১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


পিথাগোরাসকে নিয়ে যত রহস্য

পিথাগোরাসকে নিয়ে যত রহস্য - সংগৃহীত

পিথাগোরাস, নামটি শুনলেই অনেকের মাথায় অবধারিতভাবে চলে আসে পিথাগোরাসের উপপাদ্য। গণিত পড়তে গিয়ে পিথাগোরাসের সাথে পরিচিত না হয়ে উপায় নেই।

যদিও সমকোণী ত্রিভুজের তিন বাহুর মধ্যকার সম্পর্কের জটিল এই জ্যামিতিক সূত্র তারই আবিষ্কার কি-না এ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে।

এর পক্ষে যেমন কোনো নিরেট প্রমাণ নেই, তেমনি এটা বাতিল করে দেয়ার মতো তথ্যও পাওয়া যায় না।

আসলে পিথাগোরাস লোকটাই এমন। তিনি কে; গণিতজ্ঞ, দার্শনিক নাকি ধর্মীয় গুরু? তিনি দেখতে কেমন ছিলেন? তার কি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ছিল?

এসব প্রশ্নের নিশ্চিত কোনো উত্তর মেলে না। তাইতো তার জীবন-দীক্ষা-মৃত্যু সবই যেন এক অমীমাংসিত রহস্যে ঢাকা।

পিথাগোরাসের জন্ম ও বেড়ে ওঠা
পিথাগোরাস সম্পর্কে যে তেমন কিছু জানা যায় না, এর বড় কারণ তার জীবদ্দশায় তিনি নিজে বা তাকে নিয়ে অন্য কেউ কিছু লিখে যায়নি।

ব্রিটানিকা বলছে, পিথাগোরাস সম্পর্কে মানুষ জানতে পারে তার মারা যাওয়ারও দেড় শ’ বছর পর।

প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের ওপর তার বিরাট প্রভাব ছিল। এই দুজন বিভিন্ন সময় পিথাগোরাসের উল্লেখ করেন। এছাড়া পরবর্তীতে অন্যান্য দার্শনিকদের লেখা থেকেও পিথাগোরাস সম্পর্কে জানা যায়।

তার জন্মের সময়কাল নিয়ে কিছুটা দ্বিমত আছে। তবে বেশিভাগের ধারণা, ৫৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্ম তার। যদিও তার জন্মস্থানের ব্যাপারে একমত ইতিহাসবিদেরা, আর সেটা হল প্রাচীন গ্রিসের সামোস। মনে করা হয়, তার মা ছিলেন ওই দ্বীপেরই বাসিন্দা আর বাবা ছিলেন প্রাচীন শহর টায়ারের একজন বণিক।

তবে পিথাগোরাসকে নিয়ে যত মিথ আছে তার মধ্যে একটা হলো তিনি সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর সন্তান। তার অনেক জীবনীকার লিখেছেন, পিথাগোরাসের জন্মের আগেই তার মা-বাবাকে এক সাধু বলে যান তাদের ছেলে জ্ঞান ও দর্শনে পৃথিবীর অন্য সব মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে।

অ্যারিস্টটলের এক শিষ্য পিথাগোরাস মারা যাওয়ার কয়েক শতক পরে তাকে নিয়ে লেখেন, ‘পিথাগোরাস ছিলেন খুবই লম্বা এবং অভিজাত দেখতে।’

জ্ঞান আহরণের জন্য পিথাগোরাস অল্প বয়সেই মিসর যান। কোনো কোনো জীবনীকারের মতে, সেখানে তিনি এক ফারাওয়ের কাছ থেকেই মিসরীয় ভাষা শেখেন।

সেখান থেকে ব্যাবিলনে যান পিথাগোরাস। আর সেখানেই ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্যে’র সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। এরপর সামোসে ফেরত আসেন পিথাগোরাস ও সেখানে একটা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে পিথাগোরাস সম্পর্কে বলা হয়, ৫৩২ খ্রিস্টপূর্বের দিকে তিনি সামোস থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন নেন, সেখানকার স্বৈরশাসন থেকে পালিয়ে ইতালিতে যান পিথাগোরাস। তার জীবনের বাকি অধ্যায় সেখানেই।

পিথাগোরাসের উপপাদ্য অনুসারে, সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ, এর লম্ব ও ভূমির বর্গের যোগফলের সমান। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় জ্যামিতিক সূত্র এটি। কিন্তু এই সূত্র কি পিথাগোরাসই প্রমাণ করেছিলেন?

পিথাগোরাস ওয়েবসাইটে এ নিয়ে সুইডিশ গণিত বিশেষজ্ঞ সাইমন রেব্রান্ড লেখেন, ‘এর কৃতিত্ব পিথাগোরাসকে দেয়া হলেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে তিনিই প্রথম এটি সমাধান করেন।’

পিথাগোরাসের আগেই এই উপপাদ্য ব্যবিলনীয়রা ও চীনা গণিতবিদরা সমাধান করেন বলে এখানে বলা হয়। তবে এটা জানা যায় না যে এই জ্যামিতিক সূত্র কি একবারই আবিষ্কার হয়েছে নাকি বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আবিষ্কার হয়েছে।

ধারণা করা হয়, পিথাগোরাস যেহেতু ব্যাবিলনে গিয়েছিলেন এবং তিনি সেখান থেকে এটি শিখে এসে গ্রিসের মানুষদের মাঝে তা ছড়িয়ে দেন এবং পরবর্তীতে গ্রিস থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ে তাকেই এর কৃতিত্ব দেয়া হয়। আর এভাবেই বিশ্বজুড়ে এটি পরিচিতি পায় ‘পিথাগোরাসের উপপাদ্য’ হিসেবে।

পিথাগোরাসের দর্শন
পিথাগোরাস সম্পর্কে রিপলিস বলছে, ‘আজ আমরা পিথাগোরাস সম্পর্কে যা জানি তার বেশিভাগই এসেছে প্লেটো, অ্যারিস্টটলসহ অন্য লেখকদের লেখা থেকে।’

প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের ওপর পিথাগোরাসের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং তারা দুজনই নানা দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তায় পিথাগোরাসের অবদানের কথা উল্লেখ করেন।

পিথাগোরাস ‘মেটেমসাইকোসিস’ বা ‘পুর্নজন্মে’ বিশ্বাস করতেন। অর্থাৎ আত্মা অবিনশ্বর এবং তা এক দেহ থেকে অন্য দেহে প্রবেশ করতে পারে। যার মানে মানুষ মারা যাওয়ার পর তার আত্মা অন্য শরীর এমনকি সেটা পশু পাখির শরীরেও প্রবেশ করতে পারে।

পিথাগোরাসের জীবনীতে দার্শনিক পরফেরি লেখেন, ‘পিথাগোরাস বিশ্বাস করতেন যাদের আত্মা আছে তারা সবাই এক।’

স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফিতে বলা হয়, কারো কারো মতে পিথাগোরাসই ‘দর্শন’ শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বোঝাতে।

পিথাগোরাস মহাবিশ্বে বিশ্বাস করতেন। তার মতে, প্রতিটি বস্তুর পেছনে সংখ্যা আছে এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে সংখ্যাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে।

তার এসব চিন্তাধারা গণিত ও পশ্চিমা দর্শনে পরবর্তীতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।

পিথাগোরাসের ভীষণ সংগীত প্রেমও ছিল। এমনকি মনে করা হয় তিনিই প্রথম যিনি চিকিৎসার জন্য সংগীত বা সুর ব্যবহারের কথা বলেন।

পিথাগোরিয়ান
পিথাগোরাস যখন জন্মভূমি গ্রিসের সামোস থেকে ইতালিতে চলে যান, সেখানে আস্তে আস্তে তার অনুসারী তৈরি হতে থাকে।

দক্ষিণ ইতালির ক্রোতোনে তিনি গণিত নির্ভর দর্শন শেখাতে শুরু করেন। শিগগিরই তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, যারা কঠোর জীবন আচারের মধ্যে ঢুকে যায়। আর তাদের পরিচিতি হয় পিথাগোরিয়ান হিসেবে। তবে তারা খুবই গোপনে তাদের পড়াশোনা ও কার্যক্রম চালাতে থাকে।

শুরুর দিকে এই পিথাগোরিয়ানরা ছিল উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এবং রাজনীতি সচেতন। তাদের বিশ্বাস ছিল, অমরত্ব পেতে হলে ও আত্মাকে মুক্ত করতে হলে শরীরকে কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যে রাখতে হবে। যেন নৈতিকভাবে একেবারে বিশুদ্ধ থাকা যায়।

ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি বলছে, তিনিই প্রথম গোশত গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা দেন এবং তার অনুসারীরা পুরোপুরি নিরামিষভোজী হয়ে উঠে।

এছাড়া যেকোনো ধরনের শিম, মটরশুটি বা বিচিজাতীয় খাবার গ্রহণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল পিথাগোরিয়ানদের জন্য।

আর সেটাই শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর জন্য কাল হয়ে উঠে বলে পরবর্তীতে জানা যায়।

পিথাগোরাসকে নিয়ে যত মিথ
পিথাগোরাসের একটা উরু ছিল স্বর্ণের, তাকে নিয়ে বহুল প্রচলিত ধারণার একটি ছিল এটি। এর কারণ হিসেবে বলা হয় যেহেতু তিনি সূর্যদেবতার ঐশ্বরিক সন্তান তাই তার একটি উরু সোনায় মোড়ানো।

যে কথা অ্যারিস্টটলও বলেছেন বলে জানাচ্ছে স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি।

পিথাগোরাসকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত মিথ হচ্ছে, তাকে একই দিনে একই সময় ইতালির দুই ভিন্ন শহর ক্রোতোন ও মেটাপনতামে দেখা গিয়েছে।

আবার তিনি যখন কাসাস নদী পাড়ি দেন, ওই সময় নদী তার সাথে কথা বলে বলেও শোনা যায়, এক দৈববাণী তাকে ‘শুভ সকাল’ বার্তা দিয়েছিল।

একবার এক মারাত্মক বিষধর সাপকে কামড় দিয়ে মেরে ফেলেন পিথাগোরাস। আর আরেকবার এক ভালুক এসে শহরে হানা দিলে তিনি সেটাকে ফলমূল আর বার্লি খাইয়ে শান্ত করেন এবং ভালুকের থেকে কথা আদায় করেন যে সে আর কখনো জীবন্ত কোনো প্রাণীর ওপর হামলা করবে না।

পিথাগোরাসের মৃত্যু
পিথাগোরাসের জীবনের মতো মৃত্যু নিয়েও নানা গল্প আছে।

তার পরবর্তী দিকের জীবনীকাররা লেখেন, স্বৈরশাসন থেকে পালিয়ে ইতালি এসে মধ্যবয়সে পিথাগোরাস নিজেই স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন।

ব্রিটানিকা বর্ণনা করছে, একসময় ক্রোতোনে পিথাগোরিয়ান-বিরোধী মনোভাব জেগে উঠে, ফলে ৫১০ খ্রিস্টপূর্বে তিনি পালিয়ে মিটাপনতাম (বতর্মান ইতালির মেটাপনতো) শহরে চলে যান।

সেখানেও দ্রুত তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু বিপত্তি বাধে গ্রিসের এক ধনী অভিজাত পরিবারের সন্তানের পিথাগোরিয়ান গোষ্ঠীতে যোগ দেয়া নিয়ে। কঠোর অনুশাসন ও সমস্ত নিয়ম মানা তার পক্ষে সম্ভব হবে না ভেবে তাকে অন্তর্ভুক্ত করেননি পিথাগোরাস।

সেই ছেলেটি পরে শহরের লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলে পিথাগোরাসের বিরুদ্ধে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেশ চাপের মধ্যে পড়ে পিথাগোরিয়ানদের কেউ কেউ পালাতে থাকে, অনেকের মৃত্যুও হয়।

ব্রিটানিকা অনুযায়ী, ৪৯০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে পিথাগোরিয়ানদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উপচে পড়ে। তাদের আস্তানায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও হামলা শুরু হয়। সৌভাগ্যক্রমে সেখান থেকে পালাতে পারেন পিথাগোরাস। কিন্তু শহর ছেড়ে পালাতে গিয়ে তিনি পড়ে যান এক মটরশুঁটি ক্ষেতের সামনে।

এখন তার সামনে উপায় ছিল মটরশুঁটি ক্ষেত মাড়িয়ে দৌড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু পিথাগোরাসের বিশ্বাস ছিল, মটরশুঁটি হরো মৃতদের আত্মা বহন করে, তাই তাদের খেয়ে ফেলা বা ক্ষতি করা মানে আত্মার ক্ষতি। তার বিশ্বাস, তার অনেক বন্ধুই আছে এসব মটরশুঁটির ভেতর।

ফলে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন ও পেছন থেকে আক্রমণকারীরা এসে তাকে হত্যা করে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
গাজা সীমান্তে মিসরের সামরিক বহর মোতায়েন, উত্তেজনা তুঙ্গে অবসরের আগে ক্রিকেট নিয়ে কোনো অতৃপ্তি রাখতে চান না কোহলি সারাদেশের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত, সিলেট বিভাগে হতে পারে বৃষ্টি ‘চরমপন্থী’ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কানাডার নাজিরপুরে বাসচাপায় নিহত যুবলীগকর্মী বিশ্বকাপের জন্য পাকিস্তানের ১৫ খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশিত আওয়ামী সরকার দেশে নব্য বাকশালী শাসন কায়েম করেছে : মির্জা ফখরুল শনিবার ১৫ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে : মান্ডা-জিরানী খালপাড়বাসী র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে : যুক্তরাষ্ট্র কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার

সকল