লাইলাতুল ক্বদর অর্থ মহাসম্মানিত রাত, সৌভাগ্যের রাত এবং ভাগ্যোন্নয়নের রাত। সকল অর্থই এখানে প্রযোজ্য। এ রাতের মর্যাদা প্রসঙ্গে সূরা ক্বদরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম’। সূরা দুখানে বলা হয়েছে, ‘এ রজনীতে প্রত্যেকটি ব্যাপারে বিজ্ঞোচিত ফয়সালা করা হয়’। সূরা ক্বদরে আরো বলা হয়েছে, ‘ফেরেশতা ও রুহ এ রাত্রিতে তাদের রবের অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন। সে রাত্রি পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার-ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত’। বুখারি ও মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্বদরের রাত্রিতে ঈমানের সাথে শুভফল লাভের আশায় ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হবে আল্লাহ তার পেছনের সব গুনাহ মাফ করে দিবেন’।
উপরে কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতির আলোকে আমরা সহজেই লাইলাতুল ক্বদরের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। প্রশ্ন জাগে-কেন এ গুরুত্ব? জবাবও আল্লাহ দিয়েছেন-‘নিশ্চয়ই আমি ইহা (কুরআন) ক্বদরের রাত্রিতে নাজিল করেছি’। রমযানের রোযা ফরজ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘রমযান মাস, এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছে, যা মানব জাতির জন্য পুরোপুরি হেদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন উপদেশাবলীতে পূর্ণ যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়। কাজেই এখন থেকে যারাই এ মাসের সম্মুখীন হবে তাদের একান্ত কর্তব্য পূর্ণ মাস রোযা রাখা’। এতে স্পষ্ট যে কুরআন নাজিলের কারণেই লাইলাতুল ক্বদরের এত মর্যাদা এবং রমযান মাসে রোযা ফরজ করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রমযান মাসের কোন্ তারিখটি লাইলাতুল ক্বদর। সঠিক তারিখের উল্লেখ কুরআনে না থাকলেও হাদিসে এর বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, ‘নবী করীম (সা) ক্বদরের রাত্রি সম্পর্কে বলেছেন, ‘উহা ২৭তম বা ২৯তম রাত্রি’। হযরত আবু যার (রা) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘হযরত ওমর (রা), হযরত হুযাইফা (রা) এবং রসুল (সা)-এর সাহাবীদের মধ্যে বহু সংখ্যকের এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ ছিল না যে, উহা ২৭তম রাত্রি’। হযরত আয়েশা (রা) ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (সা) তাঁর জীবদ্দশায় রমযান মাসের শেষ দশ রাত্রিতে ইতেকাফ করেছেন। হাদিসের এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বকালের আলেমদের অধিকাংশই ২৭তম রাত্রিকেই লাইলাতুল ক্বদর বলে মনে করতেন। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা)-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট করে একটি রাত্রি উল্লেখ না থাকায় মনে হয়, মহান আল্লাহ চান লাইলাতুল ক্বদরের খোঁজে তাঁর বান্দারা বেশি বেশি রাত্রি ইবাদত বন্দেগিতে অতিবাহিত করুক।
মানুষের জন্য আল্লাহপাকের হাজারো নেয়ামতের মধ্যে সর্বোত্তম নেয়ামত হচ্ছে হেদায়াত বা পথ প্রদর্শন। মানুষ আল্লাহতায়ালার অত্যন্ত প্রিয় ও সেরা সৃষ্টি। আদম (আ) কে সৃষ্টি করে তিনি তাঁকে স্থান দিয়েছিলেন জান্নাতে। শয়তানের প্ররোচনায় তিনি আল্লাহর হুকুম অমান্য করে বসেন। তাৎক্ষণিক তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। আল্লাহপাক হযরত আদম (আ) কে ক্ষমা করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দুনিয়াতে পাঠান। সে সময় তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে আল্লাহ বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত যাবে, যারা তা অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই’। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রথম মানুষকে তিনি নবী হিসেবে প্রেরণের সাথে সাথে যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসুল প্রেরণ করেন এবং সর্বশেষ নবী হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী ও সাইয়েদুল মুরসালিন হজরত মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহতায়ালা সর্বশেষ কিতাব আল কুরআন তাঁর প্রিয়তম নবীর প্রতি নাজিল করেন পবিত্র রমযান মাসের মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল ক্বদরে। কুরআনের বদৌলতে মাস ও রাত হয়ে পড়ে মহাসম্মানিত। ঘোষিত হয় রমযান মাসের একটি ফরজ অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান এবং একটি নফল অন্য সময়ের একটি ফরজের সমান। আর রাত হয়ে পড়ে হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম।
লাইলাতুল ক্বদর মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার সুযোগ করে দেয়। আজ আমরা পাপ-পঙ্কিলতায় ডুবে আছি। শয়তান প্ররোচনা দেয় বাঁচার কোনো পথ নেই। শাস্তিতো ভোগ করতেই হবে, তাই দুনিয়ার মজাটা আরো একটু বেশি করে ভোগ করে নাও। কিন্তু ইসলাম তা বলে না। মানুষের ভুল-ত্রুটি হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। ত্রুটি-বিচ্যুতির সাথে সাথে মানুষ যদি অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা করে, তাহলে আর পূর্বে কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। আল্লাহতায়ালার একান্ত প্রত্যাশা যে তাঁর বান্দারা তাঁর কাছে ফিরে আসুক। গুনাহ মাফ করে নেয়ার এক অপূর্ব সুযোগ কুরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল ক্বদর। আল্লাহর নাফরমান বান্দারা আবার তাঁর হেদায়াত অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের অধিকারী হোক এটা তাঁর একান্ত ইচ্ছা। তাই রসুল (সা) বলেছেন, ‘যে কেহ ঈমানের সাথে শুভফল লাভের প্রত্যাশায় লাইলাতুল ক্বদরে দণ্ডায়মান হয় আল্লাহ তার অতীতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন’। এ যেন এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা যাতে আল্লাহর বান্দারা ত্রুটিমুক্ত হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে।
লাইলাতুল ক্বদরের আর একটি শিক্ষা হলো, যে কুরআনের কারণে একটি রাত এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেই কুরআনকে আঁকড়ে ধরা। তাহলে রাতের মতো জাতি হিসেবে আমরাও মর্যাদাবান হয়ে পড়ব এবং এর মাধ্যমেই আমাদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার পাওয়া সম্ভব। কুরআন আসছে হেদায়াতের উদ্দেশ্যে এবং দুনিয়ায় সকল বিধি-বিধানের ওপর একে বিজয়ী করার জন্য। দুর্ভাগ্যই মুসলমানদের! আজ আর কুরআন থেকে তারা হেদায়াত তালাশ করে না এবং এর প্রতিষ্ঠাও তাদের জীবনের উদ্দেশ্য নয়। বরং অনেকেই কুরআনের বিধানকে প্রতিরোধই তাদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এরা যে কতখানি আল্লাহর রোষানলে সে উপলব্ধিও তারা হারিয়ে ফেলেছে। তাই আজ আল্লাহর বিধান প্রতিরোধের পাশাপাশি যারা এর প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সে সব বরেণ্য আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ এবং ঈমানদারদের প্রতি সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনে তাদের হৃদয় একটুও কাঁপে না।
লাইলাতুল ক্বদর বারবার আমাদের মাঝে হাজির হয়। আল্লাহতায়ালার অপার অনুগ্রহ যে, তিনি তাঁর বান্দাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করে নতুন জীবন যাপনের সুযোগ করে দিতে চান। তাই আমাদের উচিত কোনো চালাকির আশ্রয় না নিয়ে লাইলাতুল ক্বদরে নিজেদের গুনাহের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে পরিপূর্ণভাবে তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করা। মুসলমান হিসেবে ইসলামে বিশ্বাস, ইসলাম অনুসরণ এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালানো ছাড়া আখেরাতে নাজাতের কোনো পথ খোলা নেই।
লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব.), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা