২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষক-কর্মচারীদের করুণ অবস্থা

-

বাংলাদেশে নীরবে করোনা শুরুর অনেক পরে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গত ২৬ মার্চ থেকে ঘোষণার মাধ্যমে লকডাউন করাসহ করোনার প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। তবে আরো আগে ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে সব থেকে বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষাঙ্গনের। এর ফলে শিশু, কিশোর ও যুবকদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস হওয়ার পথে। গত ১৭ মার্চ থেকে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো, করোনার কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ভয়ে কোয়ারেন্টিন, লকডাউন প্রভৃতির মতো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল। এমনকি মসজিদে জামাত করা বন্ধ করে ঘরে নামাজ পড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
পরে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জীবন-জীবিকার সঙ্কট মোকাবেলার জন্য লকডাউন প্রত্যাহার করে স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে অফিস-আদালত, কলকারখানা, হাটবাজার ও পরিবহন খুলে দেয়া হয়েছে। অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেকের আশঙ্কা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে করোনা আরো বিস্তার লাভ করবে এবং এতে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। এই বিশ্বাসের কারণও অনেক।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রান্ত যে সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় তা বেশির ভাগ লোকই বিশ্বাস করে না। আবার সাম্প্রতিককালে পত্রপত্রিকায় স্বাস্থ্য বিভাগের যেসব কেলেঙ্কারির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তার ফলে মানুষের মনে এই অবিশ্বাস আরো বেড়েছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে জাতীয় স্বার্থে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।
করোনার সংস্পর্শের ভয়ে বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজন পরস্পরকে ‘পর’ করে তুলেছে। অনেকে করোনা আক্রান্ত আপনজনদের অসহায় অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি আপনজনের মৃত্যুর পর অনেক ক্ষেত্রে জানাজা ও দাফনেও অংশ না নেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মানুষে মানুষে ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে এর চেয়ে নির্মম আচরণ আর কী হতে পারে? আমাদের দেশে ছোঁয়াচে রোগ তো আরো আছে, কিন্তু করোনা মানুষকে অমানুষে পরিণত করেছে বলে মনে হয়। অনেকে এর মধ্যে কিয়ামতের আলামত খুঁজে পাচ্ছেন রোজ হাশরে যেমন বাবা সন্তানকে এবং সন্তান বাবাকে সাহায্য করতে পারবে না। সবাই ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি করবে সে দিন। করোনায় মানুষকে সে কথা স্মরণ করাতে সক্ষম হয়েছে। মসজিদের পাঞ্জেগানা ও ঈদের জামাত, হজ-ওমরাহর ওপরও এর বিরাট প্রভাব লক্ষণীয়। কিভাবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
দেশে বর্তমানে ৭৬ হাজার ৮০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক কোটি ৮০ লাখ ছাত্রছাত্রী আছে। এতে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় চার লাখ। এই। সরকারি সহযোগিতা পায় না এ রকম প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। দেশে নিম্নমাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল এবং পালি ও টোল কলেজ রয়েছে ২১ হাজার ৩৬৭টি, মাদরাসা আছে এক লাখ ২০ হাজার, শিক্ষক আছেন চার লাখ ও শিক্ষার্থী ৫৮ লাখ। তা ছাড়া দেশে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, কৃষি বিদ্যালয়, নার্সিং কলেজ, ফিজিওথেরাপি কলেজ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রভৃতি আছে প্রায় আড়াই হাজার। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ লাখ এবং শিক্ষক প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার। তারা বেশির ভাগই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। বিগত ১৭ মার্চ থেকে উপরি উক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। এরপর ইতোমধ্যে চার মাস অতিক্রম করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে কার্যত লেখাপড়াও বন্ধ হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল; সেটিও বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেছে উচ্চ শিক্ষায়তন মেডিক্যাল কলেজ ও কারিগরি ইনস্টিটিউটগুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার মেডিক্যাল কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ইতোমধ্যে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি কিছু না কিছু করার কথা থাকলেও তারা কিছু করতে পারছে না। বিশেষ করে চাকরিসংক্রান্ত সব পরীক্ষা বন্ধ থাকায় তারা চাকরি করতে পারছে না। ফলে তাদের ক্যারিয়ারে স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা বিস্তার বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেতন দেয়াও বন্ধ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ বহন করে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বাড়ি ভাড়াও বেতনভাতা চার মাস পরিশোধ করতে পারছে না। এমপিওভুক্ত যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এ ক্ষেত্রে তাদের তত বেশি সমস্যা না হলেও এমপিওবহির্ভূত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থী আছে যারা টিউশনি করে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ চালায়। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের টিউশনিও বর্তমানে বন্ধ। ফলে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা অন্ধকার দেখছেন এবং অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করতে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বাধ্য হচ্ছেন। চীনের একটি প্রদেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জীবন বিধ্বংসী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সর্বপ্রথম শুরু হয়। পরে সারা বিশ্বে তা বিস্তার লাভ করেছে। অতঃপর সারা দুনিয়ার মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর যে প্রলয়ঙ্করী প্রভাব বিস্তার করেছে, তার নজির বিরল। মানুষের জীবনের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাব্যবস্থাসহ বাংলাদেশ ও বিশ্বের দেশে দেশে এর বিরাট বিরূপ প্রভাব পড়েছে। দুনিয়াব্যাপী আন্তর্জাতিকভাবে এমন কোনো দিক নেই যার ওপর করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
করোনার প্রভাবে কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং দেশ-বিদেশের জল, স্থল ও আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। করোনা আসার সাত মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। কারখানা বন্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শ্রমিক কর্ম হারিয়েছে এবং এর ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা শূন্য হাতে বাংলাদেশ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। গৃহকর্মী, দিনমজুর, গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে সামাজিক খাতের দৈনন্দিন কর্মীরা কর্মচ্যুত হওয়ার ফলে তাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে দুর্যোগ নেমে এসেছে। বিশ্বের বড় বড় দেশ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও এর কোনো ওষুধ কোনো দেশ আবিষ্কার করতে পারেনি। হাজার কোটি টাকার মালিক বা অতিধনী ব্যক্তি হতদরিদ্র ব্যক্তির মতো বিনা চিকিৎসায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আবার অনেকে সর্বস্ব দিয়েও চিকিৎসা পাচ্ছে না। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে টানাটানিতে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে করোনা মানুষকে স্বার্থপর করে তুলেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি বাংলাদেশেও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছে এবং হচ্ছে। অনলাইনে শিক্ষা নেয়ার মতো আর্থিক অবস্থা সব শিক্ষার্থীর নেই। অর্থাভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অ্যান্ড্রয়েড সেট কিনতে পারছে না। আবার মোবাইল ডাটা কেনার মতো সামর্থ্যও তাদের নেই। অনলাইন সুবিধা চালুর কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই শিক্ষা নিতে পারছে না। তারা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিদেশী শিক্ষার্থী এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার্থীরা মোবাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে তার কুফলও লক্ষণীয়। বাস্তব অবস্থার আলোকে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদুল আজহার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া দরকার। অনেক সময় মানুষের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত আসে, যা সময়মতো ব্যবহার করতে পারলে তাকে সৌভাগ্যের দুয়ারে নিয়ে যেতে পারে। আর যদি এতে ব্যর্থ হয় তা হলে বাকি জীবনটা দুঃখ-দৈন্যের মধ্যেই তাকে কাটাতে হবে। একজন মানুষের জীবনে শিশু, কিশোর ও যৌবন জীবন গঠনের মৌলিক সময়। এ সময়গুলো যদি তারা কাজে লাগাতে না পারে তা হলে জীবনই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। এতে শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা মাসিক বেতন পরিশোধ করছে না। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের চার-পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া পড়ে গেছে এবং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চার-পাঁচ মাস বাড়ি ভাড়া দিতে পারছে না। অসহায় শিক্ষকরা তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের দেশেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৯ আগস্ট থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত। তাতে যা লাভ হবে : ১. করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে করে আল্লাহ তায়ালার রহমতে বাঁচার চেষ্টা করার অভ্যাস গড়ে উঠবে। ২. শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন আল্লাহর চাহে তো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। ৩. অসহায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন পাওয়া শুরু হবে। কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের মাসিক বেতন দেবে। ৪. ব্যক্তিমালিকানার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ও বাড়ি ভাড়া দিতে পারবে।
তাই ঈদুল আজহার আগেই নন-এমপিভুক্ত বেসরকারি সব শিক্ষক-কর্মচারী যাতে বেতনভাতা পেতে পারেন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বকেয়া বাড়ি ভাড়া দিতে পারেন, সে জন্য ধনী ব্যক্তিরা এবং সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা করা অতীব জরুরি।হ
লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট

সকল