করোনাবিরোধী যুদ্ধে লকডাউনই শেষ কথা নয়
- মইনুল হোসেন
- ০৭ এপ্রিল ২০২০, ২১:২১
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীব্যাপী মহামারী চলছে। প্রতিদিন পৃথিবীর সর্বত্রই হাজার হাজার মানুষ এই ভয়াবহ ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে। সব রকমের প্রস্তুতির পরও আমেরিকায় প্রতিদিন এক হাজার লোকেরও বেশি মৃত্যুবরণ করছে। বিশ^ব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। তবে দেশব্যাপী লোকজনকে ঘরে রাখার জন্য লকডাউন চলছে। রোববার পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবাই সামনে ভয়ঙ্কর দিনের আশঙ্কায় দিন গুনছি। পুরো জাতি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
করোনার মতো ভয়াবহ সংক্রমণ রোগ প্রতিরোধের কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা তাই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, একধরনের ইনজেকশন বের হতে যাচ্ছে, যার কাজ হবে রোগ প্রতিরোধ করার শক্তি বৃদ্ধি করা। দাবি করা হচ্ছে, অল্প সময়েই করোনাভাইরাস রোগ থেকে রক্ষা করা যাবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতেই হবে।
আমেরিকাসহ অন্যান্য উন্নত দেশ করোনা আক্রমণকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে কাজ করে যাচ্ছে। জীবনের ওপর চরম ঝুঁকি নিয়ে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবীরা দিনরাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্ট লাঘব করে বাঁচানোর কাজটি খুবই দুরূহ।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে হলে দেশের দক্ষ ও মেধাবীদের জনগণের জীবন রক্ষায় সাহস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে, নিজেদের বুদ্ধি ও বিবেচনা অনুযায়ী বক্তব্য রাখার সাহস দেখাতে হবে। কারণ, অপরিচিত করোনা মহামারী থেকে রক্ষা পেতে হলে সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা ও প্ল্যানিংয়ের প্রয়োজন অনিবার্য। দেশটিতে দীর্ঘকালব্যাপী অব্যবস্থাপনা ও এলোমেলো অবস্থা বিরাজ করায় করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা মোকাবেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে কেউ আশ^স্ত হতে পারছেন না।
এখন শেষ সময়ে নতুন করে রাজনৈতিক নেতাদের নিন্দা করে কিংবা সরকারকে দোষারোপ করে কোনো লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। তবে অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, জাতিকে বাঁচিয়ে রাখার আস্থা অর্জনের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা ভাবতে হবে। সে জন্যই বলছি, হতাশা নিয়ে বসে থাকার সময় আর নেই। কারণ, আমরা কেউ নিরাপদ নই।
জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সরকারের সাফল্য তখনই সম্ভব যখন সরকারের আন্তরিকতা ও সততার ওপর জনগণের বিশ^াস সন্দেহমুক্ত থাকে। নেতৃত্বের শূন্যতার অসহায়ত্বের মধ্যে আমাদের বিবেকবানদের একেবারেই অসহায় হয়ে থাকলে চলবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
করোনাভাইরাস একটি বিশ^ব্যাপী মহামারী, যার কোনো নিরাময় নেই, কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সহায়ক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এবং নিবিড় স্বাস্থ্য পরিচর্যা করে জীবন বাঁচানো সম্ভব। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কিভাবে এই কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে সে বিষয়ে বিশে^র অনেক উন্নত দেশ থেকে সহযোগিতা নিতে হবে।
সঙ্কট যে মুহূর্তে ব্যাপকতা লাভ করে তখন রাজনৈতিক নেতাদের ওপর ভরসা রাখতে না পারা যেকোনো জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের বড় দুর্ভাগ্য এখানেই। জাতিকে সম্মিলিতভাবে উজ্জীবিত করার নেতৃত্ব নেই। সে জন্যই আমরা সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত যৌথ টাস্কফোর্সের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অর্থনৈতিক খাতের মতোই অগোছালো এবং এসব ক্ষেত্রেও যোগ্য লোকের কোনো ভূমিকা ছিল না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো সবাইকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে চলছেন। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে নিজের এ ব্যর্থতার কথা তিনি বলবেন না। তাকে এককভাবে দোষ দেয়া হচ্ছে না। অন্য মন্ত্রীদের মতো ভয়ভীতি দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ রাখতে পারলেই হলো।
আমরা তো আশা করছি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজনেই সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যেও অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার ও নার্স রয়েছেন। তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া সবাই মিলে কাজ করার সম্মিলিত নেতৃত্বও গড়ে তোলা যাবে।
অপর দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলো খোলা রাখার নির্দেশ দিলেন। গার্মেন্টস মালিকদের বুদ্ধিমতো তিনিও আশ^াস দিলেন করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য গার্মেন্টস কর্মীদের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা থাকবে। লাখ লাখ গরিব পুরুষ ও মহিলা কর্মচারীর জীবনের ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মাথা ঘামালেন না। আবার চাপের মুখে ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গার্মেন্টসসহ রফতানিমুখী শিল্পের কর্মচারীদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা অনুদানের যে ব্যবস্থা সরকার করেছে, সে টাকার কতটা সদ্ব্যবহার হবে তা দেখার বিষয়। তবে সরকারি অব্যবস্থাপনার অমানবিক দিকটি জাতীয় সঙ্কটকালেও চাপিয়ে রাখা গেল না। কম মূল্যে চাল বিতরণে সরকারি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুর্নীতির ঘটনা তো অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে।
লকডাউন ঘোষণা করা এবং জনগণকে ঘরে অবস্থান করতে বলা করোনাবিরোধী যুদ্ধের একমাত্র পথ নয়। রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ঘরে থাকাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতির আলোকে নতুন নতুন চিন্তাভাবনাও প্রচার করছে। তাই বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত সম্পূর্ণ প্যাকেজই মানতে হবে। পরিস্থিতির আলোকে প্রদত্ত নতুন নতুন উপদেশ গ্রহণ করতে হবে।
