২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডিজিটাল জুয়ার ফাঁদ

ডিজিটাল জুয়ার ফাঁদ -

অনলাইন জুয়া স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্যতার কারণে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ভয়ঙ্কর গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। লোভের হাতছানিতে মাকড়সার জালে ধরা পতঙ্গের মতো সব বয়সের মানুষ ডিজিটাল জুয়াড়ি ভাণ্ডারীদের ফাঁদে পড়ছে। এদের মধ্যে তরুণ শিক্ষার্থী ও যুবক শ্রেণীই বেশি। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন অনেকেই। বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক বিগ্রহ। শুরুতে কৌতূহলবশে অনেকে ধরা দিতেন এই নেশায়। কেউ কেউ লাভ করেনি এমনও নয়। হাজারে দু’একজনের বাজিমাৎ হতে দেখে এখন অংশগ্রহীতাদের সংখ্যা বেশুমার এবং এই অংশগ্রহীতাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন অ্যাপস এখন নিষিদ্ধ পল্লীর দেহপসারিণীদের মতো নেশার হাতছানি দিচ্ছে। ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের বাজি ধরা এখন উন্মুক্ত। জায়গায় জায়গায় এদের প্রতিনিধি বা এজেন্ট রয়েছে। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে থাকে। এই এজেন্টদের মাধ্যমে দেশের টাকা অবৈধ পদ্ধতিতে দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অনলাইন-ক্যাসিনোর মতো এসব এজেন্ট যে কী পরিমাণে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তারই একটা চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে পাওয়া একটি জরিপে। যাতে বলা হয়েছে, দেশে নিবন্ধিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা এখন ২১ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার।

গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে পেমেন্ট গেটওয়েগুলো (বিকাশ, নগদ, রকেট, এম-ক্যাশসহ মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান) মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করেছিল। ওই বছর জাতীয় বাজেটের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা (ভাবা যায় ব্যাপারটি?)। এই দরিদ্র বাংলাদেশে পেমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির লেনদেন জাতীয় বাজেটের দেড় গুণ। গ্যামব্লিং মার্কেট রিপোর্ট মোতাবেক গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট মৌসুমে অনলাইন জুয়ার বাজার বহর ছিল ছয় হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার! ওই রিপোর্টেও বলা হয়, অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্যের সূচক ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্বের মোট ‘ফেসবুক’ ব্যবহারকারীদের সংখ্যা হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম। ফলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো প্রচারণা বিজ্ঞাপন দেয়া খুবই সহজ এবং দ্রুত বিস্তারমান।

কোনো মতে একটা স্মার্টফোন কিনে এমবি ঢুকিয়ে মানুষ সহজ ও নিখরচায় নাগাল পাচ্ছে ‘নীল জগতে’ ঢোকার। এগুলোর সাথেও আমরা কম-বেশি পরিচিত। তবে সর্বনাশের শেষ পর্বটিও এখন মানুষের আঙুলের নাগালে। সেটি হলো অনলাইন গেম্স্ এবং অনলাইন জুয়া। অনলাইন গেমসের আসক্তি নবীন প্রজন্মকে এমন সব কল্পজগতে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে হত্যা এবং রক্তারক্তি ছাড়া আর কিছুই নেই। অনলাইন গেম্স্ থেকে তরুণ-কিশোরের অসহিষ্ণু, কলহপ্রিয়, বিবাদ-প্রেমী এবং হত্যার খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। বহু কচি প্রাণ ইতোমধ্যে ঝরেও গেছে। নেশাদ্রব্যে ঘায়েল হয় মানুষের স্নায়ু এবং মানসপ্রক্রিয়া আর এখন যে হারে অনলাইন জুয়ার মাদকতা শুরু হয়েছে, তাতে বহু পরিবার উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। আর অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে। ওই জুয়ার ‘স্টেক’ ধরার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কেউ বাবার পকেট কাটছে, কেউ মায়ের গহনা ধরে টান দিচ্ছে; কেউ আবার চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পথ ধরছে। একটি অপকর্মের উৎসমুখে জড়ো হচ্ছে আরো বহু অনাচার ও অপকর্ম। সত্যিই এক ভয়ঙ্কর নেশা এই অনলাইন জুয়া। এ যে কী ভয়ঙ্কর নেশা বলে বোঝানো যাবে না।

