৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


টিকা বৈষম্যের এ আগুন, ছড়াবে বহুগুণ সবখানে

টিকা বৈষম্যের আগুন ছড়াবে সবখানে। - ছবি : সংগৃহীত

‘মহামারীর এ বিশ্বে আমরা কেউই নিরাপদ নই, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই নিরাপদ হই। আমরা কেউই দৌড়ে জিতব না, যতক্ষণ না প্রত্যেকেই জিতব’। বিশ্ব টিকা জোগান দাতা ‘কোভ্যাক্সে’র এই স্লোগান টিকা বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ার এক অনন্য স্বপ্নছোঁয়া স্লোগান। কথা ছিল সবার জন্য টিকা, এখন দেখছি কতকের জন্য টিকা আর কতকের জন্য টিকা ভিক্ষা। বিশ্বব্যাপী টিকা বৈষম্যের এ দুর্দশা দেখে মনে পড়ছে আরেকটি অগ্নিঝরা স্লোগান। আর তা হলো ‘টিকা বৈষম্যের এ আগুন, ছড়াবে বহুগুণ সবখানে’। একসময় ছিল টিকা অসচেতনতায় ভরা বিশ্ব ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করা হতো বিশ্ব জনতাকে; আর এখন রচিত হতে যাচ্ছে টিকা বৈষম্যে ভরা আরেকটি নতুন ইতিহাস, যার জন্য দায়ী করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে। টিকাকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী একসাথে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ গড়ে তোলা, ঝুঁকিযুক্ত দুর্বলদের ঝুঁকিমুক্ত করা। আর এখন হবে শুধু সবলরা ঝুঁকিমুক্ত আর দুর্বল-অবলারা হবে আরো ঝুঁকিযুক্ত, আরো দুর্বল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট হলো সেপ্টেম্বর, ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই অন্তত শতকরা ১০ জনকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা, শতকরা ৪০ জনের এ বছরের শেষ নাগাদ এবং শতকরা ৭০ জনের আগামী বছরের জুনের মধ্যে দুই ডোজ টিকা সম্পন্ন করা।

গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৫৯৫ কোটি লোক অন্তত এক ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে, যা বিশ্বের লোকসংখ্যার ৪৩.৩ শতাংশ। বিশ্বে প্রতিদিন কোভিড টিকা দেয়া হচ্ছে দুই কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার লোককে। অথচ ১০৭টি গরিব দেশের ১৩০ কোটি হতদরিদ্র লোকের মধ্যে মাত্র ১.৯ শতাংশ লোক এক ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে। এরই নাম ‘টিকা বৈষম্য’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়াসুস যথার্থই বলেছেন, বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের বৈষম্য এ মহামারীটি শেষ করতে এবং কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাধা। জীবন রক্ষাকারী এই ভ্যাকসিনকে সার্বজনীন করতে সব শক্তি সর্বোত্তম উপায়ে বিনিয়োগ করা এখন বিশ্ববাসীর সবচেয়ে অগ্রাধিকারযোগ্য কাজ। টিকা নীতিতে ‘কলঙ্কজনক বৈষম্য’ বিরাজ করায় মহামারীটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। টিকাগুলো ন্যায়সঙ্গতভাবে বিতরণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ব্যর্থতা এ মহামারীকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে, যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বল দেশ ও ব্যক্তিদের ওপর প্রভাব ফেলছে। বৈষম্যের বড় শিকার আফ্রিকা মহাদেশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৯ সালে বিশ্বে স্বাস্থ্যের জন্য ১০টি চরম হুমকির মধ্যে অন্যতম ছিল টিকা অসচেতনতা। আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি টিকা অসচেতনতাও আরেকটি রোগ। কিন্তু অন্য দেশগুলোতে টিকা অসচেতনতায় ভরা টিকার ইতিহাস যখন টিকা সচেতনতায় রূপ নিচ্ছে, তখন আবার টিকা বণ্টন বৈষম্যের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করছে উন্নত বিশ্ব। একসময়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভাগাভাগি করে আফ্রিকা শাসন করেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। এখন তারা টিকা-শাসন শুরু করেছে আফ্রিকায়।

আফ্রিকায় ভ্যাকসিনের অসম বণ্টন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান বলেছেন, আফ্রিকায় এই অসম বণ্টন শুধু আফ্রিকাবাসীকেই নয়, বরং আমাদের সবাইকেই মর্মাহত করেছে। এই অসম বণ্টন যত দিন থাকবে, করোনাভাইরাসের মিউটেশন-ভ্যারিয়েন্ট গঠনের সুযোগ তত দিন থাকবে। এভাবে যত ভ্যারিয়েন্টের জন্ম দেবে, তত ভ্যাকসিনের সব সফলতাকে ভণ্ডুল করে দেবে।

আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়া টিকা অসচেতনতার রাহুগ্রাস থেকে অনেকটা মুক্তি পেলেও আফ্রিকার অনেক দেশ এ ব্যাপারে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত।

তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এ মহাদেশের অন্তত ২৪টি দেশ লক্ষ্য অনুযায়ী টিকা দিতে পারেনি অসচেতনতার কারণে। এর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে জনসাধারণের অজ্ঞতা ও টিকাভীতি থেকে। রিপাবলিক অব কঙ্গো ও আইভোরিকোস্ট কোভ্যাক্স থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার যথাক্রমে ১৭ লাখ ডোজ ও পাঁচ লাখ চার হাজার ডোজ করোনার টিকা পেয়েছিল। কঙ্গো টিকা দেয়া শুরু করেছে মাত্র গত এপ্রিল, ২০২১তে। দেশটিতে দুই হাজারেও কম মানুষ টিকা নিয়েছেন। এ কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যবহার না হওয়া টিকা প্রতিবেশীদের দিয়ে দিতে হতে পারে।

আইভোরিকোস্টেও একই অবস্থা। ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র এক লাখ ৫৫ হাজার ডোজের মতো টিকা। কারণ মানুষের মধ্যে করোনার টিকা নেয়ার আগ্রহ খুব কম। যাদের টিকা অসচেতনতার ঘোর কেটে গেছে, তাদের আবার ‘টিকা নেই’ সমস্যা।

বাংলাদেশ, ঘানা ও উত্তর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশসহ বিভিন্ন দেশের অনেক টিকা সচেতন মানুষ সময়মতো টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরুর দিকেও অসচেতনতার মনোভাব অব্যাহত ছিল আমাদের দেশে। তখন টিকা ছিল কিন্তু টিকা নেয়ার লোক ছিল না। এখন টিকা নেয়ার লোক আছে; কিন্তু টিকা নেই। এ অবস্থা বিশ্বের নিম্ন আয়ের দেশে দেশে, যেন ‘টিকার দুর্ভিক্ষ’।

ধনী দেশগুলোর টিকা উদ্বৃত্ত
কিছু দিন আগে প্যারিসে ‘পিস ফোরাম স্প্রিং’-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধান বলেছেন, উচ্চবিত্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা বিশ্বের মাত্র ১৫ শতাংশ। অথচ তাদের কাছেই বিশ্বের মোট টিকার ৪৫ শতাংশ রয়েছে। এ দিকে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র ১৭ শতাংশ টিকা!
গরিব দেশগুলোর সমস্যা টিকা অসচেতনতা, না হয় টিকার অভাবে আশাহত তাদের সচেতনতা।

অন্য দিকে ধনী দেশগুলোর সমস্যা টিকার মজুদ আর কুটিলতা। হাতে টিকার উদ্বৃত্ত রয়েছে। সময়মতো ব্যবহার না হলে মজুদ করা টিকার মেয়াদ পেরিয়ে যেতে পারে। তবুও টিকা হাতে রাখা চাই। ধনী দেশগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা, বাড়াতে টিকার মজুদ-উদ্বৃত্ত।

একটা সময় মানুষের ধারণা ছিল দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় অনাবৃষ্টি আর খাদ্যের অভাবে। এখন মানুষ বুঝতে পেরেছে, দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা যায় মূলত সম্পদের অপচয় আর অসম বণ্টণের কারণে। করোনা মহামারীর এ দুর্যোগে অবস্থা যেন তাই। দুর্ভিক্ষ আছে শুধু শত শত কোটি মানুষের এই জনপদে। দুর্ভিক্ষ নেই মাছের নদী-সমুদ্রে অথবা হিংস্র জন্তুর নিবাস বনে-জঙ্গলে আর গভীর অরণ্যে। এক্ষণে দেশে দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে মহামারী করোনার ছোবলে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আরো লক্ষ-কোটি লোক মারা যাবে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন অপচয় ও অসম বণ্টনের কারণে।

ব্রিটেনে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি বছর যত খাদ্য উৎপাদন হয়, তার অন্তত ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ অপচয় হয়ে যায়। নষ্ট হওয়া এ খাদ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ২০০ কোটি টন। আমেরিকা ও ইউরোপের ধনী দেশগুলোতেই খাদ্য অপচয়ের মাত্রা ভয়াবহ। এসব দেশে মানুষ যে খাদ্য কেনেন, তার অর্ধেকই তারা না খেয়ে ফেলে দেন; কারণ খাবারের প্যাকেটের গায়ে কত তারিখের মধ্যে খাবারটি বিক্রি করতে হবে বা খেতে হবে, তা লেখা থাকে। যেখানে বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ কোটি বনি আদম ঘুমোতে যান ক্ষুধার পেটে, সেখানে এই অপচয় মেনে নেয়া যায় না কোনো মতে।

জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, এই নষ্ট হওয়া খাবার বিশ্বে মোট খাদ্য জোগানের এক-তৃতীয়াংশ, যা দিয়ে প্রতি বছর ২০০ কোটি মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভব। কোটি কোটি মানুষের এক ডোজ টিকার সৌভাগ্য হয়নি যেখানে, সেখানে কী করে ধনী দেশগুলো নিজ দেশের মানুষের মধ্যে বুস্টার ডোজের চিন্তা করে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান গরিব দেশগুলোর সাথে এ আচরণকে ‘চরম রসিকতার’ সাথে তুলনা করেছেন। আর বলেছেন অবিলম্বে সেপ্টেম্বরের আগে যেন কোনো বুস্টারের চিন্তা ধনী দেশগুলো না করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

ভ্যাকসিনের এ বিভক্তি ত্রিধাবিভক্ত নতুন এক পৃথিবীর আভাস দিচ্ছে? ৩১ জুলাই ২০২১ সালে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড ঘোষণা করে যে, টিকা বৈষম্যের কারণে পৃথিবী ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের দেয়া রিপোর্ট মতেÑ উন্নত, উদীয়মান ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জনগণের টিকাপ্রাপ্তির পরিমাণ যথাক্রমে ৩৯.৭ শতাংশ, ১১ শতাংশ ও ১.২ শতাংশ।

যে হারে উন্নত দেশগুলোতে টিকা উৎপাদন হচ্ছে, আশা করা যায় অতি সত্বর তারা এত পরিমাণ টিকা উৎপাদন করবে যে, নিজেদের চাহিদা পূরণ করার পরও অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত হিসেবে মজুদ গড়বে; কিন্তু গরিব দেশগুলোকে তার কিছুই দেবে না। নিম্ন আয়ের দেশগুলো টিকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পেরে করোনা সামলানোয় হিমশিম খাবে। এভাবে পুরো বিশ্ব কৃত্রিমভাবে পুরো টিকাযুক্ত, আংশিক টিকাযুক্ত ও টিকাবিহীন বিশ্ব- এই তিন ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। নিম্ন আয়ের দেশগুলো অসহায় আত্মসমর্পণ করবে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর কাছে। ঢোকার দরজা বন্ধ করে দেবে টিকাপ্রাপ্ত না হওয়ার ‘অপরাধে’। ফলে দেশে দেশে তৈরি হবে তীব্র অসন্তোষ আর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। ফল হিসেবে তীব্র হবে গরিব দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ। এ যেন এক পরিবারে এক বাপের অধীনে এক দুষ্ট মায়ের নিজ সন্তান আর সতীনের সন্তানের মধ্যকার বিরোধ। আমরা মানুষরা কথায় কথায় বলি ‘অরণ্যের বর্বরতা’। আসলে অরণ্যে কোনো বর্বরতাই হয় না, বর্বরতা হয় সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নামক এই মানব সমাজে। অরণ্যের হিংস্র পশুও হিংস্রতা দেখায় না তাদের পেট পুরা হয়ে গেলে। আর এ মানুষের পেট ভরে না প্রতিপক্ষের সব অধিকার কেড়ে নিয়ে ছলে বলে যতক্ষণ না নিভে প্রতিহিংসার আগুন। টিকার নামে এখন চলছে নীরব হিংস্রতা।

যখন থেকে করোনার টিকা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে, ধনী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তো বটেই, গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলে আসছে টাকার জন্য যাতে কোনো দেশ টিকা থেকে বঞ্চিত না হয়। অথচ এখন অনেক দেশ অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি করেও টিকা পায় না।

টিকা জাতীয়তাবাদ জিন্দাবাদ
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের মতো দেশ করোনার টিকা কিংবা এর কাঁচামাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান আদর পুনেওয়ালা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ভারতের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে আপাতত দেশের ভেতরেই টিকা সরবরাহে অগ্রাধিকার পাবে। অন্য কোনো দেশ এখনই টিকা পাবে না’। অথচ বাংলাদেশ তাদের ওপর ভরসা করে চুক্তি করে বিপদে পড়েছে। বাংলাদেশে টিকা সঙ্কটের মূলে আছে একক ও একমাত্র উৎসে নির্ভরতা। চুক্তি লঙ্ঘন করায় বাংলাদেশ টিকা সঙ্কটে দিনাতিপাত করছে। অথচ ভারত শুধু কোভ্যাক্সকেই সরবরাহ করার কথা মোট টিকার ৬০ শতাংশ।

টিকা বাণিজ্য
টিকা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে অভাবনীয় মুনাফা অর্জনের পথে। টিকা বিক্রি থেকে আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বে অন্তত ডজনখানেক নতুন বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ৩৫০ কোটি ডলারের টিকা বিক্রি করেছে ফাইজার, অথচ তাদের উৎপাদনের মাত্র ২ শতাংশ দিতে চেয়েছে কোভ্যাক্সকে। মডার্না আশা করছে, বছর শেষে তারা এক হাজার ৮০০ কোটি ডলারের টিকা বিক্রি করবে।

মেধাস্বত্ব দিতে নারাজ পশ্চিমারা
মেধাস্বত্বের ইংরেজি পরিভাষা ‘কপিরাইট’ বলতে আক্ষরিক অর্থে কোনো মৌলিক সৃষ্টির ‘অনুলিপি তৈরির অধিকার’ বোঝায়।

এটি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিদ্যমান একটি আইনি অধিকার, যাতে কোনো মৌলিক সৃষ্টিকর্মের মূল সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কোনো পক্ষ সেই সৃষ্টিকর্ম ব্যবহার করতে পারবে কি না কিংবা কোন শর্তে ব্যবহার করতে পারবে; সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে ওই মূল সৃষ্টিকর্তাকে একক ও অনন্য অধিকার দেয়া হয়। মেধাস্বত্ব সাধারণত একটি সীমিত মেয়াদের জন্য কার্যকর হয়ে থাকে। ওই মেয়াদের পর কাজটি সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।

কিন্তু উন্নত বিশ্ব সীমিত সময়ের জন্য সংরক্ষিত এই মেধাস্বত্ব আইনটি লঙ্ঘন করে নিজেদের টিকা-কর্তৃত্ব স্থায়ী করার লালসায় মেধাস্বত্ব এখনই গরিব দেশগুলোকে দিতে চাচ্ছে না; অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেধাস্বত্ব পেলে পৃথিবীর অনেক দেশ নিজেরাই কোভিড টিকা উৎপাদনে সক্ষম।

চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ করে করোনার টিকা তৈরিতে মেধাস্বত্বের শর্তগুলোয় ছাড় দেয়ার জন্য ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনে (ডব্লিউটিও) উপস্থাপন করা হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থনও দিয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বড় বড় নেতা মেধাস্বত্ব আইনে ছাড় দিতে রাজি নয়। এটি পাশ্চাত্যের একধরনের কপটতা। এরা ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল সেজে’ তৃতীয় বিশ্বের সাথে মোড়লিপনা করে; কিন্তু সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ, ক্ষনেক হাতে খড়ি, ক্ষনেক চাঁদের’ মতো আচরণ করে থাকে।

মেধাস্বত্ব উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো পৈতৃক সম্পত্তি নয় যে, তা আর কাউকে দেয়া যাবে না।

বাস্তবতা হলো টিকা উৎপাদনের ‘ইঁদুর দৌড়ে’ গরিব দেশগুলো শামিল হতে পারেনি। ধনী দেশের একচেটিয়া কর্তৃত্বে পৃথিবীবাসী দেখে টিকা নামক আলোর মুখ। কিন্তু টিকা উৎপাদনের পর ধনী দেশগুলো শুরু করে ‘টম অ্যান্ড জেরির’ মতো ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলা। ধনী দেশগুলো নিজেদের বিদ্যা আর বুদ্ধি দিয়ে টিকা আবিষ্কার করে বাণিজ্য করছে আর বাহবা নিতে চাচ্ছে গরিব দেশগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে অনেকটা ‘ভিক্ষার চাল কাড়া আর আকাড়ার’ মতো করে কিছু দান-খয়রাত করে। কিন্তু মেধাস্বত্ব দিতে ওরা নারাজ।

অথচ ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা, চিকিৎসা, ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ও প্রোফাইল্যাকটিক ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশে দ্রুত উৎপাদন বাড়াতে মেধাস্বত্ব আইনে ছাড় দেয়া এ মুহূর্তে জরুরি।

ব্যতিক্রম রাশিয়া-চীন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জি-৭ ও ভারত যখন টিকা জাতীয়তাবাদের জ্বরে আক্রান্ত; চীন ও রাশিয়া তখন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মন টিকা কূটনীতি দিয়ে জয় করতে চাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়ে নিজ দেশের জনগণকে আগে টিকা দেয়া শুরু করেছে; সেখানে চীন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে; কোথাও স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে গরিব দেশগুলোকে ভ্যাকসিন কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। ভ্যাকসিন কূটনীতিতে রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। লন্ডনের গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১) কোন কোন দেশে রাশিয়া ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে, তার একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। রাশিয়া ও চীন যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করেছে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের নিমিত্তে।

এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন যেভাবে বিতরণ করা হচ্ছে, তা চরম অসম, অন্যায্য ও অন্যায়। বিশ্বের ১৩০টি দেশ একটি ভ্যাকসিনও পায়নি (ফেব্রুয়ারি মাসে), অথচ মোট ভ্যাকসিনের শতকরা ৭৫ ভাগ মাত্র ১০ ধনী দেশের দখলে।

পশ্চিমা বিশ্বে টিকা মজুদের মহোৎসব
বিশ্বের এক প্রান্তে টিকার জন্য হাহাকার, অন্য প্রান্তে চলছে টিকা মজুদের মহোৎসব। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সানডে মিররে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, “এক্ষণে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রায় ৩০ কোটি টিকার মজুদ আছে। অন্য দিকে পুরো আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত মাত্র সাত কোটি লোক টিকা পেয়েছে।

যে হারে টিকার উৎপাদন হচ্ছে, বড়দিনের মধ্যে পশ্চিমারা যদি প্রাপ্তবয়স্ক সব ইউরোপিয়ান ও মার্কিনিকে একটি করে বুস্টার ডোজ টিকা দেয় এবং ১২ বছরের বয়সী শিশুদের সবাইকে টিকা দেয়, তা সত্ত্বেও তাদের কাছে টিকার অতিরিক্ত ১০০ কোটি ডোজ উদ্বৃত্ত থাকবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, টিকা পেতে আমরা এক নতুন ‘অস্ত্র’ যুদ্ধে নেমেছি। এটি হলো সেই ‘অস্ত্রের’ লড়াই, যাতে টিকা সরবরাহের একটি শক্তিশালী উৎস হয়ে উঠেছে পশ্চিমারা।” পশ্চিমারাই তো বলে বেড়ায়, গোটা বিশ্ব একটি পরিবার। এখন এই পরিবারের ঘরে ঘরে লেগেছে করোনা মহামারীর দাউ দাউ করা আগুন। আমরা মানে দুর্বল-অবলারা অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ করছি, ঘরের সবল পশ্চিমারা আরো কিছু হাতে করে নিয়ে তাদের শক্তি আছে বলে আগুন লাগা ঘর থেকে বের হয়ে বন্ধ করে দেয় বের হওয়ার দরজা-কপাট, আমাদেরকে ঘরে রেখেই যেন জ্বলে-পুড়ে মরে ছাই হয়ে যাই। কী নিষ্ঠুর-নির্মম রসিকতা!

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) করোনার তিন বিলিয়ন টিকা বা জনপ্রতি ৬ দশমিক ৬ ডোজ টিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা জনপ্রতি ৫ ডোজ, কানাডা ৪৫০ মিলিয়ন ডোজ; যা ৩৮ মিলিয়ন মানুষের জন্য জনপ্রতি ১২ ডোজ, যুক্তরাজ্য ৫০০ মিলিয়ন ডোজ, যা জনপ্রতি ৮ ডোজ এবং অস্ট্রেলিয়া ১৭০ মিলিয়ন ডোজ, যা ২৫ মিলিয়ন মানুষের জন্য জনপ্রতি প্রায় ৭ ডোজ টিকা সংগ্রহ করে রেখেছে।

ইউনিসেফের মতে, বেশির ভাগ উচ্চ আয়ের দেশ তাদের প্রয়োজনের চেয়ে কমপক্ষে ৩৫০ শতাংশ বেশি ডোজ টিকার মজুদ গড়ে তুলেছে। অন্য দিকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে টিকা সরবরাহের বর্তমান চুক্তিগুলোর সর্বাধিক হিসাবে তাদের জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেক অংশকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারবে কেবল ২০২৩-এর শেষের দিকে।
জি৭-এর পক্ষ থেকে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডোজ টিকা বিতরণের প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু এটি গরিব দেশগুলোর প্রয়োজনীয় এক হাজার ১০০ কোটি ডোজের চেয়ে অনেক কম। উন্নত বিশ্বের খুব কম দেশই আছে যারা তাদের প্রতিশ্রুতিমাফিক টিকা গরিব দেশগুলোকে দেবে। বিভিন্ন অজুহাতে এসব প্রতিশ্রুতির বিরাট অংশ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, হবেও না।

তার পরও গত আগস্ট মাসের দ্বিতীয়ার্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে উন্নত জি৭ দেশগুলো (যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, কানাডা ও জাপান) ২০২১ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ডোজ টিকা মজুদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ এই ১০০ কোটি ডোজ টিকা দিয়ে অন্তত ৩০টি দেশের সব নাগরিককে সম্পূর্ণভাবে টিকা দেয়া সম্ভব । বিজ্ঞান বিশ্লেষণ সংস্থা ‘এয়ারফিনিটি’র বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, বছরের শেষের দিকে ব্রিটেন ও তার সহযোগী দেশগুলোতে ৯৭ কোটি ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন অবশিষ্ট থেকে যাবে, যা বিশ্বের কয়েকটি গরিব দেশের জন্য এ মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন। বর্তমান হারে টিকার ডোজ চলতে থাকলে ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসেও নামিবিয়া, সিয়েরালিওন, গ্যাবন ও মেসিডোনিয়াসহ কয়েকটি দেশের জনগণের ২০ শতাংশও টিকা পাবে না। অথচ এয়ারফিনিটির অনুমান অনুযায়ী বলা যায় যে, জি৭ দেশগুলোর সম্পূর্ণ ডোজ এমনকি বুস্টার ডোজ সম্পন্ন হওয়ার পরও তাদের হাতে ১৭২ কোটি ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ডোজ টিকা অবশিষ্ট থাকবে। এর মধ্যে মাত্র ৭৪ কোটি ৭০ লাখ ডোজ টিকা এই মাসে ভ্যাকসিন ভাগ করে দেয়ার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কোভ্যাক্সকে দান করার কথা। এর পরও ১০০ কোটি ডোজ টিকা তাদের কাছে অবশিষ্ট থেকে যাবে। এ জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টিকার ডোজ মজুদ করার জন্য বিশ্ব নেতাদের বারবার নিন্দা করে চলেছে।

বিজ্ঞানীরা বিশ্ববাসীকে সতর্ক করছেন এই বলে যে, ভ্যাকসিনের অসম বণ্টন মহামারীটিকে দীর্ঘায়িত এবং বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন করবে।

জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলছেন, ‘মহামারীর এই কঠিন মুহূর্তে ভ্যাকসিন সমতায় নিয়ে আসাই বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আমেরিকায় ভ্যাকসিন মজুদ হয়েছে; অথচ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে ভ্যাকসিন পেতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় সব দেশে ভ্যাকসিনের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটি বৈশ্বিক ভ্যাকসিন প্রয়োগ পরিকল্পনার আহ্বান জানিয়েছিলেন গুতেরেস। এ পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবেন বিজ্ঞানী, সংশ্লিষ্ট দেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ প্রদানকারীরা।

টিকা বর্ণবাদ
শুনেছি, মানুষে মানুষে বর্ণবাদের বিষফোঁড়া পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে চলমান। কিন্তু এখন দেখছি, টিকা বর্ণবাদ আরেকটি বড় বিষফোঁড়া। উন্নত দেশগুলোর বর্ণবাদী নীতির কারণে বিশ্বব্যাপী ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ কোভিড-১৯’-কে উন্নয়নশীল দেশের মহামারীতে পরিণত হয়েছে। ফলে বিলম্ব ঘটছে মহামারীর সমাপ্তি এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে।

দেখা যাচ্ছে সাদা চামড়ার আর উত্তরের মানুষের দেশগুলো বেশির ভাগ টিকা উৎপাদন করছে। ফলে দক্ষিণের এবং এশিয়ান দেশে উৎপাদিত টিকার অনুমতি তাদের দেশে দিচ্ছে না। ফলে প্রত্যাশিত দেশের টিকা না নেয়ার অজুহাতে উন্নত বিশ্বে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে। অথচ এশিয়ান ও অন্যান্য গরিব দেশে তারা দেদার টিকা বিক্রি করছে। এভাবেই সারা পৃথিবী টিকা নিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিভাজিত হচ্ছে।

ইউরোপীয় কমিশন শুধু চারটি ভ্যাকসিন-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (শুধু ইউরোপে উৎপাদিত), ফাইজার, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্ব টিকা বর্ণবাদকে আরো উসকে দিয়েছে। এভাবে ভারতে অ্যাস্ট্রাজেনেকার মাধ্যমে উৎপাদিত টিকা, যা কোটি কোটি মানুষকে দেয়া হয়েছে, তাদেরকে এবং আরো অনেককে ইউরোপে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাদের টিকা না নেয়ার ‘অপরাধে’। অথচ টিকাটি আবিষ্কার করেছে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতে উৎপাদন হচ্ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার সহযোগিতায়।

এ জন্যই ক্ষুব্ধ ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বলেছেন, টিকা নিয়ে যা হচ্ছে তা কি ‘সবার জন্য টিকা’ নাকি ‘টিকা বর্ণবাদ?’

মৃত্যু বাড়ছে গরিব দেশগুলোয়
ধনী দেশগুলোয় মৃত্যুর সংখ্যা এ বছরের জানুয়ারিতে সরকারিভাবে প্রকাশিত বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৫৯ শতাংশ ছিল। টিকা দেয়ার হার অনেক বেশি হওয়ার বদৌলতে ২০২১ সালের মে মাসে এ হার বিশ্বের মোট মৃত্যুর ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে আমরা খুশি বই বেজার নই। কিন্তু নিজদের টিকা দিয়ে উন্নত বিশ্ব মৃত্যু হার কমিয়ে, টিকা মজুদ করে গরিব বিশ্বকে টিকা থেকে বঞ্চিত করায় যে মৃত্যুর ৮৫ শতাংশ এখন উন্নয়নশীল ও গরিব দেশে ঘটছে, তা তো এই টিকা বৈষম্যের কারণেই। নৈতিকতার মানদণ্ডেও এ আচরণ মেনে নেয়া যায় না।

প্রযুক্তিব্যক্তিত্ব সম্প্রতি বিল গেটস বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন পাওয়ার দৌড়ে শুধু ধনী দেশগুলো এগিয়ে থাকবে, এমনটি হওয়া মোটেই উচিত নয়। ভ্যাকসিনের অসম বণ্টনের ফলে মৃত্যুহার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে গরিব দেশগুলোতে’।

এ কারণেই জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব ধনী দেশগুলোকে সতর্ক করেছেন, ‘টিকার ন্যায্যতা আমাদের সময়ের বৃহত্তম নৈতিক পরীক্ষা। এটি একটি অবশ্য করণীয় প্রয়োজনীয়তাও। সবাইকে টিকা না দেয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেই হুমকির মধ্যে রয়েছে।’
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যার কমপক্ষে ৪০ শতাংশ এবং ২০২২ সালের মাঝামাঝি নাগাদ অন্যদের টিকা দেয়ার জন্য ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব করেছে। দেখা যাবে, এগুলোর বাস্তবায়নে নানা অজুহাতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে উন্নত বিশ্ব।

আইএমএফ ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে সৃষ্ট ‘বিপজ্জনক বৈষম্য’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে। এ অবস্থায় সীমিত রাজস্ব আহরণ, ঋণের উচ্চ বোঝা এবং দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলো করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়ার কাজটি হবে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ভ্যাকসিন পৌঁছানোর কাজে এ সময়ে প্রয়োজন হবে ৮০০০ বোয়িং ৭৪৭ বিমান। ভ্যাকসিন বণ্টনের পরিকল্পনাটি এমনভাবে করতে হবে, যাতে পৃথিবীবাসীর প্রতিটি মানুষ দুই ডোজ করে ভ্যাকসিন পায়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট দি গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের ওপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্ভর করছে।

রুশ-ভারত-মার্কিন-চীন এই শক্তি চতুষ্টয় টিকার মাঠে আধিপত্য বিস্তারে রাজনীতি আর কূটনীতির ঘুঁটি চালাচালি করছে। টিকানীতিই এখন রাজনীতির ‘কোমল অস্ত্র’ যা মোটেই কাম্য নয়। চীন ৪০টি দেশে টিকা বিক্রিসহ ৮০টি দেশকে ৩৫ কোটির বেশি টিকা ডোজ বিভিন্নভাবে দিয়েছে। আশার আলো নিভে যায়নি। মহামারী মোকাবেলায় ছয় দশক আগে পোলিওর টিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা বিশ্ববাসীকে উজ্জীবিত করে। তখনকার দুই বৈরী দেশ প্রমাণ করেছিল, প্রাণঘাতী রোগ মোকাবেলায় সহযোগিতার পথে রাজনৈতিক বৈরিতা কাঁটা হতে পারে না। তাই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হতে পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য। কোভ্যাক্স প্রতিষ্ঠা এমনই সমন্বিত পদক্ষেপের নীতিগত প্রতিফলন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন ভাগাভাগি সৌহার্দ্যরে পরিচয় কিন্তু আমাদের কেউই ভ্যাকসিন ভাগাভাগির ওপর নির্ভর করা চলবে না। নিজ দেশেই এর উৎপাদনে যাওয়ার বিকল্প নেই। তিনি আরো বলেন, এটি অবশ্যই বিশ্বের একটি বিস্ময় যে, এত তাড়াতাড়ি কোভিড ভ্যাকসিন হাতে পেয়েছি। আসুন, এ অলৌকিকতাকে সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য সহজলভ্য করে ফেলি।’

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি। শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।
dr.towhidhossain@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement