০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ও বিশ্বের নীরবতা

গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ও বিশ্বের নীরবতা - ফাইল ছবি

ইসরাইলি আগ্রাসন ও হামলায় ফিলিস্তিনের গাজা এখন বিধ্বস্ত জনপদ। গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল নির্বিচারে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এসব হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার নিরপরাধ মানুষ। অর্থাৎ গাজার মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশকে হত্যা করেছে ইসরাইল। আর আহত হয়েছে ৫০ হাজার। নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউই এই হামলা থেকে রেহাই পায়নি। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনের ছোট ছোট শিশুরা যেভাবে মারা গেছে তার ছবি দেখে কোনো মানুষ স্থির থাকতে পারে না। ইসরাইলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধুলোয় মিশে গেছে হাজারো বাড়িঘর, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল। এসব হামলার সময় ইসরাইল কোনো ধরনের আইন-কানুন, আন্তর্জাতিক বিধিবিধান ও যুদ্ধের নিয়ম মানছে না। ইসরাইল সেখানে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে এবং গণহত্যা চালাচ্ছে। যখন যেখানে ইচ্ছা ইসরাইল বোমা হামলা চালাচ্ছে। গাজার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আজ উদ্বাস্তু। ইসরাইলের হামলা অব্যাহত থাকায় সর্বহারা এসব মানুষের কাছে ত্রাণের খাবার এবং চিকিৎসাসামগ্রীও ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না। গাজায় আজ নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়। কিন্তু গাজাবাসীর বড়ই দুর্ভাগ্য যে, তাদের সেই আর্তচিৎকার বিশ্বের নেতাদের কানে পৌঁছেনি। তাই ইসরাইলি বর্বরতা ও নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে নিরপরাধ ও নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষদের বাঁচানোর জন্য বিশ্বনেতাদের কেউই এগিয়ে আসেনি। বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে সাধারণ জনগণ এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানালেও পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ বিষয়ে নীরব।

জাতিসঙ্ঘ এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ। মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, আরব লিগ এবং জিসিসি সবাই আজ নির্বিকার। বিশ্বের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় নির্বিকার। পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলের নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনের নিরপরাধ জনগণকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি; বরং ইসরাইলের পক্ষে কথা বলে ও ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য করে সেই নির্যাতনের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরেই ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন ও নির্যাতন চলছে। যখন ইচ্ছা তখন, যাকে খুশি তাকে ইসরাইল হত্যা করছে। ইসরাইলের এই বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতায় কত ফিলিস্তিনি মারা গেছে, কত ফিলিস্তিনি আহত হয়ে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, কত ফিলিস্তিনি দেশান্তরিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে আর কত ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। যেন ফিলিস্তিনিদের জীবনের কোনো মূল্য নেই, তাদের কোনো অধিকার নেই।

ইসরাইল তার দখলদারিত্ব ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে কিছু দিন পরপরই ফিলিস্তিনের ওপর হামলা শুরু করে। এ যেন ইসরাইলের রুটিন ওয়ার্ক। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইসলামপন্থী হামাসকে নির্মূল করে স্বাধীনতা সংগ্রাম দমন করাই যে ইসরাইলের এই আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য, তাতে সন্দেহ নেই। গাজায় বারবার ইসরাইলের কেন এই বর্বর আগ্রাসন, হামাসই কেন ইসরাইলের প্রধান শত্রু এবং ইসরাইলি বর্বরতায় বিশ্ববাসীর নীরবতা কেন তা জানার জন্য ফিলিস্তিনি রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হবে।

ইসলামপন্থী হামাসের উত্থানে ফিলিস্তিনের রাজনীতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ফিলিস্তিনের রাজনীতি ও জনগণ এখন দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ, অন্যদিকে ইসলামপন্থী হামাস। ফাতাহর সাথে রয়েছে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। অন্যদিকে হামাস হচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী। ফাতাহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেছে। অপরদিকে, হামাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ফিলিস্তিন স্বাধীন করতে চায়। ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের সংসদ নির্বাচনে হামাস মোট ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৬টি আসনে বিজয়ী হয় ও সরকার গঠন করে। ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব প্রথমবারের মতো ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ায় ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা হামাসকে বয়কট করে, ফিলিস্তিনের প্রতি সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয় এবং ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর হামাসের নিয়ন্ত্রণাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধের লক্ষ্যে মার্কিন কংগ্রেসে প্যালেস্টাইনিয়ান এন্টি-টেরোরিজম অ্যাক্ট-২০০৬ নামে একটি বিল পাস হয়। এদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহর সাথে ইসলামপন্থী হামাসের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় ২০০৭ সালের ১৪ জুন ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ইন্ধনে ধর্মনিরপেক্ষ মাহমুদ আব্বাস ইসলামপন্থী হামাস সরকারকে বরখাস্ত করে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হামাস ওই দিনই গাজা দখল করে নেয়। সেই থেকে গাজায় চলছে হামাসের শাসন আর পশ্চিমতীরে চলছে ফাতাহর শাসন। আর ইসরাইল তখন থেকেই গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে, যা আজো অব্যাহত আছে। আর এটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অব্যাহতভাবে সমর্থন করে চলেছে। ফলে গাজা দীর্ঘদিন ধরেই একটি উন্মুুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে।

ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থীদের নির্মূল করে স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করাই ইসরাইল ও পশ্চিমাদের মূল লক্ষ্য। এ জন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হামাস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরাইল এমন একটি ফিলিস্তিন চায়, যেই ফিলিস্তিনের নেতৃত্বে থাকবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের অনুগত। এ জন্যই হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন গাজায় এই ভয়াবহ আগ্রাসন।

ধর্মনিরপেক্ষ ফাতার নেতৃত্বে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বল হলে ইসলামের ভিত্তিতে নতুন ফিলিস্তিন গড়ার প্রত্যয়ে ১৯৮৭ সালে শেখ আহমদ ইয়াসিন প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হামাস মোকাবেলা করেছে ইসরাইলের অব্যাহত নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র, যাতে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা। কিন্তু ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সব রকম নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে হামাস কেবল সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। হামাসের ওপর ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থন দ্রুত বেড়েছে। মূলত ইসরাইলের সাথে সখ্যের কারণে ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব থেকে ধর্মনিরপেক্ষপন্থীরা আস্তে বিদায় নিচ্ছে এবং সে জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইসলামপন্থীরা। আর এরাই হচ্ছে ইসরাইল ও পশ্চিমাদের আসল শত্রু।

ইসরাইল ২০০৪ সালের ২২ মার্চ ও ১৭ এপ্রিল প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে যথাক্রমে হামাসের প্রতিষ্ঠাতা ও আধ্যত্মিক নেতা শেখ আহমদ ইয়াসিন ও পরবর্তী নেতা ড. আব্দুল আজিজ রানতিসিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে হত্যা করে এবং প্রয়োজনে হামাসের সব নেতাকে হত্যার ঘোষণা দেয়। এভাবে নেতাদেরকে হত্যা করে, দমন নিপীড়ন করে ইসরাইল ও তার সমর্থকরা মনে করেছিল হামাসকে দমন করা যাবে। কিন্তু তা হয়নি।

হামাস গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বিজয়ী হয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। অথচ তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। আধুনিক মারণাস্ত্রের জোরে এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হামাসকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা সম্ভব হলেও সেখানকার জনগণের মন থেকে তাদের মুছে ফেলা সম্ভব নয়; বরং হামাসের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে এবং তারা আরো শক্তি অর্জন করবে। কারণ বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলের হাতে নির্যাতিত, স্বজনহারা ও বসতবাড়ি হারানো মানুষগুলোর একমাত্র আশা-ভরসার জায়গা এখন হামাসই। সুতরাং ফিলিস্তিনে স্বাধীনতাকামী হামাসের ক্ষয় নেই।

ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যকে মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার দাপট আর সামরিক শক্তির জোরে পৃথিবীকে বেশিদিন শাসন করা যায় না। গ্রিক, রোমান আর ব্রিটিশরা পারেনি। জার্মান আর সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব নেই। আর অনেক জায়গায় এটি প্রমাণ হয়েছে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র অপরাজেয় নয়। এই বাস্তবতা একদিন ফিলিস্তিনেও সত্য হয়ে দেখা দিতে পারে।

লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
ইমেল : omar_ctg123@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement