জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের জোর আপত্তির মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগের একটি আসনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তখন সরকারি ঘরানার অনেকেই এ বিরোধিতাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিরোধিতা বলে অখ্যায়িত করে নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনোত্তর সময়ে নিজেই হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভুলত্রুটি ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ সকালে আগারগাঁওয়ের ইটিআই ভবনে পঞ্চম উপজেলা নির্বাচন পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শীর্ষক প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের সময় বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি।
ইভিএমের ওপরে আমাদের আস্থা, বিশ্বাস নানা কারণে এ কথা আপনাদের সামনে আমরা বারবার বলেছি। যতœসহকারে এর প্রশিক্ষণ নেবেন এবং প্রশিক্ষণ দেবেন। নতুন একটা পদ্ধতি বলে এর কোথাও কোথাও কোনো ভুলভ্রান্তি হয়, মানুষের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়। সেটি আপনাদের ওপর নির্ভর করে।’ সিইসি আরো বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় আমরা ইভিএম ব্যবহার করেছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেটা কোথাও কোথাও ভুলত্রুটি ছিল, অসুবিধা ছিল।’ (সূত্র : জাতীয় দৈনিকসমূহ, ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ )
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্য সরল স্বীকারোক্তি নয়, জনগণের প্রতি তামাশা। ইভিএম কেনার বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। যথাযথ নিয়মে এ ইভিএম কেনা হয়নি বলে সভা-সেমিনারে যথেষ্ট অভিযোগ উপস্থাপিত হলেও এখন সিইসির স্বীকারোক্তি অর্থাৎ ইভিএম প্রয়োগে ভুল বলে সিইসির বক্তব্য গণমানুষের বিবেকে ছায়াপাত করবে কিনা জানি না, তবে সাংবিধানিক চেয়ারে বসে সিইসির বিবেক কী বলবে? সিইসি কি শুধু হুকুম তামিল করার জন্যই সাংবিধানিক চেয়ারে বসেছেন, নাকি জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য শপথ নিয়েছিলেন? এ প্রশ্ন একদিন না একদিন উপস্থাপিত হতেই হবে।
জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সিইসি যতই গলা উঁচিয়ে বলছেন, ততই অন্য কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন ভিন্ন কথা, যা সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী। ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ তিনি বলেছেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি, তাতে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সবার প্রতিবেদনে দু’টি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি শব্দ হচ্ছে- ‘সন্তোষজনক’ এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে ‘স্বাভাবিক’। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন খুবই সন্তোষজনক হয়েছে? এ ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কী, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার বিষয়ে আমি সব সময় গুরুত্বারোপ করেছি। এ গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে।’ (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ )
কমিশনের অন্য কমিশনারের বক্তব্যে ‘পাবলিক পারসেনশন’ ও ‘জনতার চোখ’ বলতে দু’টি কথা উঠে এসেছে। প্রশ্ন হলো- সরকার বা সাংবিধানিক চেয়ারওয়ালারা কি পাবলিক পারসেপশনের মূল্য দেন? এ দেশের পাবলিকের কী মূল্য রয়েছে, নাকি জনগণের অধিকার বাস্তবায়নে কারো কোনো দায়িত্ব আছে বলে তারা মনে করেন? অন্য দিকে জনতার চোখ কোথায় যেন হারিয়ে গেল? জনগণ যেন কারো প্রতি কোনো আস্থা রাখতে পারছে না, তাই অন্যায়-অত্যাচার দেখতে দেখতে তারা হয়রান হয়ে কি দৃষ্টিহীন না বিতশ্রদ্ধ হয়ে নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে? এত দিন ধারণা ছিল, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে, মিথ্যা দিয়ে সত্যকে শুধু ঢাকা তো পরের কথা, বরং মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ভাসিয়ে দেয়া যায়। নতুবা দিনের আলোর মতো সত্য, গণমানুষ যেখানে ভোট কাস্টিং করার সুযোগ পায়নি সেখানে ভোটের বাক্স ভরল কিভাবে? শেখ হাসিনা যাকে নমিনেশন দিয়েছেন তারই বাক্স ভরে গেছে। এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি লাঙ্গল মার্কায় নির্বাচন করেছে এবং তাদের প্রার্থীর নিয়মিত প্রচার করারো সুযোগ পেয়েছে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যার প্রতি গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন তাদের বাক্সই ভোটে জয়জয়কার হয়েছে। বাকিদের ভাগ্যে জুটেছে পুলিশের হয়রানি। পুলিশ নগ্নভাবে ভোটাধিকার হরণের যে ভূমিকা নিয়েছে, তারা পুরস্কৃতও হয়েছে সেভাবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ৬৪টি জেলার এসপিদের পুরস্কৃত করা হবে এবং ইতোমধ্যে তারা পুরস্কৃত হয়েছেন বটে।
বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ অনেকেই বলেছেন; এখনো বলছেন, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণতা পায় না। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের প্রধান দল আওয়ামী লীগ যার সবচেয়ে বড় শরিক দল এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি অনুষ্ঠানিকভাবে এখন বিরোধী দলে। আগে তারা সরকার ও বিরোধী দু’টি অবস্থানে ছিল। গণমানুষ তখন জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলত। এখন হয়তো সে কারণে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলেই রয়ে গেল। ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ রাজনৈতিক দলের চা-চক্র অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘১৪ দল আমার আসল জোট। এটা আমাদের আদর্শিক রাজনৈতিক জোট। এ জোট আছে, থাকবে।’ (সূত্র : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ জাতীয় পত্রিকা) ১৪ দলের সর্বোচ্চ নেতা শেখ হাসিনা নিজেই। একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া সবাই শেখ হাসিনার ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর মার্কা, প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ নিয়ে যারা কথিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, তারাই এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের আসনে বসবেন এটাই প্রধানমন্ত্রীর কথায় প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে সাংবিধানিক বিরোধী দল যা জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মতো ‘বিরোধী দল’ আর রইল না।
এমনিভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে সরকার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরও শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে উঠতে পারেনি। ভাঙা-গড়া, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বের লড়াই, পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রচেষ্টা, সামরিক শাসন, সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টেকসই হওয়ার আগেই পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও বিরোধী দল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি।
‘বিরোধী দল মানেই নির্যাতনের শিকার’ এ মনোভাব নিয়েই ’৪৭-এর পর থেকে রাজনৈতিক মঞ্চ মঞ্চয়ান্বিত হয়ে আসছে। যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, সে দেশগুলোর দিকে তাকালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বা বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠানিক অবস্থা খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট রানীর নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্ট। সেখানের ট্রেজারি বেঞ্চ (সরকারি দল) এবং বিরোধী দলেরও একটি ছায়া মন্ত্রিসভা থাকে এবং সরকারি ও বিরোধী উভয়ই রানীর। বিরোধী দলের ছায়া মন্ত্রিসভা থাকে। ছায়া মন্ত্রিসভার অনেক দায়িত্ব রয়েছে, যার দায়িত্ব সরকারের মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখা এবং যেখানে ব্যত্যয় ঘটবে সে বিষয় জনগণের সামনে তুলে ধরা, প্রতিবাদ করা, পরামর্শ দেয়া প্রভৃতি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই যে, আমাদের রাজনৈতিক বা পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় সে অবস্থা নেই।
তদুপরি একই জোটের বিরোধী দল হওয়ার সব কর্তৃত্বই এখন থাকবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কথিত বিরোধী দল ব্রিটেনের রানীর আদলে চলতে হবে, যা কাজ করবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃতাধীন ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধী দল হিসেবে। ফলে পার্লামেন্টারি পরিবেশে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ অবস্থানেই থাকবেন। এখন পার্লামেন্ট হবে সমালোচনা বা প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দু। হয়তো দেখা যাবে, প্রতিবাদকারীদের দমানোর জন্য রাজপথে গুলি হয়েছে; কিন্তু পার্লামেন্টে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখার জন্য কেউ নেই। (ক্রমশ)
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা