৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় অন্বেষণ

শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এ দেশে কী ধরনের জাতীয়তাবাদ অনুসরণ করা উচিত তা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বিতর্কে বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি ধারায় বিভক্ত। বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থকদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ ও দ্বিধা রয়েছে। কেউ মনে করেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি রূপান্তরবাদী ও ভৌগোলিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করবে, যেখানে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত মৌলিক পরিচায়ক হতে পারে। অন্যেরা মনে করেন, এটি সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় একটি নতুন সামাজিক ক্রমবর্ধন। এমনকি, কিছু বিশেষজ্ঞ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের জন্য প্রোৎসাহিত করে, যেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তির মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করা হয়।

অন্য দিকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বাঙালি জনগণ থেকে বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সুস্পষ্টকরণ এবং বাংলাদেশের সব উপজাতিকে বাংলাদেশী পরিচয়ে অন্তর্ভুক্তকরণের লক্ষ্যে। এ জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত বিতর্ককে স্বচ্ছতর করার লক্ষ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শিকড় অন্বেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

বাঙালির পরিচয়
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা বাঙালিয়ানার ডামাডোল প্রতিনিয়ত শোনা গেলেও বাঙালি কারা তা নিয়ে রয়েছে ঘোরতর অস্পষ্টতা। বাঙালি জাতিসত্তার শিকড় খুঁজতে হলে এ জাতির নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক এবং রাজনৈতিক মূল নিয়ে আলোচনা আবশ্যক। প্রথমে নৃতাত্ত্বিক মূলের বিষয়ে আলোচনা করা যাক। বাঙালি জাতি হচ্ছে বহু জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ। জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। নরগোষ্ঠীগুলো হলো নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট্রেলীয়। নিগ্রীয়রা ভারতীয় উপমহাদেশে বাইরে থেকে আসা প্রথম জনগোষ্ঠী। তাদের আগমন ঘটে আফ্রিকা থেকে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে তাদের বংশধররা এখনো বিদ্যমান। নিগ্রীয়দের পর আগমন ঘটে অস্ট্রেলীয়দের।

নৃবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, তাদের আগমন ঘটেছে পাঁচ হাজার বছর আগে। ভারতীয় উপমহাদেশে সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় অস্ট্রেলীয়দের মাধ্যমে। তারা ধান ও বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ এবং ইক্ষু থেকে চিনি উৎপাদন করত। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্ট্রিকভাষীরা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি জনগোষ্ঠী আদি অস্ট্রেলীয়দের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও উপস্থিতি দেখা যায়। মঙ্গোলীয় নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে। এ আদি জনগোষ্ঠীগুলো দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পরে। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রণ ঘটে পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনে। ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে। গুপ্ত, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তধারা। পাকিস্তান আমলেও রক্ত মিশ্রণ প্রক্রিয়া বিদ্যমান ছিল; এমনকি একাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশেও বিশ্বায়নের প্রভাবে এ প্রক্রিয়া দৃশ্যমান। এ শঙ্করায়ণে বাঙালিদের কোনো একক নৃতাত্ত্বিক জাতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

ভাষাগত দিকের ব্যাপারে বলা যায়, বাংলা ভাষা বাঙালির সংজ্ঞায়নের মূলভিত্তি। বাংলাভাষীদের সাধারণত বাঙালি বলা হয়। আর এ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করে। মাগধি প্রাকৃতের (খ্রি.পূ ৬০০-খ্রি ৬০০) পরবর্তী স্তর মাগধি অপভ্রংশ এবং তৎপরবর্তী ৯০০-১০০০ সাল নাগাদ স্বাধীন নব্যভারতীয় আর্যভাষারূপে বাংলার উদ্ভব হয়।

