০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একজন স্বৈরশাসকের উত্থান-পতন

নিকোলাই চসেস্কু - ফাইল ছবি

দুনিয়াতে বহু স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছে। তাদের মধ্যে রোমানিয়ার স্বৈরশাসক নিকোলাই চসেস্কুর নাম অনেকের জানা। বিশ্বের অন্য সব ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসকের চেয়ে চসেস্কু কম ভয়ঙ্কর ছিলেন না। তিনি ছিলেন এমন একজন স্বৈরশাসক, অনেকে তাকে ‘কার্পেথিয়ানের কসাই’ও বলে থাকেন। তার আমলে রোমানিয়ার লেবার ক্যাম্প, গুপ্তহত্যা ও প্রহসনের বিচারে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এমন একজন হিংস্র স্বৈরশাসকের উত্থান-পতন নিয়ে আজকের এই লেখা।

১৯১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি চসেস্কু রোমানিয়ার স্করনিসেৎসি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। অতিদরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে হয়ে ওঠেন দুনিয়া কাঁপানো একজন স্বৈরশাসক। মাত্র ১১ বছর বয়সে জুতা তৈরির কারখানায় কাজ করতে করতে, ১৯৩২ সালে তিনি স্থানীয় ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। ত্রিশের দশকে পার্টির কাজে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় হওয়ায় কয়েকবার জেলে যেতে হয়। ১৯৪০ সালে বন্দী শিবিরে থাকার সময় কমিউনিস্ট নেতা জর্জি জর্জুদেজের সাথে পরিচিত হন। এই রাজনীতিবিদের ব্যক্তিত্বে চসেস্কু দারুণভাবে আকৃষ্ট হন।

১৯৪৪ সালে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তির পর চসেস্কুকে ‘ইউনিয়ন অব কমিউনিস্ট ইউথের’ সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৬ সালে অল্টেরিয়া কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক সম্পাদক হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের আনুষ্ঠানিক সূচনা। এ বছর তিনি ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল এসেম্বলি’ নামে পরিচিত রোমানিয়ার পার্লামেন্টের সদস্যও নির্বাচিত হন। নিকোলাই চসেস্কু ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। পার্লামেন্টের সক্রিয় সদস্যপদ ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তার হাতে ন্যস্ত ছিল। ওয়ার্কার্স পার্টির দলীয় পদেও আস্তে আস্তে তিনি উচ্চস্থানে আরোহণ করতে লাগলেন। ১৯৫৫ সালে পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় দলীয় পর্যায়ে তার মর্যাদা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। ১৯৬৫ সালের ২২ জুলাই জর্জি জর্জুদেজ মৃত্যুবরণ করেন। চসেস্কু রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। এ বছর দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হয়- এর নাম হয় ‘সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব রোমানিয়া’। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, কমিউনিস্ট পার্টি একক পার্টি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ধ্বংসের পরিকল্পনা নেয়। সেই মোতাবেক, যত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল, সমাজের বিভিন্ন ধনী পরিবারের প্রভাবশালী মানুষজন এবং বুদ্ধিজীবীদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার মানুষকে জেলবন্দী করা হয়।

ষাটের দশকে চসেস্কু ‘আরবান অ্যান্ড রুরাল সিস্টেমাইজেশন’ নামে এক বড় প্রকল্প হাতে নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নতুন প্রকল্প ‘এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টারের’ জন্য জনশক্তি সংগ্রহ করা। এজন্য অভিনব ও নৃশংস পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। এ সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সব নারীর গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়াও, প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষকে ছিন্নমূল করে জোরপূর্বক অন্যত্র কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যা হিটলারের বন্দীশিবির ও স্ত্যালিনের শ্রমশিবিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৬৭ সালে চাসেস্কু এক নতুন পথ অবলম্বন করেন। রোমানিয়াতে নতুন ‘স্টেট সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট’ খোলা হয়। সরকারি এই সংস্থার এজেন্টদের সারা দেশে সাধারণ ও নিরীহ নাগরিকের ওপরে নজরদারি ও তৎপরতা চালানোর ক্ষমতা দেয়া হয়। যেকোনো প্রকারের বৈদেশিক সম্পর্ক রাখায় শুধু সন্দেহের বশে গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। তাদের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুরতম নির্যাতন। অঙ্গহানি করা হয় বহুজনকে।

১৯৬৯ সালে চসেস্কু রোমানিয়ার সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হওয়ার ফলে দেশটির সামরিক শক্তির উপরে তার অদম্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ২৮ মার্চ নিকোলাই চসেস্কুর জন্য ‘প্রেসিডেন্ট অব দ্য রিপাবলিক’ পদ তৈরি করা হয়। তিনি এ পদের আজীবন অধিকারী হিসেবে ঘোষিত হন। এরপর থেকে তার স্বৈরাচারের মাত্রা আরো বাড়ে এবং নিজের মতের বিরুদ্ধচারীদের ওপর চালাতে শুরু করেন অবর্ণনীয় নির্যাতন। বন্ধ করে দেয়া হয় সব ধরনের নাগরিক স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালে নিকোলাই চসেস্কু এশিয়ার কমিউনিস্টশাসিত দেশ চীন এবং উত্তর কোরিয়া ভ্রমণে যান। সেসব রাষ্ট্রে গিয়ে তিনি দেখতে পান ওইসব দেশের জনগণ তাদের নেতাদের জন্য কতটা পাগল। তা ছাড়া তিনি লক্ষ্য করেন ওইসব দেশের সব বড় বড় ভবন নেতাদের নামে, কমিউনিস্টদের নামে। তিনি মুগ্ধ হলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন রোমানিয়াতে পুরো দেশের মানুষের মধ্যে একক ব্যক্তিত্বের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলবেন এবং নিজের দেশকে বানাবেন উত্তর কোরিয়ার সংস্করণ। আর তিনি হবেন দেশের একমাত্র নেতা। নর্থ কোরিয়ার মতো বুকারেস্টেও বড় বড় ভবন বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালে রোমানিয়ায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে বুকারেস্টের বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিকম্পের পরপর নগরায়নের প্রচারণার ফলস্বরূপ এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সুংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে, একটি নতুন রাজনৈতিক প্রশাসনিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করেন। লক্ষ্য ছিল, একদিকে রাষ্ট্রের সব প্রধান সংস্থাগুলো একভবনে কেন্দ্রীভূত করার। তার এ কাজ করতে গিয়ে বহু গির্জা, ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়। স্থানান্তর করা হয় বহু স্থাপনা, এর পরিবর্তে বিপুল ব্যয়ে তৈরি করা হয় আধুনিক সব স্থাপত্য। বলা হয় ‘প্যালেস অব পার্লামেন্ট’, ইতিহাসে নির্মম স্বৈরশাসক রোমানিয়ার সাবেক কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কুর অনবদ্য গাঁথুনি! এতে রোমানিয়া পড়ে যায় গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে। বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে রোমানিয়া ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে।

১৯৮২ সালে রাষ্ট্রের বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমাতে নতুন পদক্ষেপ নেয়া হয়। এ পদক্ষেপের অধীনে সাধারণ নাগরিকের ওপর করের বোঝা বেড়ে যায়। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের বেশির ভাগ রফতানি খাতে চলে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব দেখা দিয়েছিল। কে কী খাবেন, কতটুকু খাবেন, কী কী জিনিস ক্রয় করতে পারবেন সব কিছু রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ফলে জীবনযাত্রার মান আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাচ্ছিল। বলা হয়, খাদ্যের অভাবে সে সময় প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় এসব খবর কেউ প্রকাশ করতে পারেনি। অধিকন্তু, শাসকদের বিলাসিতার কমতি ছিল না। যদিও জনগণকে ক্ষুধার্ত রেখে, সব ধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে শাসকের বিলাসিতা বেশি দিন টিকতে পারেনি। জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বৈরশাসকের সব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে।
আশির দশকের শেষের দিকে পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক আবহাওয়া পরিবর্তিত হতে থাকে। নিষ্ঠুর একনায়কদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশগুলোতে বিরোধীদের সশস্ত্র আবির্ভাব দেখা দিয়েছিল। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চসেস্কু রোমানিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বরে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে সরকারবিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল। ১৭ ডিসেম্বর দাঙ্গার নেতারা পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের দিকে সমবেত হওয়ার ঘোষণা দেন। চসেস্কু বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালানোর হুকুম দেন। প্রায় ৪ হাজার বিদ্রোহীর লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু বিরোধীদের আন্দোলন থেমে থাকল না। নৈরাজ্য আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। অস্ত্র ব্যবহার করেও জনমনে জন্মানো ক্ষোভ দমন করা যাচ্ছিল না। ২০ ডিসেম্বর উত্তেজিত জনতা কার্যত শহরের দখল নেয়। দলত্যাগী অনেক সামরিক সদস্যও তাদের সাথে যোগ দেন। চসেস্কু ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার শেষ চেষ্টা করেন। পার্টির ওপর জনগণের অসীম আস্থা প্রমাণে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষের সমাবেশের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। বুখারেস্টে কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল অফিসের সামনে দেয়া চসেস্কুর ভাষণ জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছিল। তাতেও জনরোষ ঠেকানো যায়নি। পরিস্থিতি চসেস্কুর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। জনরোষে রোমানিয়ার সামরিক বাহিনীও চসেস্কুর প্রতি তাদের সমর্থন উঠিয়ে নেয়।

প্রবল জনরোষে চসেস্কু সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে, ১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর চসেস্কু তার স্ত্রীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রাজধানী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে চসেস্কু দম্পতি গ্রেফতার হন। ২৫ ডিসেম্বর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, জনবিরোধী নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা তৈরির অভিযোগ আনা হয়। বিচারপ্রক্রিয়া ৫৫ মিনিট ধরে চলেছিল। সংক্ষিপ্ত এ বিচারে নিকোলাই চসেস্কু ও তার স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ২৫ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে গুলি করে সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে চসেস্কুর ২ দশকের স্বৈরশাসনের। রোমানিয়ার ইতিহাসে বড় দিনের এই ২৫ ডিসেম্বর হয়ে আছে বিপ্লবের অন্যতম প্রতীকী ঘটনা হিসেবে। ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে জনরোষে স্বৈরশাসকের পতন নিশ্চিতের সেই ঘটনা।

harun_980@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement