২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু বই

-

জ্ঞান মানেই হচ্ছে শিক্ষা। আর বই হচ্ছে শিক্ষার বাহন। সুতরাং যতই বইয়ের লিখন, প্রকাশন ও বিপণন বাড়বে ততই আলোর রাজ্যেরও বৃদ্ধি ঘটবে। এ জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বই পড়তে হবে। বই পড়তে হলে কিনতে হবে। কিন্তু বাঙালিদের বই কেনার প্রতি বড়ই অনীহা, বই ধার দিতে চাইলেও পড়তে চায় না, যেন বই পড়ার সময় নেই তাদের। তবে অকাজে সময় ব্যয় করতে পারদর্শী। বিদ্যাচর্চার চেয়ে অর্থচর্চায় বেশি মনোযোগী।
বই না পড়ার ফলে অসংস্কৃত, অমার্জিত লোকজনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর কমে যাচ্ছে রুচিশীল, সংবেদনশীল, হৃদয়বান মানুষ। তরুণরা ঝুঁকে পড়ছে জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন খারাপ কাজের প্রতি, যা উন্নত রাষ্ট্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরাট হুমকি।
তরুণ সমাজকে বিপথগামী হওয়া থেকে বাঁচাতে বই পড়ার বিকল্প নেই। বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। জীবনকে বুঝতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে। কেননা বই আমাদের মনের দরজা খুলে দেয়। কল্পনাশক্তি ও চিন্তাশক্তি প্রসারিত করে। একটি ঘটনাকে বিভিন্নভাবে দেখার ক্ষমতা বাড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস অনেক বদ অভ্যাসকে প্রতিহত করে।
দেখা গেছে, আগেকার তুলনায় বর্তমানে বই পড়া তরুণ-তরুণীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারা বই পড়ার পরিবর্তে ফেসবুক, টুইটার বা টিভি সিরিয়ালে অভ্যস্ত। আর এসব কারণে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত, বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের আবার আলোর পথে নিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে মনের ভেতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেয়া এবং বিপদকালে তার ভেতর ডুব দেয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’ একমাত্র বই-ই পারে এই ভুবন তৈরি করতে। বইয়ে বিকল্প কিছুই চিন্তা করতে পারেন না। সমাজ বদলাতে, দেশের উন্নয়ন করতে চাইলে বই পড়ার বিকল্প নেই।
ভালো বই মানুষের উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। বই পড়া মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে, মানবকল্যাণে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। তাই সুসময়ে-অসময়ে বই হোক অবলম্বন, ভালোবাসা হোক বইয়ের সঙ্গে, বই হোক প্রিয় বন্ধু। একজন পাঠকমাত্রই জ্ঞানের সাধক, জ্ঞানের কাঙাল। তাই বই পড়ে একজন মানুষ জ্ঞানী হন, নীতিবান হন, গুণী হন, বিবেক জাগ্রত আলোকিত মানুষ হন।
বই সুন্দর জীবনের পথ দেখায়, গড়ে দিতে পারে আদর্শের প্রেরণা। দুঃখকষ্টকে জয় করে দুর্বার গতিতে সামনে এগোবার মন্ত্র শেখায়। অথচ বর্তমানে আমাদের সমাজের কঠিন সময় যাচ্ছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা অস্থির সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বায়নের অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে ভাসছে, পথ হারাচ্ছে, বিভ্রান্ত হচ্ছে। ভালো-মন্দ বিচার করতে গিয়ে সঙ্কটে পড়ছে।
সত্য সঠিক পথ বেছে নিতে গিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো, ভালো বই পড়া। নিয়মিত বই পড়ে তরুণ সমাজ একদিন জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবে। বই পড়ে মানুষ জ্ঞানী হয়। তার মধ্যে প্রকৃত মনুষ্যগুণ তৈরি হয়। তাই প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য হলেও বই পড়া উচিত। হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও বই পড়ার জন্য প্রতিদিন কিছু সময় বরাদ্দ করতে হবে। তরুণ-তরুণীদের ভুলের চোরাবালিতে পা ফেললে চলবে না। আগামী দিনের সুন্দর, টেকসই, সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়ার দায়িত্ব তাদের ওপরই ন্যস্ত। আর একটি সৃষ্টিশীল সমাজ, উন্নয়নশীল দেশ, সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে বইয়ের বিকল্প কিছু নেই। মানবতার কল্যাণে জ্ঞানসাধনা করে যারা আজও বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন এমন একজন হচ্ছেন ইবনে রুশদ। কথিত আছে, এ বরেণ্য সাধক বিয়ে ও বাবার মৃত্যুর রাত ছাড়া আর কোনো রাতেই বই পড়া বন্ধ করেননি।
বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রবর্তক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছোটকাল থেকেই ছিলেন মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু। রাতে বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার মতো সঙ্গতি তাদের ছিল না। তাই কিশোর ঈশ্বরচন্দ্র সন্ধ্যার পর পথের পাশে জ্বালানো গ্যাসের বাতির নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন। বই পড়–য়া ঈশ্বরচন্দ্র ছাত্রজীবনে নানা বিষয়ে কৃতিত্বের জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ নামেই পরিচিত লাভ করেন।
বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনে বই ছিল নিত্যসঙ্গী। ভালো বই পেলে তিনি এত একাগ্রতা ও মনোযোগ দিয়ে পড়ে যেতেন যে, বাইরের কোনো কোলাহল, ক্ষুধা, ঘুম কোনো কিছুই বইয়ের পাতা থেকে তার চোখ সরিয়ে নিতে পারত না। বইপ্রিয় এই বরেণ্য মানুষটি বই পড়ার একাগ্রতার জন্য কখনো কখনো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তেন। এমনি একটা ঘটনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নির্জন কক্ষে বসে বইপ্রেমিক ড. শহীদুল্লাহ মন দিয়ে বই পড়ছিলেন। সময় গড়িয়ে যায়। গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই তার। যখন খেয়াল হলো তখন উঠে গিয়ে দেখলেন, জানালা দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো। অগত্যা কষ্ট করে জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, কাউকে পাওয়া যায় কি না। এক পথচারীকে ডেকে জানালেন তার বন্দিত্বের কাহিনী। পথচারী খবর দেন গার্ডকে। গার্ড ছুটে আসে গ্রন্থাগারের দরজা খুলে মুক্ত করেন বইপ্রেমিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে।
ওয়ারেন বাফেট একজন প্রয়াত মার্কিন ব্যবসায়ী। বিশ্বের ধনী মানুষের নামের তালিকায় ওয়ারেন বাফেটের অবস্থান দ্বিতীয়। এই সফল মানুষটি অবসরে শতকরা ৮০ ভাগ সময়ই বই পড়ার পেছনে ব্যয় করেন। এইচবিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এখনো দিনের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আমি বই পড়ার পেছনে ব্যয় করি। নরমান মেলর বলেছেন, আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।
বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ আল বেরুনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একদিন অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে আছেন। পাশে অবস্থানরত তার এক বন্ধু। তিনি তাকে বললেন, জ্যামিতির একটি সংজ্ঞা আমার জানা দরকার।
বন্ধুটি বললেন, তুমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। এসব এখন জেনে কী লাভ হবে? আল বেরুনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর আগে এটি আমি জেনে যেতে পারলে হয়তো আমার জীবনটা আরো ধন্য হবে।’ জ্ঞানের শেষ নেই। জ্ঞান অর্জনে বইয়ের বিকল্প কিছুই নেই।
গণতন্ত্রের মানসপুত্র অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ ছিল; টয়লেটে বেশি সময় লাগত, তাই কমোডে বসেই তিনি সে দিনের পত্রিকাগুলো পড়ে শেষ করতেন।
পৃথিবীর যেখানেই যারা আলো ছড়িয়েছেন; প্রতিষ্ঠার আকাশে নক্ষত্র হয়ে পথ দেখিয়েছেন, প্রসারিত ছায়া দিয়ে ধন্য করেছেন সময় ও সমকালীনদের, তাদের বেড়ে ওঠার ইতিহাসটা এমনই হয়।
সারা বিশ্বের সব কিশোরের জনপ্রিয় বই ‘হ্যারিপটার’-এর লেখিকা জে কে রাউলিংকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাকে যদি কোনো মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সঙ্গে কী নিবেন? কোনো সময় ক্ষেপণ না করে রাউলিং উত্তর দিয়েছিলেন, বই নেবো।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘একেকটা বই একেকটা জানালার মতো। ঘরের জানালা দিয়ে যেমন বাইরে সব কিছু দেখা যায়, তেমনি বই পড়লেও আগামীটা দেখা যায়।’
মানবজীবনে বইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে লিও টলস্টয় বলেছেন, জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন; বই, বই এবং বই।
tafazzalh59@gmail.com.

 


আরো সংবাদ



premium cement