৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আন্দোলনের কৌশল সন্ধানে!

আন্দোলনের কৌশল সন্ধানে! - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ম রক্ষা করার জন্য কিভাবে আন্দোলন করতে হবে তার জন্য এই প্রবন্ধে বয়সভিত্তিক আন্দোলন বিভাজন করে দেখানো হয়েছে। মোট ছয়টি বয়সভিত্তিক স্তর করা হয়েছে। প্রথম স্তরে থাকবে দলের বুদ্ধিজীবীরা। এদের বয়স হবে ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। দল এদের ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকবে। যেকোনো রকম জেল-জুলুম হুলিয়া এরা সহ্য করতে পারবেন না। এ ধরনের অবস্থার শিকার হলে এদের মৃত্যুও হতে পারে। প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল তাদের কর্মকে দু’ধারায় বিভক্ত করবে। একটি হলো অভ্যন্তরীণ কর্ম, অন্যটি হলো বহির্মুখী কর্ম। এর সদস্যরা বহির্মুখী কর্মের সাথে যুক্ত হবেন। এদের বিশেষ পদবি থাকবে।

আলোচনার সুবিধার্থে একটি নাম এই প্রবন্ধে দেয়া হলো- তা হলো ‘পার্টি এনভয়’ বা দলীয় দূত। এরা বড় বড় প্রভাবশালী দেশে যাবে দলের হয়ে। যাকে আমেরিকাতে পাঠাবেন তার পদবি হবে (দলীয় পদবির বাইরে) পার্টি এনভয় ইন আমেরিকা বা আমেরিকায় দলীয় দূত। এদের দু’টি পদবি থাকবে। একটি হবে দলীয় পদবি আর অন্যটি হবে কর্মপদবি। কোনো দলের প্রেসিডিয়াম মেম্বার বা স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বার হয়ে কেউ যে দেশে নিয়োগ পাবেন সে দেশের দলীয় দূত হবেন। মূল পদবি ঠিক থাকবে এবং সেই পদবি শূন্য হবে না। এই আলোচনায় চার প্রক্রিয়ায় দলীয় দূত নিয়োগ করার কৌশল দেখানো হয়েছে-
১. বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোতে; ২. আমাদের দেশে বিনিয়োগ আছে এমন দেশগুলোতে; ৩. মুসলিম দেশগুলোতে; ৪. দলকে বা দলীয় প্রধানকে পছন্দ করে বা দলীয় শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বকে পছন্দ করে এমন দেশগুলোতে।

এরা যেসব কাজ করবে :
১. দলীয় দূতরা যিনি যে দেশে কর্মরত হবেন সে দেশের সরকারকে নিজ দেশের সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জ্ঞাত করে নিজ দলের অনুক‚লে সহযোগিতা করার জন্য কার্যকর প্রচেষ্টা চালাবেন।
২. সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রমাণপত্রসহ ওই দেশগুলোকে অবহিত করতে হবে। তাদের মধ্যে এমন বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে, আমাদের দেশে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং তা পরির্বতন করতে হবে।
৩. বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ। সরকারি চাকরির কত ভাগ অমুসলিম জনগণ ভোগ করছে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কত ভাগ অমুসলিম, ৬৪ জেলায় কতজন অমুসলিম জেলা প্রশাসক রয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কতজন অমুসলিমপ্রধান পদে আছেন তা তথ্যপ্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হবে। এটি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের জন্য নয়। করা হবে অতি উৎসাহী হয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়তি সুযোগ দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের বঞ্চিত করার জন্য। ইসলামী রাজনৈতিক নেতাদের হেনস্তা করা, গ্রেফতার করার বিষয় জানাতে হবে। মুসলিম ব্যক্তিত্বদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করার বিষয় আলোচনায় আসবে। সংখ্যাগুরুদের নির্যাতন করার জন্য কিভাবে হেইট ক্যাম্পেইন করা হয় সেটা জানানোর জন্য। তবে সব ৭০+ বছরের শারিরীকভাবে অক্ষম রাজনৈতিক নেতাকে দলীয় দূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। যারা চলাফেরায় সক্ষম তাদের এ কাজে নিয়োগ দিতে হবে।