সবাইকে ঘরে থাকতে হলে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে তা বুঝতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অচল হয়ে পড়ায় কোনো না কোনোভাবে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে সবারই। প্রায় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতনভাতা দিতে সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। তার পরও তাদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সাংবাদিক সমাজও সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে করোনা মহামারীর মোকাবেলা করা অবশ্যই অত্যন্ত কঠিন। আন্তর্জাতিক সাহায্যের সুবিধা নিতে হবে। বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে আগে নিশ্চিত করতে হবে বিদেশী সাহায্য লুটেরাদের হাতে যাবে না। লুটেরারা তো বসে আছে তাদের লুট করা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে আরাম-আয়াশে থাকার জন্য। তাদের টাকা ছাড়তে বলতে হবে।
মধ্যশ্রেণী এবং নি¤œমধ্যশ্রেণীর লোকেরা এক নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়েছে। অন্যান্য দেশের মতো ভিন্ন কোনো বিচার-বিবেচনায় না গিয়ে যারা অর্থকষ্টে ভুগছে তাদের সবাইকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য দেশ লকডাউন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিচ্ছে কেবল সে দিকেই নজর দিলেও তো আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যাবে। ঘরে বন্দী রাখা মহামারীর বিস্তার ঠেকানোর একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। ওই সব দেশে ঘরে অবস্থানকারী জনগণের প্রয়োজনে সাড়া দেয়ার জন্য সরকারি কর্মচারীদের সর্বদা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাহায্য নেয়া হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবক ও সেবিকাদের কাছ থেকে। অন্যথায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তি তার গোটা পরিবারের জন্য মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সুতরাং ঘরে অবরুদ্ধ ব্যক্তিদের প্রয়োজনের বিষয়টি কোনোভাবে বিস্মৃত হওয়া যাবে না।
দ্রুত চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টিকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা নিশ্চিত যে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা স্বেচ্ছায় এ ব্রত পালনে প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু তাদের আত্মরক্ষার পোশাক ও উপকরণ দিতে হবে।
সামরিক বাহিনীর লোকদের রাস্তায় অবস্থানের চেয়ে সেবাকার্য প্রদানে যৌথ উদ্যোগ গঠনে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারবেন। তাদের এ ব্যাপারে গৃহীত কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি জনগণকে অবহিতকরণে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি।
আমাদের বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট আমাদের হাতে রয়েছে। এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কিটগুলোর ব্যবহার সারা বিশে^ অপরিহার্য বিবেচনা করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, যিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঘরে অবরুদ্ধ থাকেন এবং সেই অবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে করোনা পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জরুরি নির্দেশনা দেন। কারণ, এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার কারা হয়েছে সেটি চিহ্নিতকরণ এর বিস্তার রোধের জন্য খুবই জরুরি। তাহলে আক্রান্তদের সময়মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
সুতরাং আমাদের দেশের লোকদেরও দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ জন্য গৃহবন্দীদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ভয় পাচ্ছে যে, এ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারাতে পারে। ব্যাপারটাকে গুরুত্বসহকারে না নেয়ার কারণ দেখি না। আমাদের লোকজনকে শুধু ঘরে আটক রাখার উপদেশ দিলেই হবে না, সবাইকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ রোগ থেকে বেঁচে থাকার সব ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।
অন্যান্য দেশের প্রতিটি লোক দিনে-রাতে কিভাবে জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি হিসেবে কর্মব্যস্ত রয়েছে তা না দেখার জন্য আমরা চোখবুজে থাকতে পারি না। জনগণকে যথাযথ সেবা দেয়ার জন্য সেসব দেশের নেতারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছেন তাদের প্রস্তুতির সাফল্য দেখার জন্য। নিউ ইয়র্কের গভর্নর স্বাস্থ্যসেবার কাজটিকে গতিশীল করার জন্য বিশ্রামহীনভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।
আমদের দেশের কর্তৃপক্ষের ভাবনাটি এমন যে, জনগণকে ঘরে বন্দি রাখলেই রোগ পালিয়ে যাবে। অন্যান্য দেশে ফায়ার ব্রিগেডসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষের সেবার ব্যবস্থাপনা জোরদার করার জন্য। প্রচুর অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে সন্দেহভাজন রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার জন্য। ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য জরুরি মেশিনপত্রের প্রয়োজন যথাসময়ে মেটাতে না পারলে আক্রান্তদের বাঁচানো যাবে না।
বলা হচ্ছে, আমরা করোনা মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। কোনোরূপ প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধের কথা আমরা আগেও শুনেছি। কেউ অস্ত্র যুদ্ধের কথা বলছে না। জাতিকে উজ্জীবিত করে সম্মিলিতভাবে কর্মযজ্ঞ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখছি না।
এই মহামারী চলা অবস্থায় প্রতিটি মিনিটই অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি ভেন্টিলেটরের অভাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন রোগীর জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে।
বন্দুকের মুখে লকডাউন সফল করতে চাইলেও তা কোনো কাজে আসবে না যদি প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপ আন্তরিকভাবে গৃহীত না হয়। জনগণ অনাহারে কিংবা বিনা চিকিৎসায় নীরবে মরতে পারে না। মহামারী রোধে যৌথ টাস্কফোর্সের করণীয় কাজ বা উদ্দেশ্য যৌথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা