটি সাধারণ বিশ্বশক্তি হয়ে থাকবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বেইজিং জাপানের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। আফ্রিকা ও এশিয়ায় বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে চায় চীন। এশীয় অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলোকে তার প্রভাববলয়ে আনতে চায়। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনা উত্থানকে ঠেকানোর জন্য এর মধ্যে যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে সেটাকে আরো সামনে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে এর মধ্যে আমেরিকার এক নাম্বার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার তাত্ত্বিক উদ্যোগ নিয়েছে। করোনাভাইরাসের ইস্যু নিয়ে সর্বাত্মক প্রচারণা শুরু করেছে। চীনকে কনটেইন করার ক্ষেত্রে এশিয়ায় ছোট ছোট দেশগুলো কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতই হতে পারে প্রধান মিত্রশক্তি। এ জন্য দিল্লির সামনে অর্থনৈতিক উত্থান ও বিশ্ব শক্তি হওয়ার প্রলোভনও সামনে রাখা হয়েছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনুসৃত নীতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে বিজেপি সরকার কৌশলগতভাবে সেই ফাঁদে পড়ে তার নীতি পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে। চীন বারবার দিল্লির কাছে এ বার্তা দিতে চাইছে যে, বেইজিং একটি বড় শক্তি হিসেবে সহযোগিতার সম্পর্ক ভারতের সাথে বজায় রাখতে চায়।

এটি ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার কাঠামোর মাধ্যমে এগিয়ে নেয়ার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু আমেরিকার ছায়া শক্তি হিসেবে দিল্লির কোনো উসকানিমূলক ভূমিকা গ্রহণ মেনে নেবে না।
তবে ভারতীয় নীতি অনুসৃতির যে বাস্তবতা এখন দেখা যাচ্ছে, তাতে ভারতের মোদি প্রশাসন পশ্চিমের মিত্র হিসেবেই নিজেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে বলে মনে হয়। এটি চাইলে গ্যালাওয়ান অথবা দোকলাম সঙ্ঘাতের মতো ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকবে। এটি শুধু চীন সীমান্ত অথবা চীনের অর্থনৈতিক করিডোর অবকাঠমোর টার্গেটে সীমিত থাকবে না। একই সাথে এ অঞ্চলে চীনা মিত্র দেশগুলোর সাথেও ভারতের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে যা পাকিস্তান ও নেপালের সাথে দেখা যাচ্ছে। একই পরিস্থিতি বাংলাদেশ মিয়ানমার বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সামনেও দেখা যেতে পারে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে ইয়াবাসহ গৃহবধূ গ্রেফতার জুলাইয়ে ব্রাজিল সফরে যেতে পারেন প্রধানমন্ত্রী জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিলো ভানুয়াতু বিতর্কিত ক্যাচের ছবির ক্যাপশনে মুশফিক লিখেছেন ‘মাশা আল্লাহ’ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি মিরসরাইয়ে অবৈধ সেগুনকাঠসহ কাভার্ডভ্যান জব্দ মানিকগঞ্জে আগুনে পুড়ে যাওয়া মলিরানীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বরেকর্ড ইন্দোনেশিয়ার নারী ক্রিকেটার রোহমালিয়ার ‘এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব’ যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী

সকল