২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যাংক খাতে আমূল সংস্কারের গুরুত্ব বেড়েছে

ব্যাংক খাতে আমূল সংস্কারের গুরুত্ব বেড়েছে - সংগৃহীত

বিশ্বের প্রচলিত সব ব্যবস্থাকে বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারী। এ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোও আমাদের কাছে প্রকটভাবে ধরা দিয়েছে। স্বাস্থ্য, অর্থ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতিÑ সব কিছুই এক নাজুক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অর্থ। তাই এই খাত নিয়ে ভাবনাও বেশি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমি মনে করি, করোনা আমাদের সামনে পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। সময় এসেছে আর্থিক খাতের আমূল সংস্কারের। আর বর্তমান বিশ্বে এই আর্থিক খাত পরিচালনার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা।

আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। এটি ব্রিটিশ সিস্টেমের ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং। এই সিস্টেমে ব্যাংকের শাখা-প্রশাখাগুলো সব সম্পদ হেডকোয়ার্টার্সে এনে জমা করে। অর্থাৎ সারা দেশ থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে শহর বা কেন্দ্রে এনে জমা করা হয়। সেখান থেকে পরে বিতরণ করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের বৈশিষ্ট্যও এটাই- কলোনিগুলোর রক্ত শুষে ঔপনিবেশিক প্রভুর কাছে নিয়ে জমা করা। একে জমিদারি ব্যবস্থার মতোও বলা যেতে পারে। জমিদাররা যেমন কৃষকদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে পয়সা আদায় করে সরকারকে খাজনা দিত, এটাও তেমনি। যারা ব্যাংকে কাজ করেন তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করতে টার্গেট দিয়ে দেয়া হয়। তারা নানা কৌশলে সেই টার্গেট পূরণ করেন।

আমেরিকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা আবার অন্য ধরনের, সেটাকে বলা হয় ইউনিট ব্যাংকিং সিস্টেম। আমেরিকার ব্যাংকগুলো সব স্বাধীন। তাদের মধ্যে ইন্টারনাল লিয়াজোঁ রয়েছে, কিন্তু প্রতিটি ইউনিট স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। যখন তারা দেখে কোনো এলাকার ব্যাংক ভালো করতে পারছে না তখন সেটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। আর সে কারণেই আমেরিকায় দেউলিয়া ঘোষণার হার অনেক বেশি। আমেরিকার অর্থনীতির গতিশীলতা এখানেই। যে ব্যাংক মুনাফা করতে পারছে না সেটি বন্ধ করে দিতে তারা মুহূর্তকাল দেরি করে না। তারা যে এলাকায় ব্যাংক স্থাপন করতে যায় সেখানকার ভোগ বা অর্থ খরচের প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করে। আয়ের একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া হলো খরচ। তারা খরচের খাতওয়ারি বিভাজন (ব্রেক আপ) দেখে। আমেরিকায় কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেই। আমরা ফেডারেল রিজার্ভ হিসেবে যাকে জানি সেটি কোনো সেন্ট্রাল ব্যাংক নয়।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলেও এটি জমিদারের মতোই ভূমিকা পালন করছে। এখানে ঔপনিবেশিক ধাঁচের নির্বাহী আদেশ দিয়ে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক একেকটি আইন করছে, একেকটি নির্দেশনা জারি করছে, কিন্তু এগুলোর প্রভাব ও প্রকোপ (ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইনসিডেন্স) কী হবে তা বোঝার মতো সামর্থ্য তার নেই। তারা যে কর বসাচ্ছে, যেসব নির্দেশনা জারি করছে তার প্রভাব ও প্রকোপ বোঝার জন্য পাবলিক ফাইন্যান্স, মনিটরি ইকোনমিকসের জ্ঞান থাকা বড় বিষয়। আর সে কারণেই আমাদের দেশে আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম দূর হচ্ছে না।

পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাকে দেয়া ক্ষমতার সুষ্ঠু প্রয়োগও করতে পারছে না। অনেকে মনে করেন, এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে। আসলে তা নয়। এর যে চার্টার রয়েছে, তা মানা হলে এটাকে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না; যদিও গভর্নরকে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দোষ দেন অর্থমন্ত্রণালয়ের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার জন্য। অথচ পার্লামেন্টে আইন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা চাইলেও অর্থমন্ত্রণালয় পরিবর্তন করতে পারবে না, সেগুলোও যেন তারা ভুলে বসে আছে। এসব আইন প্রয়োগ করতে গেলে কেউ বাধা দিতে আসবে না। এই আইন প্রয়োগের অভাবেই আজ আমাদের দেশের একাধিক ব্যাংক একক কোনো গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারছে।

ব্যাংকিং কোম্পানি আইন (১৯৯১)-এর ১৪(ক) ধারায় রয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাইবে না এবং কোনও ব্যক্তি, কোম্পানি বা কোনও পরিবারের সদস্যগণ একক, যৌথ বা উভয়ভাবে কোনও ব্যাংকের শতকরা ১০ ভাগের বেশি শেয়ার ক্রয় করিবেন না।’ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (সিএসই), ২২ নভেম্বর ২০১১ সালের এক নির্দেশনায় বলেছে, তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। আরো বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হতে হলে ২ শতাংশ পেইড আপ ক্যাপিটাল থাকতে হবে। সাধারণ শেয়ার কিনেও পরিচালক হওয়া যাবে, কিন্তু তার জন্য ৫ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে।’ কোনো ব্যাংকে কারো এ ধরনের শেয়ার, তার স্বার্থ আছে এমন সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৫ শতাংশের বেশি থাকতে পারবে না। সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত থাকতে পারে তবে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।

এটি একটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্স প্রক্রিয়া। বাজার থেকে শেয়ার কিনে পরিচালক করার উদ্দেশ্য ছিল- মালিকানা ছড়িয়ে দেয়া; কয়েকজন ব্যক্তির হাতে মালিকানা সীমাবদ্ধ না রেখে অনেককে তার অংশীদার করা। এটি সরকারের সদিচ্ছা। আবার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে ইচ্ছামতো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও আইন পরিবর্তন করেছে। এর পরও যতটুকু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তারও প্রয়োগ না থাকার কারণে আজ ব্যাংক খাতের এই দুর্দশা।

সরকারি ব্যাংকগুলো যেভাবে বছরের পর বছর ধরে ঋণখেলাপি হচ্ছে তাদের কেন পুষতে হবে, সেই প্রশ্ন আমার। কোনো ছাত্র একই ক্লাসে ১০ বছর ফেল করলে তাকে আর রাখা হয় না। তা হলে বছরের পর বছর ফেল করে যাচ্ছে যেসব ব্যাংক, সেগুলোকে কেন আমরা রাখছি? আমি মনে করি, একটি সরকারি ব্যাংক রেখে সবগুলোই বন্ধ করে দেয়া উচিত। অথবা সবগুলোকে একটি ব্যাংকে একীভূত করা উচিত। ‘মার্জার ল’ তৈরি করে এর বাস্তবায়ন করতে হবে। যতদূর জানি আমাদের দেশে ‘একুইজিশন অ্যান্ড মার্জিং’ আইন নেই। ক্যান্সার কখনো পেইনকিলার দিয়ে সারানো যায় না। যে অঙ্গে ক্যান্সার হয়েছে সেটি কেটে ফেলে দিতে হবে। সরকারি ব্যাংকগুলো আজ বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে আমি নিশ্চিত, সামাজিক বিপ্লব ঘটবে। আজ যখন চেক দিয়ে গ্রাহক তার টাকা পায় না, তখন তার মাথা খারাপ হওয়ারই কথা। তখন তো খুনোখুনি হতে পারে। এর জন্য দায়ী হবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ না করার কারণে। এখানে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দোষ নেই।

কোম্পানি আইনের সেকশন ৪৫-এ রয়েছে : ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে, সে জনস্বার্থে কাজটি করছে, তা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারে। সে নিজেই এর জন্য বিধি তৈরি করতে পারে।’ এটি কি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক কি কখনো নিজের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে? সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ব্যাংকিং খাতে সরকারের কাছ থেকে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন নির্দেশ ও গাইডলাইন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এসব নির্দেশের একটির সাথে আরেকটির মিল থাকে না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর আমরা দেখেছি ঋণগ্রহীতাদের সুদ মওকুফ করে দিতে নির্দেশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু এতে ব্যাংকগুলো কিভাবে চলবে সেটা কি ভাবা হয়েছে? ব্যাংক তার আমানতকারীদের, ছোট ছোট শেয়ারহোল্ডার বা বিনিয়োগকারীদের মুনাফা কোথা থেকে দেবে তা কি বলা হয়েছে? সরকারের এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হবে না, যা ব্যাংকিং কার্যক্রম সঙ্কুচিত করে ফেলে।

আমি সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংকের ৪০০ পল্লী শাখা গঠনের জন্য ‘সবুজ হাট প্রকল্প’ প্রস্তাব করেছিলাম। সেখানেও সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের খরচ তথা ভোগের প্রকৃতি বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়েছি; অর্থাৎ কেউ যদি ১০০ টাকা আয় করে তা হলে সে ওই টাকার কত অংশ কোন খাতে খরচ করছে।
দেখা গেছে, বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের মানুষ তার আয়ের ৮০ শতাংশ খরচ করে খাদ্যপণ্যের পেছনে। ৫ থেকে ১০ শতাংশ সেনিটারি ও বাকি টাকা ওষুধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে খরচ করে। তখন আমরা স্থানীয় লোকজনের চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে সবুজ হাট প্রকল্পের ডিজাইন করি। আমেরিকান ইউনিটারি ব্যাংকিং সিস্টেমে এটি করা হয়; যা আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ আমলার বিরোধিতার কারণেই আমার প্রস্তাবিত প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি।

সবুজ হাট প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল অর্থনীতিকে গ্রামমুখী করা। গ্রামীণ জনপদে উদ্যোক্তা তৈরি করে অর্থনীতিকে শহরমুখী না করে গ্রামমুখী করা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামভিত্তিক আর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারত। পল্লী শাখাগুলো স্থাপন করা গেলে আজ সেখান থেকেই ঋণ দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা যেত; যা বর্তমান করোনা মহামারীর মতো মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় অনেক সহায়ক হতো। গরিব মানুষকে একবার রাজধানীর দিকে, আরেকবার গ্রামের দিকে ছোটাছুটি করতে হতো না। আমাদের বাজেট বিদেশী সাহায্যনির্ভর। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিদেশী সাহায্য কতটা পাওয়া যাবে তাও এক বড় প্রশ্ন। আগামী বাজেটে সরকারের জন্য এটি মাথাব্যথার বড় কারণ হতে পারে।

তাই আমি মনে করি, আমাদের ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের সময় এসেছে। ব্যাংকের বরাদ্দগুলো জেলাভিত্তিক হওয়া উচিত। ব্যাংকগুলো তখন কর্মভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। ফলে সারা দেশের সুসম উন্নয়ন ঘটবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে আমলা বসিয়ে ব্যাংকিংয়ের সুফল সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যাবে না। আমাদের ঔপনিবেশিক ধাঁচের এই কাঠামো থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে।
লেখক : ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ।


আরো সংবাদ



premium cement
জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিলো ভানুয়াতু বিতর্কিত ক্যাচের ছবির ক্যাপশনে মুশফিক লিখেছেন ‘মাশা আল্লাহ’ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ৭৩ জনকে বহিষ্কার করলো বিএনপি মিরসরাইয়ে অবৈধ সেগুনকাঠসহ কাভার্ডভ্যান জব্দ মানিকগঞ্জে আগুনে পুড়ে যাওয়া মলিরানীর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বরেকর্ড ইন্দোনেশিয়ার নারী ক্রিকেটার রোহমালিয়ার ‘এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব’ যদি বন্ধু হও, সীমান্তে অহরহ গুলি কেন : ভারতকে ফারুক সাহারা মরুভূমির গরমের মতো অনুভূত হচ্ছে : সরকারকে দায়ী করে রিজভী মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে ২ ভাইকে হত্যার প্রতিবাদে সমাবেশ শ্রীলঙ্কাভিত্তিক এয়ারলাইন্স ফিটসএয়ারের ঢাকা-কলম্বো সরাসরি ফ্লাইট চালু

সকল