১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমরা শিক্ষার্থীদের মানুষ হওয়ার জন্য কী শেখাই

আমরা শিক্ষার্থীদের মানুষ হওয়ার জন্য কী শেখাই। - ছবি : সংগৃহীত

দার্শনিক ড. আলী শরিয়তি তার এক বইয়ে বলেছেন, আমরা মানুষ হিসেবে আগে নিজেকে আবিষ্কার করা বাদ দিয়ে বস্তুকে আবিষ্কার করার জন্য দিন-রাত খাটাখাটি করছি। এর মানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন- নিজের অস্তিত্বের খবর না নিয়ে, রোবট কিভাবে ফাংশন করে এই খবর নিতে আমরা এলাহি কাণ্ড ঘটিয়ে বেড়াচ্ছি। সমগ্র মানবজাতির সার্বিক সঙ্কটের মূল সমস্যাই হলো নিজেকে আবিষ্কার করতে না পারা। তাই এটি যেমন একটি মৌলিক সমস্যা, একইভাবে এটি একটি জাতীয় সমস্যা।

একজন শিক্ষার্থীর উচিত এখান থেকেই তার শিক্ষাজীবন শুরু করা। কিন্তু তা হচ্ছে কি? হচ্ছে না। কারণ, আমরা বিজ্ঞান পড়াই বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য, ব্যবসায় পড়াই ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য। কিন্তু মানুষ হওয়ার জন্য কী পড়াই? বলতে গেলে কিছুই পড়াই না। মানুষ হওয়ার শিক্ষা কিঞ্চিৎ পরিমাণ আছে দর্শন বিষয়ে, মানবিক শাখায়। কিন্তু অনেক স্কুল কলেজে মানবিক শাখাটি বাতিল করেছে, ফলে তা পড়ানো হয় না। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো এতটাই কমার্শিয়াল যে, মার্কেট ওরিয়েন্টেড বিষয় ছাড়া মানবিক বিষয়গুলো পড়ানোই হয় না। অথচ দর্শন বিষয়টি নিজেকে আবিষ্কার করতে বলে, এটি একটি মৌলিক ও অভিজাত বিষয় এবং দর্শন বিষয়টি সব ছাড়া জ্ঞানের অনুষদগুলো অচল।

মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী একটি মানবিক গুণ হলো বিচারবুদ্ধি (Reasoning)। বিচারবুদ্ধির উন্নয়ন ও প্রয়োগ নিয়ে আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত কোনো বই আছে কি? বইতে কোনো অধ্যায় আছে কি? অধ্যায়ে কোনো লেসন প্ল্যান আছে কি? নেই! তাহলে আমরা কী পড়াই? যদি না-ই থাকে তাহলে কী করে একজন মানবসন্তান পশু ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে? কী করে সে পশুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে তুলে এনে পরিপূর্ণ মানুষ হবে? হবে না, তাই প্রকৃত মানুষ হওয়ার সম্ভাবনাও তার নেই। তাহলে এই শিক্ষা যদি আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না দেই, তাহলে আর কোথায় তারা মানুষ হওয়ার মানবিক শিক্ষা পাবে? কেউ কেউ না বুঝেই বলে থাকেন, মানুষ হওয়ার নৈতিক শিক্ষা তারা পরিবারে পাবে। আমার প্রশ্ন হলো, পরিবারটি কোথা থেকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেবে, পরিবারের সদস্যরাই যদি মানুষ হওয়ার শিক্ষা না পেয়ে থাকে? আজকের শিক্ষার্থীরাও একদিন পরিবারের কর্তা কিংবা পিতা-মাতা হবে, যে নিজেই মানুষ হওয়ার শিক্ষা পায়নি, সে কী করে তার সন্তানকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেবে? আমরা যারা শিক্ষক আমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধিই বা কতটা প্রকট? আমরা নিজেরাও কি বিচারবুদ্ধির উন্নয়ন ও প্রয়োগ নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছি? না, করে আসিনি। তাহলে আমরা শিক্ষার্থীদের বিচারবুদ্ধি সম্পর্কিত কী শিক্ষা দেবো? যে বিষয়ে আমরা নিজেরাই সচেতন নই, সে বিষয়ে কী করে আমরা শিক্ষার্থীদের সচেতন করব? এ জন্যই মাঝে মধ্যে আমার নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়।

ঐতিহাসিক নমরুদের পার্লামেন্টের তার এক মন্ত্রীকে নমরুদ বলেছিল, এমন এক শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করা হোক, তার এই অধীনস্থ প্রজাদের খুব সহজেই বশে এনে তাদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা যায়। নমরুদের প্রশাসনে পরে হয়েছিলও তা-ই। একজন স্বাধীনচেতা সচেতন প্রকৃত মানুষকে বশে আনাও সম্ভব নয়, তার ওপর অন্যায় শাসন কায়েম করাও সম্ভব নয়। এ জন্য এমন প্রকৃত মানুষদের শাসকরা সব সময় ভয় পেত। ফলে এমন শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করা হতো, যাতে মানুষের আসল পাওয়ার বিচারবুদ্ধির মৃত্যু ঘটিয়ে তাকে জড় পদার্থের মতো দেহসর্বস্ব আত্মাহীন নিষ্ক্রিয় জীবে পরিণত করা যায় যাতে এ ধরনের মানুষদের শাসন করা খুব সহজ হয়ে ওঠে।

আমাদের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ নামে যারা পরিচিত, তারা এই দেশের মানুষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে, তারা জনগণের সেবক না হয়ে শাসকদের মর্জিমাফিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি চালু করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষ দিনে দিনে গুণ্ডা, মাস্তান, সন্ত্রাস, ঘুষখোর, মাতাল, নেশাগ্রস্ত, দুর্নীতিবাজ হয়ে পড়ছে। আমাদের দুর্নীতিপ্রবণ প্রশাসন ও রাজনীতির দিকে তাকালেই এর প্রকৃত চিত্র ও প্রমাণ পাওয়া যাবে।

আমাদের শিক্ষার্থীরা কেন অস্বাভাবিক আচরণ করছে? তারা কেন আত্মঘাতী কাজ করছে। তাদের জীবনের জন্য সেখানে ঝুঁকি আছে, কেন তারা সেখানে ঝুঁকিকে ঝুঁকি মনে করছে না? কেন তারা ঝুঁকি জেনেও অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে মারা যাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে? তাদের বিবেকবুদ্ধি কেন কাজ করছে না? আসল কথা হলো- বিবেকবুদ্ধি থাকলেই কাজ করবে! যদি তারা নৈতিকতা ও বিচারবুদ্ধি উন্নয়ন ও প্রয়োগের মধ্যে থাকত, তবে তারা দেখেশুনেও অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিত না, আত্মঘাতী কাজ করত না। যারা এ ধরনের কাজ করছে, আমাদের বুঝতে হবে, তারা শারীরিকভাবে মৃত্যুবরণ করার অনেক আগেই আত্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। সত্যি বলতে কী, তাদেরকে আত্মিকভাবে আগেই মেরে ফেলা হয়েছে। এই জন্য দায়ী এই সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য, বিকশিত হওয়ার জন্য, মৃত্যুবরণ করার জন্য নয়। তাই আমাদের আরো বুঝতে হবে, এ সব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ভিকটিম হচ্ছে সেই শিক্ষার্থী ও তার পরিবার এবং আমরা শিক্ষকসমাজ। আর নির্যাতক হচ্ছে এই নষ্ট সমাজব্যবস্থা, নষ্ট শিক্ষা, নষ্ট সংস্কৃতি ও তাদের ধারক-বাহকরা। একটি সমাজ নষ্ট হয়ে গেলে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকরাও নষ্ট হয়, অভিভাবকরা নষ্ট হয়, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরাও নষ্ট হয়, আইনজীবীরা নষ্ট হয়, ডাক্তাররা নষ্ট হয়, প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ীরা নষ্ট হয়, শাসক ও রাজনীতিবিদ, সবাই নষ্ট হয়। ভেতর থেকে সমাজের পচন ধরে। আমরা ও দিকেই যাচ্ছি।
ইমাম বাকের বলেছেন, মানুষের জীবনের পথ চলার জন্য তার দু’টি লাইট রয়েছে। এক হচ্ছে কুরআন, অন্যটি হচ্ছে তার বিচারবুদ্ধি। আমাদের সাধারণ শিক্ষার নামে সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় কুরআন শিক্ষা তো একেবারে নিষিদ্ধ। অথচ পবিত্র কুরআনে নৈতিক, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য কত জ্ঞান ও কত পথনির্দেশনাই না দেয়া আছে! ফলে তারা কুরআনিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে আধ্যাত্মিক ও নৈতিকতার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ইন্টারনেট সংস্কৃতিতে ডুবে থেকে অনৈতিকতা ও পথভ্রষ্টতার দিকে যাচ্ছে, বিপথগামী হচ্ছে। বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে বেখেয়াল, উদ্ধত ও অস্বাভাবিক আচরণ করছে। একইভাবে বিচারবুদ্ধির উন্নয়ন ও প্রয়োগ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান ও দর্শন পরিবার এবং শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পাচ্ছে না। ফলে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনের বিষয়টি অধরাই থেকে যাচ্ছে। মানুষের চালিকাশক্তি (Driving Force) হচ্ছে তার আত্মা (Soul)। যদি চালিকাশক্তি স্মার্ট হয়, তাহলে সেই আত্মাসম্পন্ন মানুষটিও স্মার্ট হবে। আপনারা স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো- কীভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বেন? স্মার্টের সংজ্ঞা কী? যে মানুষগুলো প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি, অত্যাচার, নিপীড়নের আস্তানা বানিয়ে নিয়েছে, তাদের আত্মা কি স্মার্ট? তাদের আত্মা তো চরমভাবে আনস্মার্ট, তাদের চরিত্র কলুষিত, তাদের বিবেক, বিচারবুদ্ধি ও মানবিক সত্তা মৃত। তাহলে কারা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বে? যারা ব্যক্তি হিসেবে নিজেরা স্মার্ট নয়, তারা কিভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়বে? তাদের কি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি আছে?
রেনে ডেকার্ত বলেছেন, I Exist, When I think । অর্থাৎ আমি অস্তিত্ববান হই, যখন আমি চিন্তা করি। এর মানে মানুষের চিন্তার সাথে অস্তিত্বের একটি সম্পর্ক আছে। সুতরাং যে শিক্ষাপদ্ধতি নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার সম্পর্কে চিন্তা, বিচারবুদ্ধি উন্নয়ন ও প্রয়োগ করতে শেখায় না; সে শিক্ষাপদ্ধতি বিকলাঙ্গ ও মানুষ গড়ার উপায় হিসেবে অনুপযুক্ত। আমরা নিজেদের আধুনিক দাবি করি, অথচ আজকের শিক্ষাপদ্ধতির চেয়ে প্রাচীন যুগের কিছু শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য বেশ উন্নত ছিল। প্রাচীন ভারতের বৈদিক শিক্ষার উদ্দেশ্য আজকের আধুনিক শিক্ষার উদ্দেশ্যের চেয়ে ছিল অনেক উন্নত। তখনকার শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল- প্রকৃত মানুষ তৈরি হওয়া আর এখন শিক্ষার উদ্দেশ্য দক্ষ কর্মী হওয়া। এই জায়গায় আমরা মানুষ, মনুষ্যত্ব ও মানবতা থেকে বহু দূরে চলে গেছি।

লেখক : প্রভাষক, মার্কেটিং বিভাগ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement