৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় অন্বেষণ

-


(গতকালের পর)

বঙ্গীয় রেনেসাঁর সৃষ্টি কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণীর অনেকে বাঙালি মুসলমানদের বাঙালিও মনে করতেন না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটিতে যেখানে তিনি গ্রামের মাঠে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান ছেলেদের মধ্যকার বল খেলাকে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে খেলা ঠাওরে দিয়েছেন। তার ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান’ বইতে তো তিনি কোনো রাখঢাক না রেখেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিজের বিদ্বেষ উগলে দিয়েছেন। সেখানে তিনি মুসলমানদের দৃষ্টি সবসময় তুরস্ক ও আরবের দিকে নিবদ্ধ থাকে বলে মন্তব্য করে মুসলমানদের ভারতের প্রতি আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সেই সাথে এই রায়ও দিয়েছেন যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দুদের মুসলমানদের সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও কোনো রাখঢাক না রেখেই নিজের মুসলিমবিরোধী সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শন করেছেন। তার ‘আনন্দমঠ’ সুস্পষ্টভাবে মুসলিমবিদ্বেষী একটি উপন্যাস। অতএব, দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, যে বঙ্গীয় রেনেসাঁকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা বাঙালি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ বাঙালি মুসলিমদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। তবে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। ১৯৭১ সালের আগে থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীদের নিকট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরম পূজনীয় ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ তাদের কাছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় স্তম্ভস্বরূপ। নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক উঁচুমাপের বাঙালি কবি, যিনি তাঁর রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই বাঙালির সর্বজনীন কবি নন কারণ তার কবিতা বা সাহিত্যে স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ভাব, জীবনধারা ও সংস্কৃতি প্রতিনিধিত্ব পায়নি। বাংলাদেশের অসামান্য কৃতী রাজনীতিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ তার ‘বাংলাদেশের কালচার’ বইতে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হইয়াও পাক-বাঙলার জাতীয় কবি নন। বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পর এটা রাষ্ট্রীয় সত্য হইয়াছে নিশ্চয়ই। কিন্তু বিভাগ পূর্ব বাংলাদেশেও এটা সাহিত্যিক সত্য ছিল। পাকিস্তান হওয়ার তিন বছর আগে ১৯৪৪ সালে কলিকাতার বুকে দাঁড়াইয়া এক সভাপতির ভাষণে আমি বলিয়াছিলাম : ‘‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতীয় বিশ্বে কতবার শারদীয়া পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে কখনো মোহরমের চাঁদ উঠে নি।” এটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি অশ্রদ্ধা-অপমানের কথা নয়।

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি হইয়াও বাংলার জাতীয় কবি নন। বাংলার জাতীয় কবি নন তিনি এই সহজ কারণে যে বাংলায় কোনো ‘জাতি’ নাই। আছে শুধু হিন্দু-মুসলমান দুইটা সম্প্রদায়। তিনি বাংলার জাতীয় কৃষ্টির প্রতীক নন এই সহজ কারণে যে, এখানে কোনো জাতীয় কৃষ্টিই নেই। এখানে আছে দুইটা কৃষ্টি : একটা বাংগালী হিন্দু-কৃষ্টি অপরটি বাংগালী মুসলিম-কৃষ্টি। সমগ্র বাংলায় মেজরিটি ছিল মুসলমান। মেজরিটি দেশবাসীর সাথে নাড়ীর যোগ না থাকিলে কেউ জাতীয় কবি হইতে পারেন না। বিশ্বের কাছে তিনি য্ত বড়ই হউন। এটা পশ্চিম-বাংলার কৃষ্টি সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞাও নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-কবি হিসাবে আমাদের নমস্য। সর্ব অবস্থায় তা থাকিবেন। যুদ্ধেও থাকিবেন, শান্তিতেও থাকিবেন। এই খানেই সীমারেখার সূক্ষ্ম জ্ঞানের প্রয়োজন। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিলেই রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা নিষিদ্ধ হইবে এটা যেমন দোষণীয়, শান্তি হইলেই রবীন্দ্র-পূজা শুরু হইবে এটাও তেমনি দূষণীয়।” আবুল মনসুরের বক্তব্যে যে বাংলাদেশের মুসলমানদের দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথাযথ অবস্থান কেমন হওয়া উচিত কেবলমাত্র তাই উঠে আসে নি, বরং একাট্টা একক বাঙালি সংস্কৃতি বলে যে কিছু নেই তাও উঠে এসেছে। বরং কাল্পনিক একক বাঙালি সংস্কৃতির জায়গায় রয়েছে দুটো বৃহৎ সভ্যতার আঞ্চলিক রূপ হিসেবে দুটো আলাদা সংস্কৃতি : বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতি ও বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতি।

এবার আসা যাক, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকেও বাঙালি জাতীয়তাবাদ উন্মেষের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বঙ্গভঙ্গকে মাতৃসম বাংলাভূমির অঙ্গচ্ছেদের সাথে তুলনা করে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে বহু কবিতা, গান, গদ্য রচিত হয়, যেগুলোকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাহিত্যের অনুপম নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়। এসময় যে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র/সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু হয় তাতে ব্রিটিশদের হাতে নিহত ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, সূর্যসেন ইত্যাদি ব্যক্তিত্বকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বীর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনেও অল্পসংখ্যক মুসলিমরাই অংশগ্রহণ করেছিল। উল্টো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল এই ভেবে যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলা ও আসামের বহুকাল ধরে নিগৃহীত ও অবহেলিত মুসলমান গরিব জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন হবে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে ক্রমবর্ধমানভাবে হিন্দু ধর্মীয় প্রতীকী ব্যবহার, কালীর পূজা, বাংলাকে বৃহৎ মাতা হিসেবে প্রতীকায়িত করে তার পূজা ইত্যাদি বাংলার মুসলমানদেরকে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে আরো দূরে ঠেলে দেয়। ধীরে ধীরে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন সাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করে। ১৯০৭ সালে কুমিল্লা ও জামালপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। মূলত শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণীর বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের পিছনে ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ। কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়ার পর থেকেই পূর্ব বাংলার উন্নয়ন অনেক কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে কলকাতাসহ পশ্চিম বাংলার শহরগুলোতে উন্নয়ন হয়েছিল তুলনামূলক বেশি। ফলে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আইনজীবী, রাজনীতিবিদদের বাস ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল এই ব্যক্তিরাই। বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা-কে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের রাজধানী করার ফলে কলকাতার আইনব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করে যে, নতুন প্রদেশ সৃষ্টির অর্থ হবে ঢাকায় আপিল কোর্টের প্রতিষ্ঠা এবং তাদের নিজস্ব হাইকোর্টের গুরুত্ব হ্রাস।

সাংবাদিকদের ভয় ছিল যে, স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহ প্রকাশিত হলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলোর প্রচার-সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়বে। কলকাতার ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বুঝতে পারছিলেন যে, নিকট ভবিষ্যতে ব্যবসায়-বাণিজ্য কলকাতা থেকে যৌক্তিকভাবে অধিকতর নিকটবর্তী ও সুলভ বন্দর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হবে। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বাংলায় বিরাট ভূ-সম্পত্তির অধিকারী জমিদারগণ আগেভাগে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঢাকায় আলাদা জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, যার অর্থ অতিরিক্ত খরচের বোঝা। এই বঙ্গভঙ্গের ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব এত বৃদ্ধি পায় যে, পরবর্তীতে তা পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থকে পরিণত করে। এই প্রসঙ্গেও নীরদচন্দ্র চৌধুরীকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি তার ‘The Autobiography of an Unknown Indian’ গ্রন্থে বলেন : “But the change inevitably came, and came very early. It was from the end of 1906 that we became conscious of a new kind of hatred for the Muslims, which sprang out of the present and showed signs of poisoning our personal relations with our Muslim neighbours and school-fellows. If the sprouting enmity did not go to the length of inducing us to give up all intercourse with them, it made us at all events treat them with a marked decline of cordiality. We began to hear angry comment in the mouths of the elders that the Muslims were coming out quite openly in favour of partition and on the side of the English. Nawab Salimu1lah of Dacca, the protagonist of the Muslim League and new Muslim politics, became our particular bite noire and we contemptuously called him "The One-eyed". We also noticed that our Muslim school-fellows were beginning to air the fact of their being Muslims rather more consciously than before and with a touch of assertiveness.” তাই বলা যেতে পারে যে, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন বাঙালি একতা তথা জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণ তো দূরের কথা বরং তা বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়।

এবার আসা যাক, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে। প্রচলিত বয়ান অনুযায়ী, এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপিত হয়। এমন একটা বুঝ এ বয়ানে দেয়ার চেষ্টা করা হয় যেন সেসময় ভাষা আন্দোলনকারীরা ছিল উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে। অথচ তারা কেবল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দাবি করেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তমদ্দুন মজলিসই প্রথম ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে। এই তমদ্দুন মজলিস গঠন করা হয়েছিল নবগঠিত পাকিস্তানে ইসলামী ভাবধারা ও আদর্শ অক্ষুণœ রাখার জন্য একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মিছিলকারীদের ওপর গুলি চালানোকে কেন্দ্র করে ২২ শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় যে বিক্ষোভ মিছিল হয় তাতে স্লোগান ছিল : ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার/রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই/উর্দু-বাংলায় বিরোধ নাই/খুনি নুরুল আমীনের বিচার চাই।’ এ স্লোগান থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়, ভাষা আন্দোলন দ্বিজাতিতত্ত্ববিরোধী সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী কোনো আন্দোলন অবশ্যই ছিল না। একইভাবে ১৯৬৬ সালে প্রস্তাবিত ছয় দফার প্রথম দফায় আমরা লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশন রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রস্তাবনা দেখি। উল্লেখ্য যে, লাহোর প্রস্তাবে ভারত উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতে দুটো মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচনী মেনিফেস্টো রচনা করে। এছাড়াও এই নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে একটি ধারা এও ছিল যে : কুরআন ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না। মূলত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ এমপিরাই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করে। ১৯৭২ সালের সংবিধান রচনার জন্য নতুন কোনো গণভোট আয়োজিত হয়নি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী মেনিফেস্টোর যে ধারাগুলোর ওপর নিজের আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, ’৭২-এর সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ না করেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সংবিধানের আদলে বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মূলনীতি হিসেবে সন্নিবেশিত করা হয়।
(চলবে)

 

 


আরো সংবাদ



premium cement