মাদকের চেয়েও ভয়াবহ এই অনলাইন জুয়ার নেশার লাগাম টেনে ধরতে সরকারকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। এই সর্বনাশা অনলাইন জুয়ার নেশার বিরুদ্ধে বিপন্ন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো মূল্যে যেকোনো উপায়ে তরুণ-কিশোরদের রক্ষা করতে হবে মোবাইল অ্যাপসে সংক্রমিত এসব জুয়ার আগ্রাসন থেকে। ‘ক্যাসিনোর’ জুয়ার ফাঁদের চেয়েও ভয়ঙ্কর এসব অনলাইন ‘ডিজিটাল’ আসর। এসব অনলাইন জুয়ার মধ্যে রয়েছে ‘ওয়ান এক্স বেইট’, ‘বেট উইনার’, ‘চরকার’ মতো আসর। এগুলোর দ্রুত বিস্তার সমাজদেহে ছড়িয়ে পড়ছে ‘ক্যান্সার’-এর চেয়েও দ্রুত প্রসারমান ম্যালিগন্যান্সির মতো। (কিংবা তার চেয়েও দ্রুত সম্প্রসারমান এই ঘাতক ব্যাধি)। বিপথগামী কিশোর-তরুণেরা অনলাইন গেমস থেকে ঘটিয়েছে অনলাইন জুয়ায়। সর্বনাশা বিষয়টি হলো, এসব জুয়া সমাজে এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করছে যে, মোবাইলফোনের সিমকার্ডে আগাম বিল (ফ্লেক্সিলোডের) মতো এখন এসব অনলাইন জুয়ার অ্যাপ্স্-এ টাকা ভরার জন্য শহর থেকে মফস্বলে রীতিমতো ‘এজেন্ট’ নিয়োগ করা হচ্ছে। এসব অনলাইন জুয়া যারা ‘হোস্ট’ করে ক্যাসিনোর মতো তাদেরও টার্গেট থাকে কিভাবে মানুষের টাকা হাতানো যায়। কদাচিত হয়তো কেউ সামান্য কিছু জেতে, যা এসব কোম্পানির বিনিয়োগের বড় জোর ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী আশায় আশায় বেট ধরে এবং হারতে হারতে সর্বস্বান্ত হয়। জুয়ার যা নিয়ম!

এই একই কাজ করছে অনলাইন ‘স্ক্যামাররা।’ স্ক্যামিং হলো এক ধরনের ডিজিটাল প্রতারণা। এরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে আপত্তিকর ও অশ্লীল কনটেন্ট চুরি করে কিংবা কিনে নেয়। এরপর বিদেশীদের ওয়েবসাইটে তাদের পরিচয় গোপন করে প্রবেশ করে এবং যা ইচ্ছা তাই ‘পোস্ট’ করে। এগুলোর সাথে সত্য এবং বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। তারা ওই সব অপকর্মে জড়িত হওয়ার প্রলোভন দেখায় গ্রাহককে এবং প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে যারাই এসব অফারে ‘নক’ করে তারাই বন্দী হয়ে পড়ে ‘ডিজিটাল ক্রাইম নেটওয়ার্কে’। গ্রাহকও ডলার বা ইউরো ছাড়তে থাকে। কারণ লোভ তো অসীম এবং অনিবারণযোগ্য। এই সুযোগকেই কাজে লাগায় স্ক্যামাররা।

যে তরুণরা জুয়ায় হারতে হারতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে তারা নিজেরাই শুধু ক্ষতি ও দুর্ভোগে পড়ছে না, তাদের পরিবার পরিজনকেও মারাত্মক সঙ্কটে ফেলছে। তারা বন্ধ ুহারাচ্ছে, লেখাপড়ায় বিচ্যুতি ঘটছে, মেধা যা ছিল জুয়ার প্রতিযোগিতায় ক্ষয়ে গেছে; এলাকায় তাদের মুখ দেখানোর উপায় নেই। হতাশা থেকেই এদের অনেকে ধরছে মাদকের বিষ। ভাবছে এতে হয়তো দুঃখ ভুলে থাকা যাবে। কচু হচ্ছে! মাদকের ঘোর কেটে গেলেই দুশ্চিন্তা ও ক্লান্তি এসে ভর করছে তাদের দেহমনে। অপমানের আত্মদংশন অত্যন্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন। সরকার বা সমাজ ডিজিটাল জুয়ার ভাণ্ডারীদের কিছুই করতে পারছে না। পারার কথাও নয়। কারণ এই সব সাইট বিদেশে বসেই পরিচালিত হয়। স্থানীয় ভেণ্ডাররা কেবল টাকা গ্রহণ ও এন্ট্রি করার ক্ষমতা রাখে। এই টাকা তারা কোন দেশে কার হিসাবে পাঠাচ্ছে, তা নিজেরাও জানে না। সরকার জুয়া আইন ২০২৩ পাস করেছে। এই আইনে অন্যান্য অফ-লাইন জুয়ার মতো অনলাইন জুয়া বন্ধ করারও সুযোগ রয়েছে। তবে ভাণ্ডারীরা বিদেশে বসে এসব জুয়ার আসর বসায় বলে তাদের নাগাল পাওয়া খুবই অসাধ্য।

সেদিন শুনে তো বিস্মিত হয়ে গেলাম, অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বড় ডিজিটাল ভাণ্ডার ‘ইবঃ-৩৬৫’এর বিশ্বজুড়ে গ্রাহকসংখ্যা দেড় কোটি! তাদের মতো জুয়ার ভাণ্ডারীদের তথাকথিত আত্মপক্ষ সমর্থনের মধ্যে ‘ইতিবাচক’ দিকগুলো হলো এতে বিনিয়োগ কম (১০ ডলার), এই জুয়া ‘অত্যন্ত বিনোদনমুখী’, সুবিধাজনক ও ‘উত্তেজনায় ভরপুর,’ বেটিং গ্রাহকের ‘সাধ্য ও অভিরুচির’ ওপর নির্ভরশীল বিষয়টি ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তার’ নিশ্চয়তা দেয় এবং ‘নিরাপদ’। তাছাড়া রয়েছে ‘বোনাস এবং নানা ধরনের পুরস্কার।’ আরো রয়েছে জুয়াকে খেলাধুলার সাথে জড়িত করার নানা ফন্দি-ফিকির। যেমন ‘স্পোর্টস বেটিং’, ‘ক্যাসিনো গেমিং’, ‘পোকার’, ‘হর্স রেসিং (ঘৌড়দৌড় প্রতিযোগিতা)’ কিংবা ‘ডেইলি ফ্যান্টাসি স্পোর্টস’। এসব ভাণ্ডারীর অনেকই অসৎ, ধাপ্পাবাজ এবং ঠগ। দেশের ব্যক্তিস্বাধীনতা (লিবার্টি)-কে কাজে লাগিয়ে তারা জুয়ার হাট-বাজার-পসার খুলে বসেছে। জুয়াকে এরা এতই ‘গ্রাহকবান্ধব’ করে ফেলেছে যে, আবহাওয়া রিপোর্ট দেখার চেয়েও এগুলোর অপারেশন সহজ (রেশমের মতো মিহি)। অনলাইন জুয়ার অনেক মাস্টার-পণ্ডিতও গজিয়েছে। অনেক কনসালটিং ফার্ম তাদের ওয়েবসাইট খুলে হাতে-কলমে জুয়ার তালিম দিয়ে থাকে। তবে ডিজিটাল জালিয়াতি (ঝপধস) সম্পর্কে কিছু বলে না এরা। সাইটগুলোর আইনগত বৈধতাও নেই। ‘ক্যাশআউট’ প্রক্রিয়াও জটিল ও সময়সাপেক্ষ। মাঝে মধ্যে ঝপধস অষবৎঃ ঝলক দিয়ে স্ক্রিনে উঠে এলেও এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা বা ঝপধহ অহঃরারৎঁং-এরও তেমন কোনো বালাই নেই।

গত করোনা অতিমারীরকালে অনলাইন জুয়া আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। শুধু ২০২২ সালেই জগৎজুড়ে অনলাইন জুয়াড়িরা উপার্জন করে এক বিলিয়ন ডলার আর একই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে এই বছরে বিশ্বজুড়ে অনলাইন জুয়া ও অনলাইন ক্যাসিনো ভাণ্ডারীরা আয় করে ২৭ বিলিয়ন ডলার। এ থেকেই বোঝা যায় ২৬ বিলিয়ন ডলারই গিলেছে জুয়ার ভাণ্ডারীরা। ভাণ্ডারীদের বিপক্ষে রয়েছে আদর্শ সমাজ; কিন্তু তাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে রাষ্ট্র এবং শাসক মহলের। কারণ জুয়া থেকে খাজনা আসে। জুয়ার নেশায় ডুবিয়ে রেখে ক্ষমতাসীনরা যা ইচ্ছে তাই করে যেতে পারে। সমাজ উচ্ছন্নে যায় যাক, সমাজ বদলের জাগরণ তো থেমে থাকে!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও চিত্রপরিচালক
hasnatkarimpintu@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement