১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


বৈশাখের পঙ্ক্তিমালা

-

বাংলা ঋতুচক্রে বৈশাখ একটি মাস, এই মাস দিয়েই বাংলা বর্ষগণনা শুরু হয়। অন্য মাসগুলো বা ঋতুর যে গুরুত্ব তা থেকে এই মাসের গুরুত্ব নানা কারণে আরো বেশি। আসলে বিরাজমান জীবনে ও প্রকৃতিতে যে মাস যত বেশি প্রভাব বিস্তারি সে তত বেশি সাহিত্যকে আলোড়িত করে। বৈশাখ প্রকৃতিতে একদিকে নিয়ে আসে ধ্বংস-বিনাশ-গতি-ক্ষতি-তাণ্ডব, অন্য দিকে নতুনের জয়োগান-জয়োল্লাস, সবুজ পল্লবিত তারুণ্য। একই সঙ্গে বৈশাখ বয়ে নিয়ে আসে সমূহ ধ্বংস ও জাগরণ, প্রলয় ও সৃষ্টি, বিনাশ ও জাগৃতি। এসব কারণেই বৈশাখ সাহিত্যে, বিশেষভাবে বাংলা কবিতায় যুগে যুগে দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।

১.
বাংলা কবিতা সবসময় প্রকৃতি ও জনজীবনলগ্ন। প্রকৃতিতে যখন বৈশাখী ঝড় এসে মাঠের ফসল, গাছপালা, খড়ের চাল লণ্ডভণ্ড করে দেয়; তখন স্বাভাবিকভাবে কবিতায় সেসবের চিহ্ন পড়ে প্রবলভাবে। মধ্যযুগের কবিরা তাদের সৃজনকর্মে বৈশাখের অশনি সঙ্কেত, ভয়ঙ্কর রূপ ও সৃষ্টির সম্ভাবনার চালচিত্র এঁকেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আধুনিক কবিতায়ও বৈশাখ যথেষ্ট প্রভাবশালী। বিহারিলাল, কায়কোবাদ, ঈশ^রচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, জসীমউদদীন, সুফিয়া কামাল, আবদুল কাদির প্রমুখ আধুনিক কবিতায় বৈশাখকে নানা বর্ণে-গন্ধে ও রূপে উপস্থাপন করেন। বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথ একধিক কবিতা ও গান লিখে এই ধারাকে জনপ্রিয় ও প্রভাববিস্তারি করে তোলেন। বৈশাখকে কবি আহŸান করেছেন নতুন সম্ভাবনা ও পুরনোর বিদায় হিসেবে।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপ নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক \
থাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রæবাষ্প সুদূরে মিলাক \
এই গান বৈশাখ উদযাপনের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে সাংস্কৃতিক সমাজে ঝঙ্কৃত। এ ছাড়াও তাঁর বেশ কিছু কবিতা আছে সরাসরি বৈশাখকেন্দ্রিক। সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক বাতাবরণে এই কবিতা ও গানগুলো বহুভাবে ব্যবহৃত। রবীন্দ্রপ্রভাব ছিন্ন করে মৌলিক ও শক্তিমান একটি ধারার প্রতিষ্ঠাকারি কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈশাখকে নতুন রূপ দেন। শক্তি, নতুনত্ব, প্রলয়, বিনাশ ও সৃজনের প্রতীক হিসেবে বৈশাখকে কবি হাজির করেন পাঠকের সামনে। কবি ‘প্রয়োল্লাস’ কবিতায় যেমন উচ্চারণ করেন :
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয় ধ্বনি কর
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে
কাল বৈশাখীর ঝড়।
নজরুল সবসময় চেয়েছেন নতুন শক্তির উদ্ধোধন, পুরাতনের বিলয়ের মাধ্যমে একটি মানবিক শোষণমুক্ত পৃথিবী নির্মাণ। রুদ্র, অশান্ত, বিপ্লবী ও বিদ্রোহী নজরুল আপন প্রকৃতির মতোই বৈশাখকে কল্পনা করেন। বাংলা কবিতায় ঐতিহ্যবাদ, মানবমুক্তি, সমকালীন জীবন সঙ্কটের সমাধানে একাই হয়ে উঠেছেন একটি পৃথক ধারার নির্মাতা। বাংলাদেশের কবিতার অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল কবি জসীমউদ্দীন বৈশাখকে নিয়ে নিজস্ব ভাব ও ভাষায় অভিমত প্রকাশ করেছেন-
বোশেখ শেষে বালুচরের
বোরো ধানের ধান
সোনায় সোনা মিলিয়ে দিয়ে
নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।
জসীমউদ্দীন বাংলার জীবিকানির্ভর প্রকৃতি ও তৃণমূল মানুষের জীবন-সংস্কৃতির অমানান্য শিল্পী। ঋতুভিত্তিক কবিতায় তাঁর বিশেষত্ব উল্লেখযোগ্য এবং বৈশাখ নিয়ে তাঁর কবিতাগুলো স্মরণীয়। জীবনানন্দ দাশ একজন জীবন ও নিসর্গের একনিষ্ঠ কবি। তাঁর কবিতার গভীরতা ও ব্যাপকতা অতলান্তিক। তাঁর বৈশাখ নিয়ে কবিতা আলাদা ঢঙের-
বৈশাখের মাঠের ফাটলে
এখানে পৃথিবী অসমান।
আর কোনো প্রতিশ্রæতি নেই।
কেবল খড়ের স্ত‚প পড়ে আছে দুই-তিন মাইল
তবু তা সোনার মতো নয়;
কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে
করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়।
এভাবে আধুনিক বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ থেকে তিরিশের কবিরা পর্যন্ত বৈশাখ নিয়ে স্বকীয় কিন্তু সমবায়ী একটি মনোভাব সৃজন করেন, যা স্বদেশী সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতারই পরিচয়।

২.
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান বা পূর্ব-বাংলার যাত্রা শুরু। কলকাতায় বসবাসকারী বাঙালি মুসলমান কবিদের অধিকাংশই ঢাকায় চলে আসেন এবং পুরোদমে কাব্যচর্চা করতে থাকেন। কয়েক বছরের মাঝেই ভাষা আন্দোলন কবিতার অঙ্গনকে আরো প্রাণচঞ্চল ও উদ্দীপ্ত করে তোলে। দেশবিভাগ-উত্তর কালে পূর্ববাংলায় রাজনৈতিক সঙ্কটের সাথে সাথে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতেও নানামুখী তৎপরতা লক্ষণীয়। প্রথমত, রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্ন যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তা নিজেদের আত্মপরিচয়ের জায়গায় এসে পৌঁছে। পূর্ববাংলার ভাষা-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের প্রকৃতি, স্বরূপ ও ভিত্তি কীরূপ হবে সেগুলো নিয়ে মূলত দ্বিমুখী চিন্তা ও কর্ম-উদ্যোগ হয়েছে নানা সময়ে। এক দিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ অনুসারে সব কিছু সৃষ্টির কর্মপ্রেরণা; অন্য দিকে বাঙালিত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টির আয়োজন। ফলে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে ও সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। একুশে ফেব্রæয়ারির রক্তাক্ত ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; তা এক দিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চারিত্র্য ও ভবিষ্যৎ ঘটনাবলির ইঙ্গিতবহ। স্বপ্নভঙ্গে ব্যথিত, বিমূঢ় ও উত্তেজিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেদিন গভীর আবেগে মাতৃভাষার মর্যাদাকে স্বকীয়তা ও অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখেছিল। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রæয়ারি’ সঙ্কলনের যা নিজস্বতা, তা বস্তুত এই আন্দোলনেরও বৈশিষ্ট্য। এই আন্দোলন যেমন ভবিষ্যৎ সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলির ওপরে ছায়াপাত করেছিল, এই সঙ্কলনও তেমনি বাংলাদেশের পরবর্তী কাব্যসৃষ্টির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অধিকাংশ কবি পূর্ববাংলার প্রকৃতি ও জনজীবনলগ্ন কবিতা আপনাপন কাব্যভাষায় লিপিবদ্ধ করেন। এই সময়ে প্রচুর পত্রপত্রিকা প্রকাশ পায়Ñসওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, দিলরুবা, মাহে-নও, সমকাল, উত্তরণ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক আজাদ, সাপ্তাহিক সৈনিক, নও-বাহার, প্রবাহ, যাত্রিক, সীমান্ত, পরিচিতি প্রভৃতি। এসব পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অজস্র কবি কাব্যচর্চা শুরু করে। বিশেষভাবে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত সময়ে কবিতার জোয়ার আসে বিপুল উদ্দীপনা ও স্বতঃস্ফ‚র্ত চেতনায়। এই সময়ের কবিরা হলেনÑ সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন (জ.১৯২১), আবদুল গনি হাজারী, আশরাফ সিদ্দিকী (জ.১৯২৭), আবদুর রশীদ খান (১৯২৭), আবদুস সাত্তার (১৯২৭-২০০২), আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬), আহমদ রফিক (জ.১৯২৯), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯), মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ (জ.১৯৩৬), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩), জাহানারা আরজু (জ.১৯৩২), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১), সৈয়দ শামসুল হক (জ.১৯৩৫), আল মাহমুদ (জ.১৯৩৬), জিয়া হায়দার (জ.১৯৩৬), ফজল শাহাবুদ্দীন (জ.১৯৩৬), বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (জ.১৯৩৬) আবুবকর সিদ্দিক (জ.১৯৩৬), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (জ.১৯৩৯), ওমর আলী (জ.১৯৩৯), শহীদ কাদরী (জ.১৯৪০) প্রমুখ। সময় ও সমাজ বাস্তবতার কারণে পঞ্চাশের কবিরা হয়ে ওঠে সমকাললগ্ন ও শেকড়সন্ধানী। ফলে রোমান্টিকতা, সংক্ষোভ, প্রতিবাদ, ইতিহাস-অন্বেষা, আত্ম-আবিষ্কার প্রভৃতি যেমন তাদের কবিতায় বিদ্যমান; তেমনি স্বপ্নময় স্মৃতি, কল্পনা এবং ভাবলোক-বস্তুলোকের দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত-উদ্ভূত কবিতাও উল্লেখযোগ্য। চল্লিশ ও পঞ্চাশের কবিরা মিলিত হয়েছে একুশের একই মোহনায়। ফলে বৈশাখের মতো নিজস্ব সংস্কৃতির অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দেয়টাই স্বাভাবিক ব্যাপার।

১৯৫৮-র একনায়কত্বের অবসানে, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে এবং ৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় জীবনে আবার উজ্জীবনের যে জোয়ার আসে তা ষাটের দশকের শেষ পর্বের কবিতায় স্বাক্ষরিত হয়ে আছে। সে জন্য সমাজ ও সময় বাস্তবতার কারণে ষাটের দশকের কবিরা প্রাথমিকভাবে আত্মমুখী; কিন্তু পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে বহির্মুখী, সমকাল ও সমাজলগ্ন। ফলে কবিতা সৃজনে তারা সমগ্র দেশ, জনতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ব্যবহার করতে উৎসাহী। স্বাভাবিকভাবে কবিতা নির্মিত হতে থাকে ঐতিহ্যময় সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গের গাঁথুনিতে। এই দশকের উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন :
মোহাম্মদ রফিক (১৯৩৫), বেলাল চৌধুরী (১৯৩৮), আফজাল চৌধুরী (১৯৪২-২০০৪), রফিক আজাদ (১৯৪৩), আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০), আসাদ চৌধুরী (১৯৪৩), মহাদেব সাহা (১৯৪৪), নির্মলেন্দু গুণ (১৯৪৫), ফরহাদ মজহার (১৯৪৫), হুমায়ুন কবীর (১৯৪৮), মুহম্মদ নূরুল হুদা (১৯৪৯), হেলাল হাফিজ প্রমুখ।
মূলত পঞ্চাশের কবিদের সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হয় ষাটের দশকে। যার কারণে ষাটের দশক হয়ে ওঠে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিদের সৃষ্টি-মোহনা। অর্থাৎ প্রবহমান ধারার মিলনক্ষেত্র। তাই এই কালপর্ব বাংলাদেশের কবিতার সবচেয়ে ‘উর্বর’ ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। এ সময় পশ্চিম বাংলার ‘কৃত্তিবাসে’র আদলে প্রকাশিত হয় বেশ কয়েটি পত্রিকা।
এগুলো হলো : ‘কণ্ঠস্বর’, ‘স্বাক্ষর’, ‘সা¤প্রতিক’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘বক্তব্য’, ‘যুগপৎ’, ‘স্যাড জেনারেশন’ প্রভৃতি। এই পত্রিকাগুলোকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকের কবিতা বিস্তৃত হতে থাকে নিজস্ব কণ্ঠস্বর নিয়ে।
ষাটের কবিরাও বৈশাখের নানামাত্রিক উপস্থাপন করেন নিজ নিজ আঙ্গিকে। চল্লিশের শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ বৈশাখ ও ঝড় নিয়ে কালজয়ী কবিতা লেখেন। বিশেষভাবে তাঁর ‘বৈশাখ’ কবিতাটি বাংলা কবিতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিবতা। একশত সাঁইত্রিশ লাইনের কবিতাটি এককথায় অবিস্মরণীয় :
ধ্বংসের নকীব তুমি দুর্বার, দুর্ধর্ষ বৈশাখ
সময়ের বালুচরে তোমার কঠোর কণ্ঠে
শুনি আজ অকুণ্ঠিত প্রলয়ের ডাক \
চৈত্রের বিশীর্ণ পাতা রেখে গেছে শেষ চিহ্ন সালতামামীর,
ফাল্গুনের ফুলদল [কোকাফের পরী যেন] আজ শুধু কাহিনী স্মৃতির,
খর রৌদ্রে অবসন্ন রাহী মুসাফির যত পথ- প্রান্তে নিঃসাড়, নিশ্চল,
আতশের শিখা হানে সূযরশ্মি লেলিহান, ঝিমায় মুমূর্ষু পৃথ্বিতল,
রোজ হাশরের দগ্ধ, তপ্ত তা¤্র মাঠ, বন মৃত্যুমুখী, নিস্তব্ধ, নির্বাক;
সূরে ইস্রাফিল কণ্ঠে পদ্মা মেঘনার তীরে
এস তুমি হে দৃপ্ত বৈশাখ \
এ ধরনের অসামান্য কবিতা বাংলা কবিতায় সত্যি বিরল। নতুন এক ভাষ্য ও ভাষা হাজির করেন কবি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে। পরবর্তীকালে পঞ্চাশের কবিরা বৈশাখের অন্য এক প্রকাশভঙ্গি নির্মাণ করেন। শামসুর রাহমানের কবিতায় বৈশাখ এসেছে নাগরিক ভঙ্গিতে-
রাত্রি ফুরালে জ্বলে ওঠে দিন
বাঘের থাবায় মরছে হরিণ
কাল বোশেখের তাণ্ডবে কাঁপে পড়ো পড়ো চাল
শূন্য ভাঁড়ারে বাড়ন্ত চাল ইচ্ছে তার ইচ্ছে।
অন্য দিকে বৈশাখের শক্তি ও নতুনত্বের মাধ্যমে কবি সৈয়দ শামসুল হক তার ‘বৈশাখ’ কবিতায় নতুন জগৎ ও দৃষ্টি নির্মাণ করেন। কবি নিজেকে উন্মোচিত ও উদ্বোধিত করেন বাংলার ঐতিহ্যেও ভেতর দিয়ে-
আমি কে
আমি পারিনে চিনতে আজ
কি অবাক কি অবাক
পুরোনো আমাকে নতুন নতুনে
সাজিয়েছে বৈশাখ
দুচোখ আমার নতুন নীলিমা
নতুন পৃথিবী ডাকে
দেখি বারবার উৎসব দিনে
বাংলায় বাংলা।
বর্তমান বাংলা কবিতার প্রধান কবি আল মাহমুদ বৈশাখ নিয়ে অভিনব কথামালা সৃষ্টি করেন। ‘বোশেখ’ নামের কবিতায় কবি বিনাশ ও নিমার্ণের উচ্চারণ করেনÑ
যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়
জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে
নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছড়িয়ে
নুইয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে।
সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি
তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী,
গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?
কী সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষীর ভিটে?
বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের
উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি
হে দেবতা, বলো তোমার কী আনন্দ,
কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?
আল মাহমুদের কবিতা মানেই বাংলাদেশের মাটি-মানুষ-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা যা বাংলা কবিতায় এক নতুন বাঁক ও ভঙ্গি। সৈয়দ শামসুল হকের ‘বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা’ এবং মোহাম্মদ রফিকের কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। ষাটের দশকে কবি রফিক আজাদ নতুন এক জীবনবোধ ও ভঙ্গি নিয়ে কবিতায় আসেন এবং উচ্চারণ করেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
পয়লা বৈশাখ তুই বুক বেঁধে আশার আঁচলে
নতুন দিনের স্বপ্নে মগ্ন হোস বিদ্যুৎ বিভায়!
জীবনবাদী নাগরিক কবি আবিদ আজাদ ‘বৈশাখের স্মৃতি’ কবিতায় উচ্চারণ করেন :
বৈশাখের কথা মনে হলেই আমার
মনে পড়ে যায়
সবুজ পাতার চাপা-গুঞ্জন
বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ফেরারি এক
যুবকের কথা
মনে পড়ে স্বপ্নের হয়রানি নিয়ে সেই
কথন ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্ট ইস্টিশান
মনে পড়ে হলুদ দেয়ালের
পাশে ক্লান্ত-
হয়ে দাঁড়ায়ে আছে বসন্তের
ঠেলাগাড়ি সামনেই
ফুটপাতে উড়ছে ছেঁড়া কাগজ,
ছেঁড়া মেঘ, ছেঁড়া তাবু আর
ছেঁড়া ফাড়া অনেক মানুষ...।
কবিতায় সদামগ্ন কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ ‘বৈশাখের মাতাল হাওয়ায় উড়ো চিঠি’তে নিসর্গ ও সংস্কৃতির উৎসঙ্গে লেখেন :
এই বৈশাখে একী খেলা
কলসের মুখে বসে আছে ডাব
টবিলে রয়েছে লালখাতা-হালখাতা
এবার বৈশাখে উড়ে গেছে কার ছাতা?
হাসান হাফিজ অন্য সুরে ‘এসো বৈশাখ তৃষ্ণার শান্তি’ কবিতায় অর্জিত মনোভাব ব্যক্ত করেন :
মৌন তাপস তুমি রৌদ্রজ্বলা তেলরঙে ছবি
প্রখর তৃষ্ণায় এক শান্তির চুমুক
বৈশাখ তুমি তো দোলো ভাসমান মেঘের ভেলায়
শুভ্রতার আকাক্সিক্ষত রূপকথা
দিগন্তের ছবি দূরাভাস।
ঐতিহ্যবাদী কবি মোশাররফ হোসেন খান বৈশাখ নিয়ে জীবনের নতুন স্বপ্ন-সম্ভাবনার কথা বলেছেন এবং পুরনো দিনের পরাজয়-গøানি মুছে ফেলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সকল জীর্ণতা দীর্ণ
করে তুমি এসো হে বৈশাখ
এসো উত্তপ্ত বদ্বীপে, সবুজ পল্লবে,
নবরূপে
এসো স্বপ্ন-সম্ভাবনা বুকে নিয়ে,
এসো বারবার,
মুছে দাও ব্যর্থতার যত গøানি,
জীবনের ভার।
কবি আগামীর আবাহন ও পুরনো দিনের পরাজয় মুছে নতুজ দিনের স্বপ্ন নির্মাণে প্রত্যয়ী। বৈশাখ নিয়ে আরো কত শত পঙ্ক্তি রচনা করেন পরবর্তীকালের কবিরা। আশি, নব্বই ও প্রথম দশকের অনেক কবি বৈশাখ নিয়ে বিচিত্র কবিতার ধারা সৃষ্টি করেন। আবদুল হাই শিকদার, রেজা ফারুক, মনজু রহমান, জাফরুল আহসান, সোলায়মান আহসান, হাসান আলীম, মুকুল চৌধুরী, শাহীন রেজা, চৌধুরী গোলাম মওলা, রহমান হেনরি, সায়ীদ আবুবকর, আমিনুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, জাকির আবু জাফর, মনসুর আজিজ, ওমর বিশ^াস, খুরশীদ আলম বাবু, মহিবুর রহিম, মৃধা আলাউদ্দিন, সৈয়দ সাইফুল্লাহ শিহাব, কাজী নাসির মামুন, ফজলুল হক তুহিন, আহমদ বাসির, আফসার নিজাম, রেদওয়ানুল হক, মঈন শেখ, হাসনাইন ইকবাল প্রমুখ বৈশাখ নিয়ে স্বকীয় ভাবনা ও ভাষার চালচিত্র আঁকেন।

৩.
বাংলা সনের সূচনা প্রথমে বৈশাখ দিয়ে ছিল না। সম্রাট আকবর প্রচলিত ধারা বদলে দিয়ে খাজনা আদায়ে সুবিধা ও হালখাতার জন্য প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখকে নির্ধারণ করেন। বৈশাখ আমাদের লোকজীবন ও সংস্কৃতিতে নানা ধরনের ভূমিকা রাখে। হালখাতা ছাড়াও লোকমেলা, লোকখেলাসহ নানান আয়োজন হয়। যদিও বৈশাখ গ্রামীণ মানুষের জীবনে অনেক সময় অজানা শঙ্কা নিয়ে আসে। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো, সিডর ইত্যাদির আতঙ্কে মানুষের মন কেঁপে ওঠে। বর্তমান সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে, গণমানুষের বিবেক-বুদ্ধিতে, মননে-মনে জনগণের জীবন ও মননে একটা বিশাল বৈশাখী ঝড়ের প্রয়োজন। কারণ এখানে এখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমানুষের নাগরিক অধিকার, স্বাভাবিক পরিবেশ বিপন্ন। সাহিত্য-সংস্কৃতিও স্বদেশের মাটি-মানুষ-ঐতিহ্য থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। যেহেতু বৈশাখ মানেই স্বাদেশিক ঐতিহ্য-অন্বেষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে; সেহেতু বৈশাখের প্রকৃত স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই জীবন ও সংস্কৃতির অঙ্গনে আগামীর স্বপ্ন-সম্ভাবনা সফল হবে এবং পুরনো গøানি-পাপ-আবর্জনা দূর হবে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
টেবিল টেনিসে রুমেল খানের দ্বিমুকুট জয় ২৮ দিন ধরে নিখোঁজ অটোরিকশাসহ চালকের সন্ধান চায় তার পরিবার ৭ মাসে ইসরাইলি হামলায় ৩৫৩৮৬ ফিলিস্তিনি নিহত বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা হারাবে : কর্নেল অলি ‘জেলা পরিষদই নির্মাণ করবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’ ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম দেবিদ্বারে বিরিয়ানির প্যাকেট আনতে গিয়ে ট্রাক্টরচাপায় শিশু নিহত কিরগিজস্তানে বাংলাদেশী, ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা বাংলাদেশ ব্যাংক কি নিষিদ্ধ পল্লী : প্রশ্ন গয়েশ্বরের গাজীপুরে জীপের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত আইন পেশাকে সংগ্রামের অংশ হিসেবে নিতে হবে : মিয়া গোলাম পরওয়ার

সকল