১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব

- প্রতীকী ছবি

১৯৫৭ সালে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন ১৯৫৭ (১০৭) গৃহীত হয়। ১৯৮৯ সালে গৃহীত ধারাটি সংস্কার করে ১৯৮৯ (১৬৯) করা হয়। এভাবে জাতিসঙ্ঘের শ্রম সংস্থা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণে পদক্ষেপ নেয়। ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসটি ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, জাতিসঙ্ঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান। পৃথিবীজুড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভূমি মালিকানার বিষয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। বেশির ভাগ আদিবাসীর ভূমির স্বত্ব নেই। তা ছাড়া অনেক আদিবাসীই ভূমি মালিকানায় বিশ্বাসী নন। তারা অধিকাংশই যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় প্রথাগতভাবে ভূমিতে দখল সত্তে¡ বসবাস করছে। বাংলাদেশে পার্বত্য ও সমতল অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা আদিবাসী জনগণের ভূমির মালিকানা নিয়ে সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৬০ ভাগ মানুষ ভূমিহীন। পাহাড়ে সরকার ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ভূমি কমিশন গঠন করেছে; কিন্তু সমতলে তা হয়নি। পাহাড়ে ভূমি কমিশন গঠিত হলে তা এখনো পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি।

১৯৯৪ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা শুরু হলেও ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠনের পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের উদ্দেশ্য। পাহাড় ও সমতল এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা আদিবাসীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ভূমি দস্যুদের কবল থেকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যেহেতু তারা অতি প্রান্তিক ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে এবং সেখানে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্য সব ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা অবস্থা নাজুক, তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগণ যেন এ দেশের নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে সরকার ও রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাহাড় ও সমতলের দরিদ্র ও প্রান্তিক জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম থেকে ঝরে না পড়ে, সে জন্য আর্থিক সহায়তাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। কিন্তু গত দুই যুগেও চুক্তির অনেকাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির যেসব ধারা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ভাইদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

বাংলাদেশে সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রায় ২০ লাখ নাগরিকের বসবাস রয়েছে। পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি) বাস করলেও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। তিন পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যতটা সোচ্চার, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ দাবি আদায়ে তেমন জোটবদ্ধ নয়। বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠনের সম্পৃক্ততায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যুব সমাজের মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে দক্ষতা ও সচেতনতা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান যুব সম্প্রদায় অনেক সময় নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সচেতন হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক নেতৃত্ব বা পুরনো ধারার মানসিকতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ তাদের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারে না। কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে, তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এ ছাড়া সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি। বর্তমানে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যা বিশেষত ভূমিচ্যুতি, ভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রতিরোধে তারা দৃঢ়ভাবে সোচ্চার রয়েছেন। ফলে তাদের মধ্যে অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে নিজেদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে কথা বলতে পারছে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের অবস্থান দেশের অন্য নাগরিকদের চেয়ে অনেক নিচে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান জানা না থাকলেও সাধারণভাবে তাদের বেশির ভাগের অবস্থান যে জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক নিচে, তা পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত অনেক ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার অবস্থান পর্যালোচনা করলেই অনুধাবন করা যায়। মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় অনেকেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। সমতল ও পার্বত্য এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রসার ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য দেশের সব বিশ^বিদ্যালয় ও চাকরি ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে আসনসংখ্যা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা উচিত এবং তিন পার্বত্য জেলার জন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা আজ সময়ের দাবি।

দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যদি মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে, তা হলে দেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন- কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হবে না। প্রভাবশালী ভূমি দস্যুদের কারণে অনেকের জমি নেই, এখন তারা দিনমজুর। কৃষিতেও এখন তাদের তেমন কাজ নেই। তাদের এখন যেকোনো কাজ করে জীবন বাঁচতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা যদি সবার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারি, তা হলে করোনা সঙ্কটও আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে পারব। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করে আমরা যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখি, তা হলে সমতল ও পাহাড়ের সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারব।

গতকাল ৯ আগস্ট ছিল বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘Leaving No One Behind : Indigenous peoples and the call for a new social contract. এ দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারা যেন দলিত ও প্রান্তজন হিসেবে পদদলিত না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াক এবং মৌলিক অধিকারের সব সুবিধা ভোগ করে নিজেরা স্বাবলম্বী ও প্রতিষ্ঠা লাভ করুক এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ততা আসুক- এটিই হোক এ দিবসের মূল মেসেজ। তারা যেন কখনোই অধিকার ও নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং শোষিত বা অবহেলিত না হয় রাষ্ট্রকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে তার সমস্যা ও সঙ্কটের গভীরতা অনুধাবন করে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সাথে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সমতল ও পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের বিভিন্ন সঙ্কট দূরীকরণে সরকারকে আন্তরিকভাব কাজ করতে হবে। কোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। তাই আসুন আমরা সবাই জাত্যাভিমান ও জাতিগত ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পাহাড় ও সমতলের সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান জানাই, তাদেরকে সাথে নিয়ে সুখী, সমৃদ্ধ ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাই।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
বিশ্বকাপের জন্য পাকিস্তানের ১৫ খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশিত আওয়ামী সরকার দেশে নব্য বাকশালী শাসন কায়েম করেছে : মির্জা ফখরুল শনিবার ১৫ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায় অন্যায়ভাবে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে : মান্ডা-জিরানী খালপাড়বাসী র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে : যুক্তরাষ্ট্র কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ কিশোরের লাশ উদ্ধার বাংলাদেশকে একটি সেকুলার রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে : হামিদুর রহমান আযাদ ইউক্রেনের শতাধিক ড্রোন প্রতিরোধের দাবি রাশিয়ার বাস্তবতা বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়নের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর জীবননগরে পাখিভ্যানের ধাক্কায় বাইসাইকেলচালক নিহত আড়াইহাজারে তরুণীকে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণ

সকল