০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তাইওয়ান কি আরেক ইউক্রেন হতে যাচ্ছে

তাইওয়ান কি আরেক ইউক্রেন হতে যাচ্ছে - ছবি : সংগৃহীত

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়ে গেল তাইওয়ানে। গত ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দ্বীপটির প্রধান নির্বাহী পদে জিতেছেন লাং চিং তে। তিনি ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন। তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে নবনির্বাচিত প্রেসিডেট লাং চিং তে বলেছেন, তিনি তাইওয়ান দ্বীপের সার্বভৌমত্ব ও তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে কাজ করে যাবেন। তিনি আরো বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ এই দু’টির মধ্যে আমরা গণতন্ত্রকেই বেছে নিয়েছি।’ স্মরণ রাখতে হবে, এই নির্বাচনের ব্যাপারে চীনের আপত্তি থাকলেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল ও নির্বাচনে প্রতিফলিত সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত মেনে নিয়েছে।

চীন ও তাইওয়ানের মধ্য সম্পর্কের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই নির্বাচন তাইওয়ানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আর মনে করার কোনো উপায় নেই। ‘গণতন্ত্রপন্থীরা’ যতটা না উদার সংস্কারপন্থার পরিচয় দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচয় ফুটে উঠেছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে চীন-বিরোধ অবস্থানের পক্ষে ডিপিপি (ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির) মনোভাব। এ কথা তো সত্য, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোট চীনবিরোধী; কিন্তু মহাচীন তাইওয়ানের জন্য কোনো হুমকি নয়। চীন নিজে এবং জগৎব্যাপী চীনের মিত্র ও উন্নয়ন সহযোগীরা চীনের ‘এক চীন’ নীতি সমর্থন করে এবং তাইওয়ান যে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই ঐতিহাসিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবণ করে। ডিপিপির গণতন্ত্র পছন্দ করার সাথে চীনের প্রতি বৈরিতা নয়; বরং চীন এখন নিজেই মুক্তবাজার অর্থনীতির বৈশ্বিক উপমা। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনব্যবস্থা বলতে পশ্চিমারা সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ঢালাও সমালোচনা করে থাকে। এটি নিতান্তই একদেশদর্শী ও চীনবিরোধিতার মুখোশ বিশেষ। চীন বর্তমান বিশ্বে আমেরিকা ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বিপরীতে শোষিত ও বঞ্চিত বিশ্বের একমাত্র সহায়।

জগতের পিছিয়ে থাকা ৭০টি দেশের উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রেখে চলেছে চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বা বিআরআই বিশ্ব উন্নয়ন কার্যক্রম। চীনা মুদ্রা ইউয়ান এখন বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী মুদ্রা ডলারের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। চীনের উন্নয়ন সহযোগিতা বলয় শুধু এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীর এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলে বোঝা যেত, এটি চীনের আঞ্চলিক প্রভাবের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মহাকার্যক্রমে চীন সাথে নিয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ ও সুদূর ল্যাটিন দুনিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকেও। অস্ত্র বা যুদ্ধ নয়, অর্থনৈতিক শক্তি বা বাণিজ্যসুবিধা কাজে লাগাচ্ছে চীনের এই বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগিতা কার্যক্রমে। চীনের এই বিশ্ব-সহযোগিতা কার্যক্রম বা বিআরআইয়ের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার দর্শন বহু আগেই বিনিয়োগ বা অগ্রাধিকারে অতিক্রম করে ফেলেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী ‘মার্শাল পরিকল্পনা’কে। কেন না মার্শাল পরিকল্পনায় উপকৃত হয়েছিল শুধু তারাই, যারা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রজোট বা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে ছিল। কিন্তু চীনের এই বিশাল বিআরআই রাজনৈতিক দর্শন, এমনকি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান-নির্বিশেষে জগতের ৭০টি দেশকে মৈত্রী ও উন্নয়নের বেষ্টনীতে বেঁধে নিয়ে সত্যিকারের বৈশ্বিক সম্প্রীতি ও উন্নয়ন এবং শান্তির পথ রচনা করেছে। তারা অতি লঘু শর্তে সাহায্য দিচ্ছে, শুল্ক-প্রাচীর তুলে দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোর রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করছে, নতুন এক ‘বিশ্বব্যাংক’ গড়ে তুলেছে, দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা বিনিময় চুক্তি করছে, ডলারের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা থেকে জগৎকে বাঁচানোর বার্তা দিচ্ছে এবং বিশেষ করে, উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর অবকাঠামো (যেমন- সড়ক, ব্রিজ, বন্দর, আঞ্চলিক সংযোগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করছে। তারা লঘু ও অতি লঘু সুদে ঋণও দিচ্ছে; নিঃশর্তেও সহযোগিতা করছে।

বিআরআইয়ের বিস্তারিত রিপোর্টটি আমার পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাতে আমি দেখেছি, চীন এই বৈশ্বিক কার্যক্রম শুরু করার আগে, না কেউ এমন করে গোটা জগতের সমন্বিত ও সংযুক্ত উন্নয়ন নিয়ে ভেবেছে আর না কেউ তহবিল উজাড় করে দিয়ে বিশ্বব্যাপী এহেন উন্নয়নের ঢেউ জাগাতে এগিয়ে এসেছে। এই মহা-উন্নয়ন কার্যক্রমে কতকটা যেন নিষ্প্রভ ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা অন্যান্য উন্নয়ন সংস্থার সমষ্টিগত তহবিল!

এটি চীনের জন্য সম্ভব হয়েছে তার উন্নয়ন ‘জাদু’ এবং বিশ্বভাবনার উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এখন তাইওয়ান ‘চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে মূল ভূখণ্ড বা চীনের এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সহযোগীদের হয়ে কাজ করে, তাহলে সেটি হবে যেমন তাইওয়ানের জন্য আত্মঘাতী তেমনি পৃথিবীর প্রতি চীনের দায় এবং চীনের প্রতি বিশ্ববাসীর আত্মিক কৃতজ্ঞতার প্রতি কুঠারাঘাত।

তাইপেতে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার স্বপ্নকুঠুরিতে বসে যদি তাইওয়ানের নবনির্বাচিত দল ও তাদের নেতা মনে করেন যে, চীনের সাথে একত্রিত হয়ে মহাচীনের অংশ হয়ে থাকার চেয়ে পাশ্চাত্য সাম্র্রাজ্যবাদের উপপত্নী হয়ে নিজের ঘরে আগুন বা গৃহদাহ করাটা সুবিবেচনাপ্রসূত, তাহলে তো বলার কিছু নেই। তারা হয়তো ভুলেই গেছে যে, সাম্র্রাজ্যবাদ যার বন্ধু, তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না। তারা হয়তো ভুলেই গেছে, তাইওয়ান দ্বীপের ৬০ শতাংশ মানুষ চায় না চীনা মূল ভূ-খণ্ডের সাথে বৈরিতা করে সাম্রাজ্যবাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে। এই একই বিপদ ডেকে এনেছিল নিকারাগুয়া ও ভেনিজুয়েলা। তাতে তাদের সর্বনাশ ছাড়া উপকার কিছু হয়নি। হতে পরে না। ইরানের ইসলামী বিপ্লব ঠেকাতে ইরাক সাম্রাজ্যবাদের বন্ধু হয়েছিল। ইরান তার জায়গায় বহাল তবিয়তেই আছে; সাদ্দাম ধ্বংস হয়ে গেছে, ইরাকেরও কোমর ভেঙে গেছে।

ইউক্রেন যা করছে, তাও একই স্কেলে পড়ে। রাশিয়াকে পরাস্ত করতে পারেনি হিটলার-মুসোলিনি-তোজো-নেতাজী সুভাষ। সেই রাশিয়ার সাথে সমঝোতা না করে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের হয়ে লড়ছে। সবার অস্তিত্ব বিপন্ন করে জেলেনস্কি যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের সাথে সাঙ্গা বসল, তাতে দিনের শেষে খোঁজ করা দরকার যে, ইউক্রেনের লাভ হলো, না কি লোকসান হলো?

সেই ইউক্রেনের পথেই কি আত্মঘাতী যাত্রায় হাঁটা ধরেছে তাইওয়ান? ১৩ জানুয়ারি দ্বীপের চীনারা নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছে, তারও এক মাস আগে থেকে তারা অনেকেই বেসামরিক প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে। পুরোপুরি যেন একটি যুদ্ধেরই প্রস্তুতি তাইওয়ানে। এই যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে আমেরিকা ও পশ্চিমা জোটের দেশগুলো এবং সেই সাথে এই অঞ্চলে পশ্চিমা জোটের বড় সদস্য অস্ট্রেলিয়া (কতকটা নিউজিল্যান্ডও)। ইউক্রেন যুদ্ধ করছে তাদের সাবেক মূল ভূ-খণ্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর তাইওয়ান পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে লড়াই শুরু করতে যাচ্ছে চীনা মূল ভূ-খণ্ডের বিরুদ্ধে। কূটনৈতিক মধ্যস্থতার উপায়গুলো নিঃশেষ হওয়ার আগেই তাইওয়ানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে পশ্চিমা জোটের এই সম্ভাব্য যুদ্ধে তাইওয়ানবাসী পশ্চিমা মিত্ররা কেন প্রশান্ত মহাসাগরের নীল পানিক লাল করতে যাচ্ছে তা তারাই ভালো বলতে পারবে। আমরা যারা চীনের বাণিজ্য-অংশীদার ও আঞ্চলিক প্রতিবেশী- তাদের কেউই চান না এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিতে। যুদ্ধ চালাতে ব্যয় হবে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ।

যুদ্ধ শুরু হওয়া মানেই তাইওয়ান প্রণালীতে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়া। ঝুঁকি মানেই পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, আমদানি কমে যাওয়া। আমাদের ভালো রফতানি বাজার চীন। এ ক্ষেত্রেও আমরা বিপদে পড়ব। চীন গত দুই বছর ধরে আমাদের প্রায় সব (৯৮ শতাংশ) রফতানি পণ্যের উপর শুল্ক প্রত্যাহার করে আমাদের অর্থনীতি সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। আমরা যে বিশাল আমদানি করি চীন থেকে তা বাধাপ্রাপ্ত হলে আমাদের কত বড় ক্ষতি হবে তা ভাবাও সম্ভব নয়। আমাদের সমরাস্ত্র ও মিলিটারি হার্ডওয়্যার আসে চীন থেকে। আসে শিল্প সরঞ্জাম, ভোগ্যপণ্য-নিত্যপণ্য, কাঁচামাল, ধাতব পদার্থ, কৃষি উপকরণ, সুতা ও তুলা, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল; কী না? এগুলো বিশ্ববাজারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক দামে পাই। এ ছাড়াও আছে আমাদের এবং আমাদের মতো দেশে চীনা বিনিয়োগ (সরকারি ও প্রত্যক্ষ বেসরকারি বিনিয়োগ)।

এমনিতেই আমাদের অর্থনীতি নানা কারণে প্রতিবন্ধী হয়ে উঠেছে; তাইওয়ান নিয়ে আরেকটি যুদ্ধ মানেই আমাদের গভীর সঙ্কটে পড়া। তাই এই উত্তেজনা যেভাবেই হোক থামাতে হবে। আর একটি পরোক্ষ যুদ্ধের সংক্রমণ আমরা নিতে পারব না। চীনের ক্ষতি মানেই আমাদের ক্ষতি, সবার ক্ষতি- গোটা পৃথিবীর সর্বনাশ!


আরো সংবাদ



premium cement