দ্বিতীয় ধাপটির বয়স রেঞ্জ হবে ৬০-৬৯ বছর। এই অংশের নাম হবে দলীয় সম্পদ। এরা দেশের ভেতর থেকে সরকার হঠাও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন। এদের ¯স্লোগান হবে- সরকার হটাও, দেশ বাঁচাও। এদের আন্দোলন দু’টি ধারায় বিভক্ত হবে। একটি হলো- মাঠ-ময়দানভিত্তিক রাজপথকেন্দ্রিক। অন্যটি হবে বুদ্ধিবৃত্তিক। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য এরা সমমনা পেশাজীবীদের সংযুক্ত করে ‘কম্বাইন্ড ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট’ সৃষ্টি করবেন। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন হলো এমন এক আন্দোলন যে আন্দোলনে জান-মালের ক্ষতি হয় না, সরকারকে বুঝিয়ে, তা না হলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অথবা বলপ্রয়োগ করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন করা অনেক শান্তিপূর্ণ। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সর্বশেষ প্রক্রিয়া হলো- বলপ্রয়োগ। তবে এটি করতে গেলে সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাবনাকে কোনো অবস্থায় নাকচ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার বেসামরিক প্রশাসন, আধা-সামরিক প্রশাসন ও দলীয় কর্মী-সমর্থক নিয়ে বাধা দিতে পারে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দিলে এ ব্যাপারে ধারণা লাভ করা যাবে।

রক্তের খেলা যাতে না হয় তার জন্য কিছু দৃষ্টান্ত খুঁজে বের করতে হবে। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন সরকার যাকে বলা হয় সেনাসমর্থিত বেসামরিক সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে হটিয়ে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা দখল, মিয়ানমারে সু চিকে হটিয়ে সামরিকজান্তার ক্ষমতা দখল প্রভৃতি রক্তপাতহীন পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত।

আফ্রিকা মহাদেশে ১৯৫২ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ৮৫ বার অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পশ্চিম আফ্রিকায় ৪২ বার অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি ছাড়া বাকি অভ্যুত্থানগুলো রক্তপাতহীন ছিল।

তৃতীয় ধাপটির নাম হবে নেতৃত্ব। এদের বয়স হবে ৪৫ বছর থেকে ৫৯ বছর। এরা অভ্যন্তরীণ আন্দোলন পরিচালনা করবেন। এদের নেতৃত্ব হবে মাঠে-ময়দানে, সড়কপথে, নৌপথে, রাজপথে। দ্বিতীয় ধাপকে অবহিত করে তৃতীয় ধাপ নেতৃত্ব পরিচালনা করবে। ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চতর গ্রুপ পুরো ঢাকাকে চারটি অংশে বিভক্ত করে চারটি গ্রুপ নেতৃত্ব তৈরি করবে। প্রতিটি গ্রুপ রাজপথে থাকবে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা সমান থাকবে। কিন্তু গ্রুপের সব সদস্য এক সাথে মাঠে বা রাজপথে থাকবে না। মাঠে ও অন্তরালে পাল্টাপাল্টিভাবে অবস্থান করবে। গ্রেফতার এড়াতে নেতৃত্বকে এভাবে সাজাতে হবে। ছয় মাসের আন্দোলন পরিকল্পনা তৈরি করে এর ছয়টি ভাগ রচনা করতে হবে। প্রতি ভাগের মেয়াদ হবে এক মাস। প্রথম মাসে পতন করাতে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় মাসে পতন ঘটাতে হবে। এভাবে সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে সফলতায় পৌঁছাতে হবে।

অন্যান্য শহরে বা নগরেও ৫১ সদস্যের প্রধান গ্রুপ থাকবে, যারা তাদের অধীনে চারটি গ্রপ নির্বাচন করবে। প্রতি ১০ দিনে তাদের নেতৃত্ব পরিবর্তন করবে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য। অন্য দিকে অধীন চারটি গ্রুপ নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার জন্য এবং যেকোনো ধরনের ঝুঁকি এড়াতে প্রতি পাঁচ দিনে নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে হবে। তবে সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের অধীন নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে পারবে। এখানেও আন্দোলন পরিকল্পনা ছয় ভাগে বিভক্ত থাকবে। প্রতি ভাগের মেয়াদ হবে এক মাস।
চতুর্থ ধাপটির নাম Interaction বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এরা কাজ করবে সরকারের দ্রুত পতনের জন্য। এদের ব্যানার হবে- We work for democracy and work for save liberty. এদের স্লোগান হবে- দেখা হবে মিছিলে, কথা হবে স্লোগানে, লাঠিতে লাঠিতে শরীরচর্চা করো।’ এদের বয়স হবে ৩৫ থেকে ৪৪ বছর। এরা স্বাধীনভাবে কাজ করলেও অপেক্ষাকৃত উপরের ধাপের নির্দেশনা মেনে চলবে। সাধারণত পিকেটিং, পুলিশি বাধা মোকাবেলা, অবরোধ তৈরি করা, হরতালের মতো কর্মসূচি কঠোরভাবে পালন প্রভৃতির জন্য রাজপথে কঠিন আত্মরক্ষামূলক অবস্থান করবে। এরা কোনো ক্রিয়া করলে (যেমনÑ অবরোধ তৈরি) প্রতিক্রিয়া কী হয় তার ওপর ভিত্তি করে নতুন কর্মসূচি তৈরি করবে।

পঞ্চম ধাপটির নাম হবে বাস্তবায়ন। এরা মাঠে-রাজপথে কাজ করবে। এদের বয়স হবে ২৫ থেকে ৩৪ বছর। সরকার পতনের জন্য এরা উপরের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। এদের কাজ হতে পারে সচিবালয়সহ সরকারি অফিস আদালত ঘেরাও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অকার্যকরে ভূমিকা গ্রহণ।

ষষ্ঠ ধাপের নাম হবে সক্রিয় কর্মী। এদের বয়স হবে ১৮ থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত। এই বয়সটি হচ্ছে অসীম সাহসী বয়স। এরা সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করবে। সরকারি নির্দেশনা পালনকারী আধা-সামরিক বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনী বা সরকারদলীয় অ্যাক্টিভিস্ট কর্তৃক যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী হামলা বা অন্য যেকোনো বাধা মোকাবেলায় সামনে এরা থাকবে। এরা উপরের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করবে। এরা আন্দোলনের সম্মুখসারির সর্বাধিক কার্যকর অংশ। এ কাজের ঝুঁকি অনেক বেশি বলে দল থেকে এদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে আহত-নিহতদের পুরস্কারের ঘোষণা দল থেকে আসতে হবে। এরা মাঠে-রাজপথে অবস্থান করে আন্দোলন সফল করবে।

বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তা থেকে বিএনপি তথা বাংলাদেশের মুক্তির উপায় একটি গণ-অভ্যুত্থান। বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন বা অহিংস আন্দোলন দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন। আর এটি হবে কার্যকর গণ-আন্দোলন, সংক্ষিপ্ত সময়ের আন্দোলন। বর্তমান সংসদের মেয়াদ মাত্র কয়েক মাস রয়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার যদি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে সক্ষম হয় তাহলে নির্বাচনী ফলাফল তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনুক‚লে আসতে পারে এবং তা হলে তারা সরকার গঠন করবে। তাতে বিরোধী মতের ওপর নির্যাতন বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। ইসলাম ধর্মানুসারীদের ওপর চরম মাত্রায় নির্যাতন হতে পারে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারবিরোধী কঠিন আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। যদি কোনো আন্দোলন ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রভাবে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয় তাহলে কোনো অরাজনৈতিক সরকার গঠিত হতে পারে। এ অবস্থায়ও গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য বিএনপিকে আন্দোলন করতে হবে। ফলে অরাজনৈতিক সরকার বা নির্দলীয় সরকার আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগের সাথে হাত মেলাতে পারে (এখন এটা অসম্ভব মনে হতে পারে)।

প্রভাবশালী পক্ষগুলো নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারে। আনুমানিক দুই বছর সময় নিয়ে তারা এ কাজটি করতে পারে। তাই এখনই সময় আন্দোলন করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা। প্রাকৃতিক নিয়মে বা বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচে সরকারের পতন সম্ভাবনা রয়েছে। এর সাথে যদি আন্দোলন যুক্ত হয় তাহলে পতন ত্বরান্বিত হবে এমনটি আশা করা যায়।

লেখক : প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি
ই-মেইল : kazimain@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement