৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


১/১১ ও আ’লীগের পার্মানেন্ট সরকার

১/১১ ও আ’লীগের পার্মানেন্ট সরকার - ফাইল ছবি

এক-এগারোর রাজনৈতিক সংস্কারের ফলে আওয়ামী লীগের পার্মানেন্ট সরকার যে প্রতিষ্ঠা পাবে তা এক-এগারোর নায়করা যদি কল্পনা করতে পারতেন তাহলে তারা এটি ঘটাতেন না। এক-এগারো সংঘটিত হওয়ার যে কারণ তখন প্রচার পেয়েছিল তা হলো ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচন হতে যাচ্ছিল তা একতরফা হতো এবং চারদলীয় জোট সরকারই ক্ষমতায় ফিরে আসত।

সামরিক বাহিনীর সহায়তা ছাড়া ‘রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের সরকারের পক্ষে এই নির্বাচন সফল করা সম্ভব হতো না। তাই একতরফা নির্বাচন হলে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশী সেনাসদস্যদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে মর্মে জাতিসঙ্ঘের নামে একটি ই-মেল বার্তা রাষ্ট্রপতির দফতরে না এসে সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের কাছে এসেছিল। এই বার্তার অজুহাতে পাঁচ-ছয় হাজার সেনা সদস্যের স্বার্থ রক্ষায় জেনারেল মইন ও তার সহযোগী নবম ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি রক্ষীবাহিনীর সাবেক ডেপুটি লিডার বর্তমানে জাপার এমপি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথ ভঙ্গ করে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ঘটিয়েছিলেন, যা ঐতিহাসিক এক-এগারো নামে খ্যাত। তার খেসারত জনগণকে এখনো দিতে হচ্ছে ভোটাধিকার হারিয়ে।

১৯৯৬ সালের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ ও জাপাকে ক্ষমতায় বসাতে পারলেও তার স্থায়িত্ব এনে দিতে পারেনি। কাজেই সামরিক বাহিনী এসে রাজনৈতিক বিরোধের যে সামরিক সমাধান দেবে তা তাদের ভাগ্যে সৌভাগ্যের ডালা বয়ে আনবে জেনেই আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা বলেছিল, এটি তাদেরই আন্দোলনের ফসল।

এক-এগারো সংঘটিত করার মূল উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে গত ৩০ জুন ২০১১। ওই দিন ১৪ দলীয় জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী, এরূপ নির্বাচন সফল করতে সরকারি কর্মচারী, পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে বাধ্য। তবুও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সফল করতে ২০০৮ সালের ত্রাণকর্তা ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে তার পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে দুই দিনের মিশনে ঢাকায় পাঠাতে হয়েছিল। তিনি ১৫৪টি আসনে ১৫৩ জন প্রার্থীর বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন সফল করে বীরদর্পে ঢাকা ছাড়েন।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির প্রস্তাবিত নির্বাচনে ১৪ দল মনোয়নপত্র দাখিল করেও শেষ তারিখে তা প্রত্যাহার করে নেয়। সেটি ছিল নির্বাচন ভণ্ডুল প্রক্রিয়ার অংশ। ওই নির্বাচনে ১৪ দলের ২০০ আসনে জয় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আর ২০০ আসন না পেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা যাবে না। ফলে ২০০ আসনে জয় নিশ্চিত করতে নির্বাচন দুই বছর পিছিয়ে নেয়া জরুরি ছিল। সে জন্য হাইকোর্টে রিট করে নতুন ভোটার তালিকা প্রণয়ন বন্ধ করা হয়। এতে ২০০০ সালে প্রণীত ভোটার তালিকা হালনাগাদের পক্ষে রায় পায় আওয়ামী লীগ। ২০০০ সালের ভোটার তালিকায় প্রায় এক কোটি শুধু ভুয়া ভোটার নয়, দ্বৈত ভোটারও ছিল। অর্থাৎ একই ব্যক্তি গ্রামের বাড়িতে এবং শহরে কর্মস্থলেও ভোটার হয়েছিল। ২০০৬ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদকালীন ওই দ্বৈত ভোটারদের নাম তালিকায় থেকে গিয়েছিল। উপরন্তু পাঁচ বছরে যাদের ভোটার হওয়ার বয়স হয়েছিল তাদের নাম তালিকাভুক্তির সময় আরো ২০-২৫ লাখ দ্বৈত ভোটারের নাম তালিকাভুক্ত হওয়ার দ্বৈত ভোটারের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ হয়তো হয়েছিল যার সম্পূর্ণ দায় বিচারপতি আজিজ কমিশনের ওপর চাপানো হয়েছিল।

১৪ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল চেয়ে ১৯৯৯ সালে আওয়ামী আইনজীবীর করা রিটের হাইকোর্টে শুনানি হয়েছিল ২০০৪ সালে। বিএনপি আওয়ামী লীগের মতো তা বাতিলের সুযোগ গ্রহণ করেনি। অ্যাটর্নি জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল থাকার পক্ষে যুক্তিতর্ক প্রদর্শন করায় হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে দেন। রিটকারী আপিলের সুযোগ পান। ফলে আওয়ামী লীগের ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে নির্বাচনকালীন সরকারে বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ ছেড়ে দিয়ে বিএনপি উল্টো বিচারপতিদের চাকরিকাল দুই বছর বৃদ্ধি করে আওয়ামী লীগের হাতে আরো একটি মারণাস্ত্র তুলে দেয়। যার সঠিক ব্যবহার আওয়ামী লীগ যথাসময়ে করেছিল।

রাষ্ট্রপতি ইয়াজদ্দিনের সরকার ও বিচারপতি এম এ আজিজের নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ছিল না এটি আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল। ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশগুলোর সাথে লবিং করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ও যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী (যার ওপর সিলেট মাজারে গ্রেনেড হামলা হওয়ায় বিএনপির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন) সেনাপ্রধান জেনারেল মঈনের সাথে সাক্ষাৎ করার পর পর্যায়ক্রমে দুই নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক করেন। বেগম জিয়া সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বিশ^াস করেননি, অপর দিকে শেখ হাসিনার মন্তব্য ছিল সামরিক বাহিনী এসে যদি সব কিছু ঠিকঠাক করে দেয় তাহলে ভালোই হয়। জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা না ছাড়তে চাইলে কী হবে? শেখ হাসিনার মন্তব্য ছিল, ‘ক্ষমতা দখলের মতো সাহসী জেনারেল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নেই।’ (সূত্র : মহিউদ্দিন আহমদ রচিত এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-০৮)।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ভারতের সমর্থন পাওয়ায় জেনারেল মঈন এক-এগারো ঘটিয়ে ভেবেছিলেন তিনি ক্ষমতায় থাকছেন। আর তার সহযোগী জেনারেল মাসুদ ভেবেছিলেন সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতি হলে তিনি পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন। যার কারণে ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হওয়ার পরই জেনারেলরা সাবেক সামরিক সরকারের অনুকরণে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন অভিযানের নামে রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিল যার সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

জেনারেলরা ফটোযুক্ত ভোটার তালিকা (যা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আর কোনো জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি) প্রণয়নের জন্য দুই বছর সময় পাওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের পরিধি বাড়াতে বাড়াতে দুই নেত্রীকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। বেগম জিয়া যেহেতু সদ্য বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাই এক-এগারোর নায়কদের প্রচার-প্রচারণায় তার নিজের ও দলের ক্ষতিটা বেশি হয়েছিল যার খেসারত সবাইকে আজো দিতে হচ্ছে।

২০০৭ সালের নভেম্বরে হঠাৎ মোটা চালের দাম একলাফে দ্বিগুণ হয়ে পড়ায় খাদ্যসঙ্কট মেটাতে জেনারেল মঈনকে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে যেতে হয়েছিল। ভারত সফরকালীন তিনি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগের পুরনো বন্ধু প্রণব মুখার্জির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকালীন তার কথায় জেনারেলের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেলেও করার কিছুই ছিল না। কারণ এক-এগারো ঘটিয়ে অলরেডি তিনি ভারতের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন। তাই দেশে ফিরে দ্রুত ফটোযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন দিয়ে আওয়ামী লীগকে আজীবনের মতো ক্ষমতায় বসিয়ে মানে মানে বিদায় নিতে হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে যেমন ঢাকা বিভাগের ৯৬টি আসনের মধ্যে বিএনপি একটি আসনও পায়নি, একই অনুকরণে ২০১৮ সালের নির্বাচন হওয়ায় ঢাকা বিভাগে বিএনপিকে একটি আসনেও জিততে দেয়া হয়নি। অথচ ১৯৯১ সাল থেকে চারটি নির্বাচনে ঢাকা শহরে একমাত্র সাদেক হোসেন খোকা ছাড়া কোনো প্রার্থীই পর পর দইবার নির্বাচিত হতে না পারলেও ২০০৮ সালে নির্বাচিতরাই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন ৩০ জুন ২০১১ প্রবর্তিত নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে।

জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবে না নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হবে? প্রদেশবিহীন বাংলাদেশে একক কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে ভোটে তাদের পরাজিত যে করা যাবে না তা জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালে প্রমাণ করে গেছেন। যার ভিক্টিম ছিল আওয়ামী লীগ। যে দেশে কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে দেশ ত্যাগ করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় আবার প্রধান বিচারপতির খালি বাড়িতে ঢিল ছোড়ার অভিযোগে বিরোধী দলের ২৪ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে যেতে হয় সেখানে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে কোনো সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই জনগণের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

২০০৮ সালে নির্বাচনকালীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল না বলে ভারতকে গোপনে সহায়তা করতে হয়েছিল। প্রকাশ্যে করলে তার ফল হিতে বিপরীত হতো। ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে পারছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে। কারণ এর প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে ভারত ও চীন অভাবিত অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কর্নার করে ফেলেছে। ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে পরাশক্তির খেলায় পরিণত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান- যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের ফিলিস্তিনি নীতি অপরিবর্তিত থাকায় ফিলিস্তিনিদের যেমন আজীবন উদ্বাস্তু থাকতে হচ্ছে, তেমনি ভারতে বিজেপি বা কংগ্রেস যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন; তাদের বাংলাদেশ নীতি অপরিবর্তিত থাকায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন আশা করা বাতুলতামাত্র।

 


আরো সংবাদ



premium cement