০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাতীয়তাবাদের ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

সিরাজউদ্দৌলা - সংগৃহীত

পাক-ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের পর বাংলা বিহার উড়িষ্যায় নবাব আলীবর্দি খাঁর শাসন আমল থেকেই এক অর্থে, বাঙালি শাসন আমলের সূচনা। তার মৃত্যুর পর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন দৌহিত্র তরুণ সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ৬৫ হাজার সৈন্য থাকা সত্ত্বেও লর্ড ক্লাইভের তিন হাজার সৈন্যের কাছে পরাজয় বরণের পরই ইতিহাসবিদদের অনেকের কলমে সিরাজউদ্দৌলার ‘অযোগ্যতা’ ও নারী সম্পর্কিত কাহিনী উঠে আসে। তার দেশপ্রেম নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। নবাব সিরাজ যদি আপস বা আত্মসমর্পণ করতেন তবে হয়তো মীর জাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে, মোহাম্মদী বেগের হাতে নিহত হয়ে তার লাশ মুর্শিদাবাদের রাজপথে ঘুরানো হতো না। এ ছাড়াও সিরাজের আলেয়া নামক ঘনিষ্ঠ, নর্তকীরও দেশপ্রেম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু একজন নর্তকীর দেশপ্রেম থাকলেও প্রবীণ প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের দেশপ্রেম ছিল না; বরং একজন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় তিনি চিহ্নিত।

মীর জাফর গংয়ের মীর জাফরীতে ব্রিটিশের পৌনে ২০০ বছরের শাসন আমলে ঔপনিবেশিক উপমহাদেশের ধনিক শ্রেণীকে দালাল বানিয়ে দেয়া হয়েছিল, কোথাও বিভিন্ন ধরনের উপাধি দিয়ে, কোথাও ব্যবসায় বাণিজ্যসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে, কোথাও মদের আসরে মত্ত বানিয়ে উপমহাদেশকে শাসন শোষণ ইত্যাদি উভয়ই করেছে। অনেক ভয়ঙ্কর কাজ দালালদের দিয়ে করানো যায়। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ধনিক শ্রেণীর তেমনি অবদান নেই। বরং সুট টাই পরা, চামচ দিয়ে খাওয়া, ইংরেজ রমণীদের সাথে তালেতালে নাচে অংশগ্রহণের সুযোগ নেয়াকে দালাল শ্রেণী সম্মানজনক মনে করে এসবের অনুসরণে নিজেদের গর্বিত মনে করত। ভিনদেশী ফিরিঙ্গি সাদা চামড়াওয়ালাদের ‘সাহেব’ টাইটেলের এই শ্রেণীই উদ্ভাবক। পাক-ভারতের সম্পদ ফিরিঙ্গিদের উপহার দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ব্রিটিশের রাজা বা রানী থেকে বিভিন্ন উপাধি গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশী ফিরিঙ্গিদের কুর্নিশ করা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের শিখিয়েছে এ দেশের ধনিক দালালেরা।

ওদের অনেক ঘটনাই ইতিহাসে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। ব্রিটিশদের প্রতি উপ-মহাদেশের রাজা-বাদশাহ ও জমিদারদের তল্পিবহন বা দালালির জন্যই ভারতবর্ষ থেকে পৃথিবী বিখ্যাত কোহিনূর হীরা ব্রিটেনের রানীর রাজমুকুটে চলে যায়। ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব দখলের পর রণজিৎ সিংহের নাবালক পুত্র দিলীপ সিংহের সাথে ‘লাহোর চুক্তি’ করেছিল ধূর্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে মোতাবেক পাঞ্জাবের নাবালক রাজা দিলীপ সিংহের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ কোহিনূর হীরাখণ্ডটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ভারতীয় ইতিহাসবিদদের মতে, জোর করে এই হীরা ব্রিটিশ নিয়েছিল। ইতিহাসবিদদের এ কথাটি সত্য নয়। কারণ ‘চুক্তি মোতাবেক উপঢৌকন’ হিসেবেই হীরক খণ্ডটি ব্রিটেনের রানীকে দেয়া হয়। কোহিনূরকে ভারতের নিজস্ব সম্পত্তি দাবি করে ব্রিটেন থেকে ফেরত আনার জন্য ওহফরধহ ঐঁসধহ জরমযঃং ধহফ ঝড়পরধষ ঔঁংঃরপব নামে একটি সংগঠন এবং ভারত সরকার দুটি মামলা করেছিল। ওই মামলায় প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট এ মর্মে রায় দেন যে, ‘ইংল্যান্ডের কাছ থেকে এই হীরা ফেরত চাওয়ার পেছনে কোনো আইনগত যুক্তি নেই। ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইংরেজদের কূটকৌশল ও পাঞ্জাবের রাজার দালালির ফলে অবিভক্ত ভারতের সম্পদ, বিশ্ববিখ্যাত কোহিনূর হীরা এখন ব্রিটেনের রানীর মুকুটে। দালালি ও তোষামোদ করে একশ্রেণীর লোক নানাভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে; কিন্তু কুঠারাঘাত করেছে দেশপ্রেমের চিন্তা, চেতনা, সম্পদ ও মানসিকতার ওপর।

ধনিক দালালরা দিনে দিনে নিজেদের এলিট শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায়। হাতেগোনা কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জনগণের ভূমিকাকে নগণ্য মনে করে তাদের থিওরি প্রকাশ করেছেন। ইতালিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গায়েটানো মস্কা রচিত জঁষষরহম ঈষধংং এবং জার্মান সমাজতাত্ত্বিক রবাট মিচেলসের প্রণীত চড়ষরঃরপধষ চধৎঃরবং বইতে স্বৈরশাসনের জন্ম হওয়ার পেছনে জনগণকে দায়ী করে মতবাদ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, জার্মান জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে ব্যবহার করে হিটলার জনগণের বিপুল সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু শাসনক্ষমতা নিয়েই হিটলার হয়ে গেলেন একজন খুনি, যিনি ছিলেন পৃথিবীর জঘণ্যে স্বৈরশাসক এবং একনায়কতান্ত্রিক অপশাসনব্যবস্থার উদ্ভাবক।

জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেমই মুক্তির সোপান, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতীয়তাবাদকে যে নেতৃত্ব শক্ত হাতে লালন করেছে সে নেতাকেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে হয় গুলিতে, নতুবা প্লেন ধ্বংস হয়ে নতুবা নিজ দেহরক্ষীদের হাতে। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র এবং এর সাথে মানবতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার একে অপরের সম্পূরক। গণতন্ত্র ক্ষমতাসীনদের ‘হাতের মোয়া’। যে যখন যেভাবে সম্ভব হয়েছে সেভাবেই গণতন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। গণতন্ত্র হয়ে পড়েছে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ নীতির অধীনস্থ। গণতন্ত্রের দর্শনকে ধর্ষণ করে গণতন্ত্রের ধারক-বাহকরাই। ফলে ‘গণতন্ত্র’ এখন এতই বিতর্কিত ও কুৎসিত হয়ে পড়েছে, যার দিকে গণমানুষ আর মুখ ফিরাতে চায় না। তাই মাইকিং করেও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার্থে গণমানুষকে এখন আর ভোটকেন্দ্রে নেয়া যায় না। ভোটাধিকার হারিয়েও তারা আর প্রতিবাদ করে না। ভোটকেন্দ্রে না যাওয়াকেই বঞ্চিতরা প্রতিবাদ মনে করছে। অন্য দিকে যারা ভোটাধিকারকে ধর্ষণ করছে এই অপকর্মে আত্মতৃপ্তিতেই ওদের ‘দাদাগিরি’। প্রতিবাদের সাথে ভয়, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা (নিজ ও পরিবারের), দরিদ্রতা বা প্রতিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রভৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ফলে ধর্ষিতা কন্যার পিতাও এর বিচারের জন্য এগিয়ে আসতে সাহস পান না। বিচারপ্রার্থী হলে পুলিশ ও সমাজের কাছে উপহাসের পাত্র হতে হয়। মিডিয়ার সৌজন্যে এসব সম্পদের কোনোটা প্রকাশ পায়, কোনোটা প্রকাশিত হয় না।

সাধারণ মানুষ এখন আর মিথ্যার প্রতিবাদ করতে সাহসী হয় না। কারণ যারা দেশের ভাগ্য বিধাতা, যারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে তারাই নিজ অপকর্মকে ঢাকা দেয়ার জন্য মিথ্যাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। মিডিয়া জানে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ডেকে বা ধরে নিয়ে হত্যা করে। কিন্তু সংবাদ প্রকাশ করা হয় যে, ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। এই ‘কথিত’ কথাটি একটি আবরণ মাত্র, যা সরকার ও রাষ্ট্র অহরহ ব্যবহার করছে ‘আইন’ নামক একটি ঢালকে ব্যবহার করে। যে রাষ্ট্রযন্ত্র ‘সত্য’ বলতে ভয় পেয়ে ‘মিথ্যা’কে সত্য হিসেবে বিনা প্রতিবাদে চালিয়ে দেয়, সেখানে দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন থাকাই স্বাভাবিক। জাতীয়তাবাদ ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা করে না, বরং চিন্তা করে সমষ্টিকে নিয়ে। রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার একটি অংশ শোষকের ভূমিকায়, অন্যটি শোষিত। এ ক্ষেত্রে শোষিতদের সংখ্যাই বেশি, কিন্তু সম্পদের সুষম বণ্টনের সুযোগ বা সিস্টেম না থাকায় অল্পসংখ্যক হয়েও শোষকরাই রয়েছে কর্তৃত্বের ভূমিকায়। কারণ আইন প্রযুক্ত হয় তাদের পক্ষে।
দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শাসক কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে জনগণের স্বার্থকে অবশ্যই মাথায় রেখে নির্দেশ জারি করবেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটে যখন জাতীয়তাবাদ থাকে মুখে আর ভূমিকা থাকে সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীগত এবং নিজের ক্ষমতাকেন্দ্রিক। সেখানে নৈতিকতার চিন্তাচেতনা চলে যায় ডাস্টবিনে।

সত্য মিথ্যার পার্থক্য বোঝা অনেক কষ্টকর। বুদ্ধিজীবীরা সমাজের সৌন্দর্য। জাতির সঙ্কটে বুদ্ধিজীবীদের দিকে সাধারণ মানুষ তাকিয়ে থাকে সত্যের একটু আশ্রয় পাওয়ার জন্য। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবী ‘ভাড়ায় পাওয়া যায়।’ কারণ তাদের অনেকে ‘সত্য’ কথা বলেন না বা বলতে চান না। তারা সে কথাটুকুই বলেন যে কথায় কর্তৃপক্ষ খুশি থাকবে, যার ফলে ভাগ্য প্রসন্ন হয়ে যাবে। হ
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)

 


আরো সংবাদ



premium cement