বাংলা ভাষা মোটামুটি বিবর্তনের তিনটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে : ক) প্রাচীন বাংলা যুগ (৯০০/১০০০-১৩৫০ সাল), মধ্যবাংলা (১৩৫০-১৮০০ সাল) এবং আধুনিক বাংলা (১৮০০-চলমান)। প্রাচীন বাংলায় সংস্কৃতের প্রভাব লক্ষ করা যায়। কারণ সে সময় পুরো ভারতের রাজদরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। তবে সেন আমলে সংস্কৃতকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে অবহেলা করা হয়। বাংলা ভাষাকে সাহিত্য ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বাংলা ভাষাকে খুব নীচু চোখে দেখতেন। তারা ঘোষণা দেন, বাংলায় হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ও পুরাণ পাঠ করা পাপ। একটি প্রচলিত সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়, কেউ বাংলায় রামায়ণ ও মহাভারত শুনলে তার স্থান হবে রৌঢ়ব নামক নরকে। মুসলিমদের বাংলা জয়ের মাধ্যমে বাংলা ভাষার মুক্তি মেলে। মুসলিম সুলতানরা রাজকীয়ভাবে বাংলা ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। তাদের সময় রামায়ণ, মহাভারতসহ বিভিন্ন হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়। বিখ্যাত ভাষাবিদ সুকুমার সেন তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন, ১২০০-১৪৫০ সাল সময়কালের মধ্যে রচিত কোনো বাংলা সাহিত্যের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে না। সাহিত্য দূরের কথা, এ সময়কালে ভাষা হিসেবেও বাংলার কোনো হদিস মেলে না। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের অংশ থেকে বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থ ও কবিতার দেখা মেলে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় মুসলিম শাসন সুসংবদ্ধ হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সংস্কৃতর পরিবর্তে রাজদরবারের ভাষা হিসেবে ফার্সি প্রতিস্থাপিত হয়। এ সময় প্রশাসন ব্যবস্থায় নিয়োজিত হিন্দুরাও ধীরে ধীরে ফার্সিকে আয়ত্ত করে নেয়। মুসলিমরা এ সময় ফার্সি ও বাংলা উভয় ভাষাতে কথা বলত। ফলে বাংলায় প্রচুর আরবি-ফার্সি শব্দের প্রবেশ ঘটে। এ দোভাষী মুসলিম ও প্রশাসনের হিন্দু কর্মচারীদের চর্চায় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বা তারও আগে বাংলা এর জনপ্রিয় আকৃত লাভ করে।

আধুনিক বাংলার উৎপত্তি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে। ১৮০১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি ঔপনিবেশিক প্রশাসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে উইলিয়াম কেরিসহ কিছু ইংরেজ ভাষাবিদ এবং হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতায়ণ করা হয়। এ সংস্কৃতায়ণের পেছনে ইংরেজদের বাংলা ভাষায় আরবি-ফার্সি শব্দকে হিন্দুদের সংস্কৃত শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। এ নতুন বাংলা ভাষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় নতুন বাংলা গদ্যরীতি ও পরবর্তীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্য গড়ে ওঠে, যার ওপর ভিত্তি করে জন্ম নেয় তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁর।

এবার আসা যাক, রাজনৈতিক সত্ত্বা হিসেবে বাংলার ইতিহাসে। প্রাচীন যুগে বঙ্গ বা বাংলা নামে কোনো একতাবদ্ধ রাজনৈতিক এককের অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমান বাংলাদেশ বলি আর বৃহৎ বাংলা বলি গৌড়, রাঢ়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র, পুন্ড্র, সাতগাঁও, বঙ্গ ইত্যাদি নামক বিভিন্ন ছোট ছোট ভূখণ্ডে বিভক্ত ছিল। ১২০৩ সালে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ারুদ্দীন বখতিয়ার খিলজী গৌড় সাম্রাজ্য দখল করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ-ই প্রথম মুসলিম শাসক যিনি গৌড়, পুন্ড্রবর্ধন, সাতগাঁও, হরিকেল, সমতটকে একক রাজনৈতিক কর্তৃত্বাধীন নিয়ে আসেন। নিজেকে সুলতান-এ-বাঙ্গালাহ পদবিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে তিনি এ অঞ্চলকে সুবাহ-এ-বাঙ্গালাহ বা বাংলা প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। পরে এটাই ব্রিটিশ বাংলা হিসেবে পরিচিতি পায়। এই নৃতাত্ত্বিক, ভাষাভিত্তিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বাগত মূলই হচ্ছে বাঙালির পরিচয়ের তিনটি দিক যার শেষোক্ত দুটি বাঙালির পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের গোড়ার কথা
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আসে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণা। প্রাথমিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ যা সম্পৃক্ত করে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীকে, যাদের রয়েছে নির্দিষ্ট ভাষা, সংস্কৃতি ও নির্ধারিত রাজনৈতিক সত্তা। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক ভাবাদর্শ নয়। এর পেছনে ছিল ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্য কায়েমের বাসনা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষের বয়ানকে শক্তিশালী করতে ‘হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য’ তত্ত্ব সামনে আনা হয়। এ বয়ান অনুযায়ী নিকট অতীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিব্যক্তি ঘটেছে প্রথমে বাঙালি রেনেসাঁর মাধ্যমে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণীর যোগাযোগে বাংলায় যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে বাঙালি রেনেসাঁ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ রেনেসাঁর কেন্দ্রভূমি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের রাজধানী কলকাতা। যদিও এটাকে বাঙালি রেনেসাঁ বলে অভিহিত করা হয়, কিন্তু এটি সব বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করত না। মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত নতুন ভূমি-রাজস্বনীতির ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাংলায় নতুন জমিদার, ধনিক এবং মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী তৈরি হয়। তারা মূলত ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত ও এর সহায়তাকারী ছিলেন। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে তারা হিন্দু সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকেন্দ্রিক বাংলা ভাষার যে সংস্কার হয় এবং এর ফলে বাংলা ভাষার যে নতুন গদ্যরীতি উদ্ভব হয় সেটাকে ব্যবহার করে এ সময়ে একঝাঁক নতুন সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়; যারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষার নতুন রূপ প্রতিষ্ঠিত ও সমৃদ্ধ করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্রসহ আরো অনেক সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ-সংস্কারক এ বাঙালি রেনেসাঁর সৃষ্টি।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের দ্বিতীয় মাইলফলক ধরা হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সমন্বয়ে গঠিত বাংলা প্রদেশ শাসন করা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে কলকাতা ও এর আশপাশের জেলাগুলো সরকারের প্রায় সব মনোযোগ ও কর্মশক্তি আকৃষ্ট করায়, পূর্ব-বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। ফলে প্রশাসনিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে কার্যকর হয়। এ ঘটনাকে বঙ্গভঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর প্রতিবাদে বাংলার প্রভাবশালী শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা এটাকে ‘মাতৃসম বাংলা’-এর অঙ্গব্যবচ্ছেদ এবং ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে নষ্ট করতে ব্রিটিশ ভারত সরকারের চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বিদেশী পণ্য বর্জন ও দেশী পণ্য ব্যবহারের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ সমাবেশ ও পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করা হয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন একসময় সন্ত্রাসী আন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী এ চেতনাকে ডি এল রায়, রজনীকান্ত সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত গানের মাধ্যমে জনপ্রিয় করা ও ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সময়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সহমর্মিতা জানানোর অংশ হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্ধারিত হয়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরবর্তী মাইলফলক হিসেবে ধরা হয় ১৯৪৭ সালে প্রস্তাবিত স্বাধীন এবং অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবনা। মূলত দ্বি-জাতিতত্ত্বের আলোকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে পাকিস্তান ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে ভারত গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিপত্তি বাধে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশ নিয়ে যেখানে মুসলিমরা হিন্দুদের চেয়ে কম ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশের হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলো আলাদা করে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। বাংলা ভাগ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম, শরৎচন্দ্র বসু মিলে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে একটি স্বাধীন অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা পেশ করেন। প্রস্তাবটি মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ গ্রহণ করলেও, কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে এ প্রস্তাবনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরবর্তী মাইলফলক ধরা হয় ১৯৪৮-১৯৫২ সাল পর্যন্ত সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে পরিচালিত ভাষা আন্দোলনকে। প্রচলিত বয়ান অনুযায়ী, এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করে। ’৪৭-এর অব্যবহিত পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী নিজেদের মুসলিম পরিচয়কে অগ্রাধিকারযোগ্য মনে করে পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যেহেতু ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রধানতম বাহন, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক উর্দু চাপিয়ে দেয়ার এ সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে নিজেদের বাঙালিয়ানা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের যে বিজয় অর্জিত হয় তার আত্মবিশ্বাসের জেরে বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যাপকভাবে বাংলা সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ আরো প্রখর করার চেষ্টা করেন। এ উদ্দেশ্যে ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। পাক-ভারত যুদ্ধের জের ধরে এবং পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক চেতনাবিরোধী আখ্যায়িত করে ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার রেডিও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের সেকুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী অনেক রাজনীতিবিদও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষের পরবর্তী মাইলফলক ধরা হয় ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনকে। ছয় দফা ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার বৈষম্য অবসানে আওয়ামী লীগ ঘোষিত কর্মসূচি। তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা ও ঔদাসীন্যকে ছয় দফা প্রণয়নের পিছনে মূল প্রণোদনা হিসেবে ধরা হয়। ছয় দফায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশন হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাবনা দেয়া হয়। এ ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য পৃথক মুদ্রা, আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক ছাড়া রাষ্ট্রপরিচালনা সম্পর্কিত বাকি দিক প্রদেশীয় সরকারের হাতে ন্যস্তকরণ এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা আধা-সামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের প্রস্তাবনাও এ ছয় দফায় ছিল। ছয় দফাকে প্রধান মেনিফেস্টো করে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশ নেয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত মাইলফলক ধরা হয় হয় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একচ্ছত্র প্রতিনিধিদল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ক্র্যাকডাউন চালায়। এর মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ যার ফলাফল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

অস্পষ্টতার আঁধারে বাঙালি জাতীয়তাবাদ
বাংলাদেশের জন্মের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রচলিত বয়ানে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব পেশ করা হয়ে থাকে, যা পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্বর খণ্ডন। এ বয়ানে আরো বলা হয়ে থাকে, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে ওঠে, যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাথে সাথে আরো বিকশিত হয় বলে দাবি করা হয়। অবশেষে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ নিলে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠিত হয়।

১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পরবর্তীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেন। এর পর থেকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ-এর বিতর্ক চলমান রয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এর পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা ‘হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য’ থিসিস সামনে নিয়ে এসেছেন। এ প্রেক্ষাপট সামনে রেখে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমারেখা ও এর বিকাশে উপরোল্লিখিত মাইলফলকগুলো আলোচনার দাবি রাখে।

যেকোনো জাতীয়তাবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। বাঙালি জাতীয়তাবাদও এর বাইরে নয়। প্রথমে আসা যাক, রাজনৈতিক তাৎপর্য প্রসঙ্গে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ যদি বাংলাদেশের অন্যতম মূলভিত্তি হয় তা হলে স্বভাবত বাংলাদেশ সব বাঙালি জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা। অথচ আমরা জানি, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও বিহারে বিশাল সংখ্যক বাঙালির বসবাস, যারা কোনো ধরনের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাস করে না এবং সর্ব-ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করে তারা ভারতের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বসবাসকে বেছে নিয়েছে।

এবার আসা যাক, সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের আলোচনায়। মূলত এটি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের মাইলফলকগুলোর আলোচনা অনেকটা এক সাথে এসে যাবে। প্রথমে আসা যাক, বাঙালি রেনেসাঁর আলোচনায়। যে বাঙালি রেনেসাঁর সাংস্কৃতিক উৎপাদনকে বাংলাদেশের সেকুলার জাতীয়তাবাদী ধারাটি বাঙালি ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে, সেই বাঙালি রেনেসাঁকে আসলে বাঙালি রেনেসাঁ না বলে বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁ বলাটা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। পলাশীর বিপর্যয়ের পর বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রভাবশালী শিক্ষিত শ্রেণী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়তাকারীতে পরিণত হয়। বিশেষ করে কর্নওয়ালিস দ্বারা প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে হিন্দু রাজস্ব সংগ্রাহকরা রাতারাতি জমিদার বনে যায় এবং ধন-সম্পদ মুসলিমদের থেকে হিন্দুদের হাতে স্থানান্তরিত হয়। এ ছাড়া কলকাতা শহরে গড়ে ওঠে হিন্দু ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা ইংরেজ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও মিশনারিদের সাথে যোগাযোগ এবং তাদের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হওয়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় দর্শন ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। নতুন জ্ঞানে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা নতুন চিন্তা, দর্শন, জ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি উৎপাদনে ব্রত হয় এবং সে অনুযায়ী নিজেদের হিন্দু সমাজের সংস্কারে মনোযোগ দেয়। এ বঙ্গীয় রেনেসাঁর সম্মিলিত চিন্তা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলিমদের কেবল বাইরে রাখেনি, তা ছিল অনেকটা মুসলিম বিদ্বেষীও বটে।


আরো সংবাদ



premium cement