২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মধ্য এশিয়ার এক দরবেশ কবি

-

হজরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ: (১০০৬-১০৮৮ খ্রি.) একাদশ শতকের মধ্য এশিয়ার একজন দরবেশ কবি ও বিখ্যাত সাধক-বুজুর্গ। তিনি বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু আইউব আনসারি রা:-এর নবম বংশধর। তার পূর্বপুরুষরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আরব দেশ থেকে খোরাসানে আগমন করেন। আবদুল্লাহ আনসারি রহ: ১০০৬ সালের ৪ মে তৎকালীন ইরানের অধিভুক্ত খোরাসানের হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানটি বর্তমানে পশ্চিম আফগানিস্তানে অবস্থিত। গোটা মধ্য এশিয়ায় তিনি ‘পীর-ই-হেরাত’ নামে সমধিক পরিচিত। তার পূত সংস্পর্শে এসে বহু মানুষ আল্লাহর পথের সন্ধান পায়। আল্লাহ তায়ালার ইবাদত, সুন্নাতে রাসূল সা:-এর অনুসরণ, দাওয়াত-তাবলিগ, চরিত্র সংশোধন, অধ্যাত্মসাধনা ও মানবসেবার চর্চা করেন এবং অগুনতি মানুষকে শিক্ষা ও দীক্ষা দেন জীবনের ৮২ বছর। তিনি একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আরবি ও ফার্সি কবি। তার রচিত পবিত্র কুরআনের তাফসির ‘কাশফুল আসরার’ ছিল পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। মহানবী সা:-এর ৩০ হাজার হাদিস খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুখস্থ ছিল। ইতিহাস খ্যাত সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামি রহ: তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আরবি ও ফার্সি ভাষায় স্বচ্ছন্দে কবিতা রচনায় খাজা আবদুল্লাহ আনসারি ছিলেন পারদর্শী। তিনি মোট ১৮টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইলাহীনামা, গাঞ্জনামা, কানযুস সালেকিন, মুনাজাতনামা, যাদুল আরিফিন, নাসায়েহ, কলন্দারনামা, রিসালায়ে ওরাদাত, রিসালায়ে দিল ও জান, হাফ্ত হিসার, রিসালায়ে মানাকিবে আহমদ ইবন হাম্বল, আনোয়ারুত তাহকিক, কিতাব আল-ফারুক, মানাযিলু সাঈরিন ও জামিউল কালাম তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। হাম্ব^লি মাজহাবের অনুসারী এ সাধক পুরুষের কবিতা হেরাতের গভর্র্নর হাউজের দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল।
হিমালয়ান উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী রহ: হেরাতে অবস্থানকালে খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মাজারসংলগ্ন মসজিদে রাত কাটাতেন আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে (মাওলানা আবদুল মালেক, শাখছিয়াতে আফগানিস্তান কী রূহ পরওর ইয়াদেঁ, পৃ: ২৬৬-২৭৬)। কোর নলেজ ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম হতে ২০০৪ সালে তাঁর ‘নসিহত ও মুনাজাত’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, প্রার্থনার প্রকরণ ও প্রকর্ষ মানবজাতির সম্পদ। বর্ণিত আছে, প্রায় এক লাখ ফার্সি কবিতা তার কণ্ঠস্থ ছিল। তিনি নিজে ৬০০০ পঙক্তি কবিতা রচনা করেন। আল্লাহর পরিচয়, মানুষের সাথে আল্লাহর স¤পর্ক, সৎচিন্তা, সৎকর্ম, পাপ পরিহার, পরোপকার, হিতসাধন, মানবসেবা, তাওবা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও সুন্নাতে রাসূলের পুনরুজ্জীবন হলো তার রচনার মূল প্রতিপাদ্য। আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর ‘মুনাজাত’ এর অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। অত্যন্ত নামকরা ব্যক্তিবর্গ এর অনুবাদক ও পাঠক। ফার্সিতে রচিত তার একটি দার্শনিক কবিতার ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ নি¤েœ প্রদত্ত হলো।
ও ঈধসব
ইু কযধিলধ অনফঁষষধয অহংধৎর
ঋৎড়স ঃযব ঁহ-সধহরভবংঃ ও পধসব,
অহফ ঢ়রঃপযবফ সু ঃবহঃ, রহ ঃযব ঋড়ৎবংঃ ড়ভ গধঃবৎরধষ বীরংঃবহপব.
ও ঢ়ধংংবফ ঃযৎড়ঁময সরহবৎধষ ধহফ াবমবঃধনষব শরহমফড়সং,
ঞযবহ সু সবহঃধষ বয়ঁরঢ়সবহঃ পধৎৎরবফ সব রহঃড় ঃযব ধহরসধষ শরহমফড়স;
ঐধারহম ৎবধপযবফ ঃযবৎব ও পৎড়ংংবফ নবুড়হফ রঃ;
ঞযবহ রহ ঃযব পৎুংঃধষ পষবধৎ ংযবষষ ড়ভ যঁসধহ যবধৎঃ
ও হঁৎংবফ ঃযব ফৎড়ঢ় ড়ভ ংবষভ রহ ধ চবধৎষ,
অহফ রহ ধংংড়পরধঃরড়হ রিঃয মড়ড়ফ সবহ
ডধহফবৎবফ ৎড়ঁহফ ঃযব চৎধুবৎ ঐড়ঁংব,
অহফ যধারহম বীঢ়বৎরবহপবফ ঃযধঃ, পৎড়ংংবফ নবুড়হফ রঃ;
ঞযবহ ও ঃড়ড়শ ঃযব ৎড়ধফ ঃযধঃ ষবধফং ঃড় ঐরস,
অহফ নবপধসব ধ ংষধাব ধঃ ঐরং মধঃব;
ঞযবহ ঃযব ফঁধষরঃু ফরংধঢ়ঢ়বধৎবফ
অহফ ও নবপধসব ধনংড়ৎনবফ রহ ঐরস.
(ঞৎধহংষধঃবফ নু ঝধৎফধৎ ঝরৎ ঔড়মবহফৎধ ঝরহময, ঞযব চবৎংরধহ গুংঃরপং : অহংধৎর (ঞযব ডরংফড়স ড়ভ ঃযব ঊধংঃ ঝবৎরবং), খড়হফড়হ, ১৯৫১)
‘আমি এসেছিলাম’
অপার্থিবতার নিগূঢ় থেকে এসে,
আমি তাঁবু গেড়েছিলাম পার্থিবতার অরণ্যে,
আমি অতিক্রান্ত করেছি খনিজ ও উদ্ভিজ্জ সাম্্রাজ্য,
তারপর মনন আমায় বয়ে নিয়েছিলো প্রাণিজগতে,
পৌঁছে সেথায়, পেরিয়ে গেলাম তা,
এরপর মানব হৃদয়ের স্ফটিক-স্বচ্ছ খোলসে নিজেকে বিকশিত করলাম মুক্তোয়,
আর সৎ সংসর্গে পরিভ্রমণ করলাম প্রার্থনাগৃহ,
অভিজ্ঞতার আস্বাদন শেষে পেরিয়ে গেলাম সেটিও,
তারপর বেছে নিলাম তাঁকে পাওয়ার পথ
আর তাঁর দরোজায় অনুগত দাসে পরিণত হলাম,
অতঃপর অন্তর্হিত হলো সত্তার দ্বৈধতা
আর আমি বিলীন হলাম তাঁরই মাঝে।
(ইংরেজি থেকে ভাষান্তর, সাঈদ আহসান খালিদ, সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়)।
ভারতের জাতীয় নেতা গান্ধী আনসারির মুনাজাত ও নসিহত ইংরেজিতে অনুবাদ বের হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। সরদার স্যার যোগেন্দ্র সিংহ আনসারির মুনাজাত ও নসিহত ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং ঞযব ডরংফড়স ড়ভ ঃযব ঊধংঃ ঝবৎরবং গ্রন্থমালায় ১৯৫১ সালে তা লন্ডনে মুদ্রিত হয়। যোগেন্দ্র সিংহ আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন : ‘শান্তির মন্দিরে শিষ্যত্ব গ্রহণের পথে এ মুনাজাত সঠিক পথনির্দেশনা। অন্তর হতে উত্থিত এ মুনাজাত তার অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। তার অন্তর যা চেয়েছে, তা তিনি পেয়েছেন। অন্যদের নিকট যা গুপ্ত ও লুকানো, তা প্রত্যক্ষ করেছেন আনসারি। তার আবিষ্কার প্রমাণ করে, সত্য অপরিবর্তনীয়। সব যুগের সত্যপ্রাপ্ত সাধকেরা একই সুরে কথা বলেছেন। ইন্দ্রিয়াচ্ছন্ন চেতনায় আনসারির উক্তির মর্ম অগম্য। লালসার ঝড় হতে উত্থিত কুজ্ঝটিকা ভেদ করতে পারে আত্মিক সাধনা’ (ঝধৎফধৎ ঝরৎ ঔড়মবহফৎধ ঝরহময, ঞযব চবৎংরধহ গুংঃরপং : অহংধৎর (ঞযব ডরংফড়স ড়ভ ঃযব ঊধংঃ ঝবৎরবং), খড়হফড়হ, ১৯৫১, ঢ়ঢ়.১-১০) ।
মরহুম প্রিন্সিপ্যাল রেজাউল করিম চৌধুরী বিখ্যাত সাধক-বুজুর্গ খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত বাংলায় ভাষান্তর করেন। এই ঐতিহাসিক গ্রন্থের ভূমিকায় বিজ্ঞ বাংলা অনুবাদক ও ভাষ্যকার যে মন্তব্য করেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘আনসারির অন্তর্ভেদী আত্মার আর্তি প্রাচ্য-প্রতীচ্যে অমুসলিমদের মনে যে দোলা দিয়েছে তার কিঞ্চিৎ আভাস দেয়া হলো। আত্মার অভিযাত্রায় আনসারি কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ তাঁবেদারিতে কামালিয়ত হাসিল করেন। তাওহিদ-রিসালতের আকিদায় লব্ধ ‘বেছাল’ (মিলন ও সংযোগ) র্শিকি সাধনায় অর্জন অসম্ভব। বহুত্বের তিমিরে আচ্ছন্ন আত্মার আলোকপ্রাপ্তি অনায়ত্তে থাকবেই। এ অবস্থায় তাওহিদি সাধকদের সঙ্গে অন্য পথের পথিকদের সমীকরণের প্রয়াস অসঙ্গত ও অসমীচীন। রাহমাতুল লিল আলামিনের তাওহিদি পয়গাম সারা বিশ্বে সকল মানুষের জন্য। এ ডাকে সাড়া দিলেই সঙ্কট নিরসন হবে। সে সঙ্কট ব্যক্তিসত্তার হোক, জাতিসত্তার হোক। তাওহিদ-শিরকের সমন্বয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে, হবেই। তাওহিদ হতে বিচ্যুত তন্ত্র-মন্ত্র মানবজাতির সীমাহীন যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। তাওহিদ হতে সরে আসা এ ‘বাদ’ সে ‘বাদ’ মানবজাতিকে বরবাদ করেছে। ভোগোন্মাদ বর্তমান বিশ্বে আত্মার পুনর্বাসন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নির্বাসিত আত্মার পুনরুদ্ধারে ইসলামের সুফি সাধক দরবেশদের কাব্যিক সম্পদের ব্যাপক প্রচার প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে’ (প্রিন্সিপ্যাল এএ রেজাউল করিম চৌধুরী, খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত, পৃ.১৩)।
রেজাউল করিম চৌধুরী অনূদিত এবং আনসারি রহ: রচিত আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিবেদিত ‘মুনাজাত’-এর কয়েকটি পঙক্তি নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
‘ওভ ধ ষধসব ফড়ম
ঋরহফং ধফসরংংরড়হ ধঃ ঞযু মধঃব,
অহফ ঃযব বিধৎু ধৎব ৎবভৎবংযবফ নু ঞযু ংরমযঃ
ঘড় ৎবধংড়হং যধাব ও ভড়ৎ ফবংঢ়ধরৎ.’
‘খোঁড়া কুকুর পায় যদি
তোমার দুয়ারে আশ্রয়,
ক্লান্ত শ্রান্ত আর্তজন
তোমাতে যদি পায় শান্তি,
হতাশ হবার নেই কারণ।’
‘ও ষরাব ড়হষু ঃড় ফড় ঞযু রিষষ,
গু ষরঢ়ং সড়াব ড়হষু রহ ঢ়ৎধরংব ড়ভ ঞযবব,
ঙ খড়ৎফ, যিড়বাবৎ নবপড়সবঃয ধধিৎব ড়ভ ঞযবব
ঈধংঃবঃয ড়ঁঃ ধষষ বষংব ড়ঃযবৎ ঃযধহ ঞযবব.’
তোমার ইচ্ছা পালনেই আমি বেঁচে থাকি,
তোমার বন্দনায় রসনা মোর সদা সঞ্চালিত,
প্রভু হে, যে জন তোমায় জেনেছে
তুমি ছাড়া সব কিছুই ছেড়েছে সে।’
(ঝধৎফধৎ ঝরৎ ঔড়মবহফৎধ ঝরহময, ঞযব চবৎংরধহ গুংঃরপং : অহংধৎর (ঞযব ডরংফড়স ড়ভ ঃযব ঊধংঃ ঝবৎরবং), খড়হফড়হ, ১৯৫১, ঢ়ঢ়.২৩,৫৪; প্রিন্সিপ্যাল এএ রেজাউল করিম চৌধুরী অনূদিত খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত, পৃ.১৬, ১৮)।
আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে এ শাস্ত্রজ্ঞ কবি ও সাধক পুরুষের রূহের মাগফিরাত কামনা করি। তার মুনাজাত ও চিন্তাধারা প্রদীপ হয়ে আমাদের অন্তর ও বহির্জগৎকে আলোকিত করুক-এটাই কামনা। হ
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত আমদানি ব্যয় কমাতে দক্ষিণাঞ্চলের সূর্যমুখী তেলের আবাদ পাকুন্দিয়ায় গানের আসরে মারামারি, কলেজছাত্র নিহত আবারো হার পাকিস্তানের, শেষ সিরিজ জয়ের স্বপ্ন পাটকেলঘাটায় অগ্নিকাণ্ডে ৩ দোকান পুড়ে ছাই ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু দোয়ারাবাজারে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা : স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড গাজীপুরে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর লাশ উদ্ধার ভারতে দ্বিতীয় পর্বে ৮৮ আসনে ভোট

সকল