০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুধীজনও ধরছেন না, সেটি ভুল না শুদ্ধ

সুধীজনও ধরছেন না, সেটি ভুল না শুদ্ধ - ফাইল ছবি

মাস্টার্স শেষপর্ব পরীক্ষায় ভাইভা বোর্ডের প্রধান ড. কাজী দীন মুহম্মদ স্যার। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানও তিনি। আমার প্রতি তার প্রথম প্রশ্ন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত কোন ছন্দের জন্য বিখ্যাত ছিলেন?’

আমার উত্তর সঠিক হলেও মানাতে পারছিলেন না। কারণ, উচ্চারণ জড়তায়, ‘অমিত্রাক্ষর’ শব্দটি বারবার ‘অমৃত্রাক্ষর’ হয়ে পড়ছিল। পরিশেষে খোঁজ নিলেন, আমার পাঠাভ্যাস সম্পর্কে। অর্থাৎ সরবে পাঠ করি না নীরবে পাঠ করি। গ্রাম এলাকায় বাড়ির কাছে স্কুল-কলেজ না থাকায় শৈশবেই লজিং থেকে পড়তে হয়েছে। লজিংবাড়ির শিক্ষার্থীদের সামনে সরব পাঠ সহজ ছিল না। আমার ‘নীরবে পাঠ’-এর বিষয় অবগত হওয়ার পর, ‘উচ্চারণের সাথে বানানের এবং বানানের সাথে উচ্চারণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে’- ড. কাজী দীন মুহম্মদ স্যারের কথাটি আজো মনে পড়ে।

কয়েক দিন আগে এক বাড়িতে বেড়াতে যাই। সেখানে সাত-আট বছর বয়সের এক মাদরাসা ছাত্রের উচ্চারণ শুনে বিস্মিত হই। পড়ালেখার খোঁজ নিতে গিয়ে আমার পাশে বসা শামসুদ্দিন ছাত্রটিকে প্রশ্ন করেন-

-মাখরাজ কয়টি? -১৭টি। -আরবি হরফ উচ্চারণের স্থান কয়টি ও কী কী? -হরফ উচ্চারণের স্থান তিনটি। যথা- ঠোঁট, মুখের ভেতর ও কণ্ঠনালী। শিশুটির উত্তরে বিস্মিত হয়ে জানতে চাই, মাখরাজ কী? জানতে পারি, ‘আরবি বর্ণের উচ্চারণের জন্য মুখের যে অংশগুলো ব্যবহার করা হয়, সেই অংশগুলোকেই মাখরাজ বলা হয়। আরবি বর্ণগুলো পৃথক কয়েকটি স্থান থেকে উচ্চারিত হয়। যেমন- কণ্ঠের নিচের দিক থেকে উচ্চারিত হয় ‘হামযা’, কণ্ঠের মাঝের দিক থেকে উচ্চারিত হয় ‘আইন’, কণ্ঠের উপরের অংশ থেকে উচ্চারিত হয় ‘খ’, ওষ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয় ‘বা, ফা, ওয়াও’ ইত্যাদি। আরবি নির্দিষ্ট বর্ণের উচ্চারণে সাহায্যকারী মুখের নির্দিষ্ট অংশকে ‘মাখরাজ’ বলা হয়। ব্যাপারটা অনেকটা বাংলা ভাষার ‘ধ্বনিতত্ত্ব’ এর মতো। যেমন- বাংলায় কোনো শব্দ ওষ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়, কোনো শব্দ তালব্য থেকে অথবা কণ্ঠ, দন্ত ইত্যাদি স্থান থেকে উচ্চারিত হয় এবং এই কারণেই ধ্বনিগুলোকে ওষ্ঠবর্ণ, নাসিক্যবর্ণ, তালব্যবর্ণ ইত্যাদি বলা হয়। আরবি ভাষা শুদ্ধ উচ্চারণসহ বিশুদ্ধভাবে লেখার জন্য মাখরাজ জানা আবশ্যক। তাই, আরবি ভাষা শিক্ষার শুরুতেই মাখরাজ শেখানো হয়। শৈশবে শেখা মাখরাজ মগজের ভেতর এমনভাবে প্রবিষ্ট হয় যে, বাকি জীবন আর এদিক ওদিক হওয়ার নয়।

ধ্বনিতত্ত্ব সব ভাষায়ই রয়েছে, রয়েছে বাংলা ভাষায়ও। ধ্বনিতত্ত্ব পড়েছিলাম মাস্টার্সে। পরীক্ষা পাসের জন্য যতটুকু পাঠ করা আবশ্যক, ততটুকু পাঠ করতে গিয়েই মগজ টগবগ করে ফুটতে শুরু করত। কারণ যে বিষয়টা কাঁচায় পড়া হয়নি সে বিষয়টা পাকায় পড়তে গিয়ে Tame the animal while it is young-এর মতো অবস্থা। কোনো নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি ও শিক্ষা-দীক্ষা প্রকাশের বাহনসহ ধরে রাখার একমাত্র উপায়, মাতৃভাষা। আমাদের স্বাধীনতার উৎসও এই মাতৃভাষা। জলের মাছ ডাঙায় না ওঠা পর্যন্ত যে কারণে জলের আবশ্যকতা টের পায় না সে কারণে ভাষাহরণ না হওয়া পর্যন্ত মাতৃভাষার অভাবও টের পাওয়া যায় না। দেশের সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য ১৯৮৭ সালে প্রণীত হয়েছিল আইন। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য ২৫ বছর পর মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ১৬৯৬/২০১৪ নং রিট করতে হয়েছে। তার পরও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাভাষা যেভাবে উন্নীত হচ্ছে, জাতীয় পরিমণ্ডলে সেভাবে উন্নীত হচ্ছে না।

উন্নীত না হওয়ার কারণ সমন্বয়হীনতা : ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ এর বিরোধিতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন, ‘ভাষাদূষণ বলে কোনো কিছু নেই। এখানে যা হচ্ছে তা ভাষাদূষণ নয়, ভাষামিশ্রণ।’ দূষণ আর মিশ্রণ এক কথা নয়। ‘দূষণ’ হলে ভাষা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে আর মিশ্রণে ভাষা হয় সমৃদ্ধ।

‘ঈদ’ করব না ‘ইদ’ করব শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ‘ইদ’ করার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন। ২৬ জুন ২০১৭ একই পত্রিকায় ‘ঈদ’ নিয়ে ধ্বনি-বিতর্ক : দীর্ঘস্বরের কি ভাগ্য? শিরোনামে প্রতিবাদ করেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুদ রানা। মোহাম্মদ আজম ‘সকল দেশি ও বিদেশি শব্দে ঈ-কার না বসে ই-কার বসবে’ মর্মে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত বাংলা বানানের অনুসারী আর মাসুদ রানা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ‘ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনি তত্ত্ব’-এর অনুসারী। বাংলা একেডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানরীতিতে রয়েছে তৎসম শব্দের ছয়টি, অতৎসম শব্দের ১১টি, সমাসবদ্ধ পদের ৫, মোট ২২ বানানরীতি। এই রীতিতে শব্দ দেখলেই তৎসম, অতৎসম, দেশী, বিদেশী সন্ধি ও মুক্ত শব্দ চেনা যায়। অথচ বাংলা বানান হ্রস্ব ই-কার (ি ), দীর্ঘ ঈ-কার ( ী ), হ্রস্ব উ-কার ( ু ) এবং দীর্ঘ ঊ-কার ( ূ) সমূহের ব্যুৎপত্তি ধ্বনিকে পাধান্য দিয়েছে। প্রমিত বাংলা বানানরীতির কারণেই, শৈশবে লেখা ‘মাষ্টার, ডাষ্টার, পোষ্টার ও প্লাষ্টার ইত্যাদি শব্দের পরিবর্তে মাস্টার, ডাস্টার, পোস্টার ও প্লাস্টার লেখা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ধ্বনিতত্ত্ব নিংসন্দেহে বাংলা ভাষায় রচিত অসাধারণ অবদান। তাই প্রমিত বাংলা বানানরীতির সাথে ধ্বনিতত্ত্বের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের সমন্বয় থাকা আবশ্যক। সমন্বয়হীনতার কারণে ‘ঈদ’ না ‘ইদ’ এই তর্কের অবসান আইন করে চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। বাংলা বানানরীতিতে ধ্বনির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ঢালাওভাবে তৎসম, অতৎসম, সমাসবদ্ধ, দেশী ও বিদেশী শব্দ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে চাপিয়ে দেয়া বানানের কারণেই ‘ঈদ’ এবং ‘ইদ’ শব্দের বিরোধ কাটছে না।

১৯ ফেব্রুয়ারি, ‘মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ১৬৯৬/২০১৪ নং রিট পিটিশনে প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী সকল প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। আসুন, আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মানের আসনে ধরে রাখি।’ মর্মে সর্বসাধারণের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছেন। উচ্চ আদালতের সম্মানিত বিচারকদের অনেকে বাংলায় রায় আদেশও লিখেছেন। তার পরও আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহার কমে যাওয়ার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেসবের মধ্যে,

প্রথমত, বাংলা ভাষা ব্যবহার করার সময় আঞ্চলিক, সাধু ও চলিত শব্দের মিশ্রণ থাকে, যা ইংরেজি ভাষায় নেই। দ্বিতীয়ত, আইনের জন্ম ইংরেজি ভাষায়। আইনের শব্দগুলোর জন্মও ইংরেজিতে। ইংরেজি শব্দের যুৎসই পরিভাষা বাংলা শব্দে না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই ইংরেজি বলতে হয়। তৃতীয় কারণটি মনস্তাত্ত্বিক, একসময় ভারতবর্ষের বর্ণদ্বিজরাই বর্ণবৈষম্য ঠিক রাখতে ভাষাবৈষম্যের প্রচলন করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষাভাষী কোনো জাতিগোষ্ঠী ভারতবর্ষে না থাকলেও কোনো কোনো ধর্মজীবীর ধর্মচর্চার ভাষা হলো, সংস্কৃতি। সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের মতো অনেক ধর্মে বিশেষ করে ধর্মকে যারা জীবিকা হিসেবে নিয়েছেন, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কঠিন ভাষার আবরণে সাধারণ মানুষ থেকে নিজেদের দুর্বোধ্য এবং ধর্মকে দুর্গম করে রাখেন। একই মানসিকতা কাজ করে আদালতপাড়ায়ও। কোনো কোনো আইনজীবী মক্কেলের কাছে নিজকে ‘দুর্গম’ এবং আইনের ভাষাকে ‘দুর্বোধ্য’ করার প্রয়াস থেকেও ইংরেজির ব্যবহার বেশি করে থাকেন। বর্ণদ্বিজদের মতো তাদের কেউ কেউ বোঝাতে চান- ‘উকিল ও মক্কেল দু’টি ভিন্ন জাত। যেখানে মক্কেল বাংলায় কথা বলেন, সেখানে উকিল বাংলায় কথা বলতে যাবেন কেন?

সর্বশেষ ভ্রান্ত ধারণা : আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছেন। হজরত মূসা আ:-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি। তাই সে ভাষায় তাওরাত কিতাব নাজিল করা হয়েছে। হজরত দাউদ আ:-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই যাবুর সে ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। হজরত ঈসা আ:-এর উম্মতের ভাষা ছিল সুরিয়ানি। তাই এ ভাষায় ইঞ্জিল কিতাব নাজিল করা হয়েছে। বিশ্বনবী সা:-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। তাই কুরআন তার মাতৃভাষা আরবিতে নাজিল করা হয়েছে।

তার পরেও অনেক বাঙালি মুসলমানের ধারণা, আরবি মুসলমানের ভাষা আর বাংলা হিন্দুদের ভাষা। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হওয়ার কারণেই ১৯৪৭ সালের আগের মুসলমানদের দলিলপত্রের ভাষার সাথে পরের দলিলপত্রে ভাষায় রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। হয়তো এই ধারণা থেকে বাংলা ভাষায়ও বিভাজন শুরু হয়। ‘জল’ ও ‘পানি’র মতো একই কারণে দাদা, দিদি, মাসি, মেসো, পিসা, খুড়া, খুড়ি, বৌঠান- অভিন্ন অর্থের এই শব্দগুলো যথাক্রমে- ভাই, আপা, খালা, খালু, ফুপা, কাকা, কাকি, ভাবী সম্বোধনে বিভাজন হয়ে গেছে।

পরিশেষে : মাওলানা মমতাজ উদ্দীন আহমদ র. রচিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘মাদরাসা-ই আলিয়ার ইতিহাস’ গ্রন্থের ১৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ‘কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই যে, বিগত প্রায় দুইশ’ বৎসর যাবত বাংলার বুকে স্থাপিত মাদরাসা-ই আলিয়া হইতে শত সহস্র আলিম অতি যোগ্যতার সহিত ইসলামী শিক্ষা অর্জন করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু মাতৃভাষা বাংলায় দক্ষতার অভাবে তাঁহারা সমাজের জন্য লিখিত কিছুই রাখিয়া যাইতে পারেন নাই। ফলে নিজেরাও ডুবিয়াছেন, সমাজকেও ডুবাইয়াছেন। এ কারণেই বাংলা ভাষাবিদগণ ইসলামী বিষয় হইতে অপরিচিত হইয়া পড়েন। ইহার পরিণাম এই দাঁড়ায় যে, বর্তমানে সাহিত্যিকগণ ইসলামী বিষয়কে বাংলা সাহিত্যের বহির্ভূত বিষয় বলিয়া মনে করিয়া থাকেন।’

বিশিষ্ট ভাষা গবেষক, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ভাষাতত্ত্বের প্রিন্সিপাল প্রবীর দত্ত গুপ্তের বক্তব্য, ‘এসব নিয়েই বাংলাদেশের লেখক ও পাঠকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, স্কুলজীবনে পড়ানো হয়নি বলে। টিচাররা বলছেন, তারা নিজেরা এসব জানেন না। বই মার্কেটে বিস্তর আছে, এগুলো কোথায় আছে, আপনি দেখান? বাংলা একাডেমি রিসার্চ করে অভিধান বের করেছে। ওখানে তো মিলে না।

সমস্যাতো ওখানেই, সাধারণত ফরাসি একাডেমি থেকে এমন কিছু বের হবে না যা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নয়, ওরা এমন কিছু বের হতেই দেবে না। তারপর আপনি ইংরেজিতে ভুল কিছু টাইপ করুন, আপনার কম্পিউটারই ভুল ধরে দেবে। আর আপনি বাংলা কী লিখছেন; সেটি কম্পিউটার বলছে না, কিতাবেও মিলছে না, সুধীজনও ধরছে না সেটি ভুল না শুদ্ধ।’

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement