২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশভাগ ও এনআরসি

যারা দেশ ভাগ করেছিল তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী মানুষ, মুসলিমরা নয়। - ছবি : সংগৃহীত

কেউ কেউ বলেন, ভারত ভাগের জন্য নাকি মুসলমানরা দায়ী। কারা কতখানি দায়ী আমরা যদি পর্যালোচনা করি, আমাদের যে ইতিহাস, যে রেকর্ড, সেটা যদি মিথ্যা না বলে তা হলে প্রাক-স্বাধীনতা পর্বে আমাদের কোন অঞ্চলে কোন ধর্মের লোকসংখ্যা কেমন ছিল একটু পয়েন্ট বাই পয়েন্ট তুলে ধরি।

বাংলায় তফসিলিসহ হিন্দু জনসংখ্যার হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ এবং মুসলমান ছিল ৫৪ শতাংশ। পাঞ্জাবে হিন্দু ছিল ২৬.৫ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৫৭ শতাংশ। সিন্ধুতে হিন্দু ছিল ২৭.১ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৭০.৭ শতাংশ। বেলুচিস্তানে ফিউডাল কাস্ট ও হিন্দু ৮ শতাংশ এবং মুসলিম ৮৭.৫ শতাংশ। আর বাংলা প্রদেশের কথা যদি আমরা আলাদা করে বলি, সেসময় আমাদের ডিভিশন ছিল বর্ধমান, প্রেসিডেন্সি, রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ডিভিশন। বর্ধমানে হিন্দু ছিল ৭৮.৯৮ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ১৩.১৯ শতাংশ, প্রেসিডেন্সি ডিভিশনে হিন্দু ছিল ৫৩.৭০ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৪৪.৫৬ শতাংশ, রাজশাহীতে হিন্দু ছিল ৩০.৫১ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৬২.৫২ শতাংশ, ঢাকা ডিভিশনে হিন্দু ছিল ২৭.৭০ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৭১.৫৯ শতাংশ আর চট্টগ্রামে হিন্দু ছিল ২০.৭০ শতাংশ এবং মুসলিম ছিল ৭৫.৪০ শতাংশ। এভাবে বিভক্ত থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা কিন্তু কখনো আন্দোলন করেনি যে, আমরা স্বতন্ত্র হয়ে যাবো। যে কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলন করেছিল সেই কংগ্রেসই প্রথমে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতার সিংহী পার্কের অধিবেশনে প্রথম সিদ্ধান্ত নিলেন যে, দেশটা ভাগ করা দরকার। কেন দরকার সে পুরনো ইতিহাস আপনারা আগে শুনেছেন। তারা বললেন, ভাগ করা দরকার। যখন এ সিদ্ধান্ত হলো দেশ ভাগ করতে হবে তখন মুসলিম লীগ মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে গিয়ে বলল, দেখুন, দেশ যদি ভাগ করতে হয় তা হলে কিন্তু মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র দেশ দিতে হবে। মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে মুসলিম লীগ যখন এই কথা বলল তার পরপরই বাংলার শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বাংলার রাজ্যপাল ফেডারিক বরজের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ওরা যদি মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র দেশ দাবি করে আমরা বাংলা ভাগ করতে চাই। দেশ যদি ভাগ হবে, বাংলাও ভাগ হবে। মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে দু’টি প্রস্তাব। একটা হলো দেশ ভাগ হবে অন্যটি হলো শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বলছে, ‘বাংলা ভাগ চাই’। মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, মহামুশকিল এখন আমি কোন সিদ্ধান্ত নেবো?

মাউন্ট ব্যাটেন একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ১৯৪৭ সালের ২ জুন নিজের বাড়িতে মিটিং ডাকলেন। ভারতবর্ষের সব রাজনৈতিক নেতাদের ভেতর যারা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তাদের ডাকলেন মাউন্ট ব্যাটেন। ডেকে বললেন দেখুন, ভারতবর্ষ ভাগের প্রস্তাব এসেছে। আপনাদের মতামত কী? তিনি যাদের ডেকেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু, সরদার বল্লব ভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী। মুসলিম লিগের পক্ষ থেকে মিস্টার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিস্টার লিয়াকত আলী খান, মিস্টার আবদুর রব নিস্তা। আর শিখ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সরদার বলদেব সিং। এই সাতজন ব্যক্তিকে দেশভাগের সিদ্ধান্তের জন্য মাউন্ট ব্যাটেন ডাকলেন। বাবা সাহেব আম্বেদকরকে ডাকেননি। অবহেলিত মানুষের এত বড় একজন জনপ্রতিনিধিকে দেশ ভাগের সময়ে ডাকা হলো না। মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাকেও দেশে ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ডাকা হলো না। এই সাতজন ব্যক্তিকে ডেকে দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

এই সাতজন একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কথা মাউন্ট ব্যাটেনকে বললেন। দেখুন, আমরা সাতজন তো বলতে পারি না, তবে বাংলা ভাগের ক্ষেত্রে আমরা একটা প্রস্তাবনা আপনাকে দিতে পারি। তখন মাউন্ট বললেন, কী আপনাদের প্রস্তাবনা? বলা হলো, বাংলা অ্যাসেম্বলিতে যত সদস্য আছেন এমএলএ বা এমএলসি, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা এবং মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার সেসব সদস্যকে নিয়ে আলাদা মিটিং করা হোক। পরে এই দুই মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে। যদি যেকোনো একটি মিটিংও দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত দেয় তা হলে দেশ ভাগ হবে।

সেই মিটিংটা কিভাবে হলো : তখন ১৯৪৭ সালে বাংলা অ্যাসেম্বলিতে ২২৫ জন সদস্য ছিলেন। এরপর ভাগ করা হলো কোন কোন জেলায় হিন্দু বেশি আর কোন কোন জেলায় মুসলিম বেশি। যেসব জেলায় হিন্দু বেশি ছিল তার মধ্যে বর্ধমান, বীরভূম, বাকুরা, মেদিনীপুর, হুগলি, হাওরা, কলকাতা, চব্বিশ পরগনা, খুলনা, জলপাইগুঁড়ি ও দার্জিলিং। এই ১১টি জেলার হিন্দু জনসংখ্যা বেশি এবং এই ১১টি জেলার অ্যাসেম্বলির মোট সদস্য সংখ্যা হলো ৮০ জন। এই ৮০ জনের ভেতর হিন্দু ৫৪ জন, মুসলমান ২১ জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চারজন ও ভারতীয় খ্রিষ্টান একজন। এই ৮০ এমএলএ এক জায়গায় বসলেন এবং বলা হয়েছিল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার এমএলএদের মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করবেন একজন হিন্দু। সেই মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছিলেন বর্ধমানের মহারাজ উদয় চাঁদ মহতাব।

সেই মিটিংয়ে বিশিষ্ট হিন্দু যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কয়েকজনের নাম আমরা পেয়েছি। হিন্দুদের পক্ষে ছিলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, মহারাজ উদয় চাঁদ মহতাব, মুকন্দ বিহারী মল্লিক, রতন লাল ব্রাহ্মণ ও জ্যোতি বসু। আর মুসলিমদের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মিস্টার এইচ এম সোহরাওয়ার্দী, এম এ ইস্পাহানী, আবদুল হোসেন, আব্দুর রহমান ও মোশাররফ হোসেন। ভোট হলো। কে কাকে ভোট দিয়েছে আমরা জানি না। আমাদের ইতিহাসে লেখা নেই। দেশ ভাগের পক্ষে কে ভোট দিয়েছে আর দেশ ভাগের বিপক্ষে কে ভোট দিয়েছে আমরা বলতে পারছি না।

ভোটের রেজাল্ট হলো, বাংলা ভাগের পক্ষে ৫৮ জন ভোট দিয়েছেন। বাংলা বিপক্ষে ২১ জন ভোট দিলেন। ভালো করে মনে রাখবেন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার ৮০ জন এমএলএর মধ্যে বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছে ৫৮ জন আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ২১ জন। একজন এমএলএ মনে হয় অনুপস্থিত বা নীরব ছিলেন।

এবার দেখুন মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলোতে কী সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমান অধ্যুষিত জেলা ১৬টি। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, বাকেরগঞ্জ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বগুড়া, দিনাজপুর, মালদহ, পাবনা, রাজশাহী ও রংপুর। এই মুসলিম অধ্যুষিত ১৬টি জেলার অ্যাসেম্বলির সদস্য সংখ্যা ১৪৫ জন। এর মধ্যে মুসলিম সদস্য ১০৩ জন, হিন্দু ৪১ ও ইন্ডিয়ান খ্রিষ্টান একজন। এখানে হিন্দুদের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে দারিকনাথ বরুরি, নগেন্দ্র নারায়ণ রায়, মহারাজা গিরীশ চন্দ্র নন্দী, সতীশ চক্রবর্তী, ভোলানাথ বিশ্বাস, হারান চন্দ্র বর্মণ, ভয়া নাথ বিশ্বাস, কিরণ শঙ্কর রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, নেলী সেনগুপ্তা ও প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর। আর মুসলমানদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ কে ফজলুল হক, মুহাম্মদ আলী, নূরুল আমিন, আহমদ হোসেন ও শামসুদ্দিন আহমদসহ অনেকে। ১৪৫ জনের মধ্যে বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তির নাম আমরা ইতিহাসে খুঁজে পেয়েছি। এই মিটিংয়ে দেশ ভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিলেন ৩৪ জন, বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দিলেন ১০৬ জন আর ভোট দেননি বা অনুপস্থিত ছিলেন চারজন। অর্থাৎ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার ১৪৫ জনের মধ্যে ১০৬ জন দেশ ভাগের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত দিলেন।

খেয়াল করুন, আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মুসলিম অধ্যুষিত অথবা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার যেকোনো একটি মিটিংও যদি দেশ ভাগের পক্ষে রায় দেয় তা হলে দেশ ভাগ হবে। উভয় মিটিংয়ের সিদ্ধান্তে দেখা গেল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা দেশ ভাগের বিপক্ষে রায় দিলো আর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা দেশ ভাগের পক্ষে রায় দিলো। এর পরও কি বলা যায় যে, মুসলিমরা দেশ ভাগ করেছে? এই ইতিহাস যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে তবে দেশ ভাগের দায় হিন্দুদেরই এ কথা কে কিভাবে অস্বীকার করবে?

গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একদিন দেশ ভাগ হয়েই গেল। আজ আমরা কাউকেই অপরাধী বলতে পারি না। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ও গান্ধীজিকে বলেছিলেন, আপনারা কী কাজ করলেন? গান্ধীজি প্রথমে বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া যদি ভাগ হয় তা হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে ভাগ হবে।’ কিন্তু ইন্ডিয়া যখন ভাগ হয় তখন গান্ধীজি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। গান্ধীজি একটুও অসুস্থ হননি। ইন্ডিয়া তার লাশের ওপর দিয়ে ভাগ হয়নি। যেসব বাস্তুচ্যুত মানুষ অর্থিক অনটনের মধ্যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছে এবং এখনো করছে, আমরা তাদের সবাইকে পুনর্বাসন দেয়ার জন্য উদ্বিগ্ন। সরদার বল্লভ বলেছিলেন, যাদের সাথে আমাদের রক্তে মাংসে সম্পর্ক, যারা একত্রে আমাদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। যদিও তারা একটি সীমারেখার ওপারে কিন্তু তারা আমাদের কাছে বিদেশী হয়ে যেতে পারে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা আফ্রিকার নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা এখনো তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। তাদের যদি আমাদের কাছে দাবি করার অধিকার থাকে তা হলে অপরাংশে যারা আটকে রয়েছে তারা সুনিশ্চিতভাবে আমাদের কাছে দাবি করবে। গান্ধীজি বেঁচে থাকতে বললেন, হিন্দু ও শিখ যারা ওখানে আছেন তারা যদি আর ওখানে থাকতে না চান তা হলে সম্ভাব্য যেকোনো উপায়ে এখানে চলে আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কাজ হবে তাদের জীবিকার জন্য কর্মসংস্থান। তারা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন ফিরে পায়।

এই তো ভারত ভাগের ইতিহাস। যারা দেশ ভাগ করেছিল তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী মানুষ, মুসলিমরা নয়। কেন ভাগ করেছিল? বাংলা যদি ভাগ না হতো তা হলে প্রধানমন্ত্রী হতো মুসলমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হতো শিডিউল কাস্ট। বাংলা যদি ভাগ না হতো তা হলে বাংলার গৌরব বহন করত মুসলমান আর খ্রিষ্টানে। আপনারা জানেন, দেশ ভাগের আগে যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তারা তিনজনই মুসলমান। এই বর্ণবাদী মানুষরা তাতে চমকে গেল। কিরে বাবা! লক্ষ্মণ সেনের বাংলায় আমরা চিরকাল ধরে মুসলমানের অধীনে থাকব? এ মোটেও সম্ভব না। কার মাথায় এই বুদ্ধি এলো? শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বললেন, বাংলা ভাগ করতে হবে। কেন ভাগ করতে হবে? আমাকে রাজা হতে হবে। তিনি রাজা হওয়ার জন্য বাংলা ভাগ করলেন। আজ তাদের রাজা হওয়ার জন্য, তাদের অবসর বিনোদনের জন্য, তাদের আনন্দের জন্য দেশটা ভাগ করল। আজ মানুষ পথেঘাটে প্রান্তরে ভিখারির মতো জীবনযাপন করছে। আজ আমাদের কর্তব্য আছে না? আজ আমাদের কর্তব্য আছে। দেশের ৮৫ শতাংশের মালিক আমরা। আমরা কি আজ দেশভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারি? তারা আমাদের নাগরিকত্ব দেয়নি, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারি? তারা আমাদের পুনর্বাসন দেয়নি তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারি? আন্দোলন করতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশভাগ হয়ে যেতে পারে কিন্তু আমরা কি নীরবে বসে থাকতে পারি? না পারি না। এটি আমাদের কর্তব্য নয়। আমাদের একমাত্র পথ সংগ্রাম।

বাবা সাহেব আম্বেদকর দেশভাগ হয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘এই স্বরাজ তাদের স্বরাজ। আমরা যে দাস ছিলাম আমরা এখনো দাস আছি। যদি তোমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাও তবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। বাবা সাহেবের সেই বাণী যদি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারি তা হলে আজ উদ্বাস্তুদের নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে, যে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে আজ মহাসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা কিভাবে চলতে পারে? দেশ ভাগ করলে তোমরা আর উদ্বাস্তু হয়ে ভারতবর্ষের প্রান্তর থেকে প্রান্তরে ভিখারির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা। তার পরও তোমরা বলছ, ‘ইন্ডিয়ায় বসবাসের তোমাদের কোনো অধিকার নেই। কারণ তোমাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই।

এটা কী হচ্ছে? কে দেশভাগ করেছিল? কার উদ্যোগে দেশভাগ করেছিল? কে আজ নাগরিকত্ব সনদ দেখতে চায়? কী অধিকার আছে তোমার নাগরিকত্ব সনদ দেখতে চাওয়ার?

আমরা কি এসব প্রশ্নের উত্তর দাবি করতে পারি না? অবশ্যই পারি। তার জন্য দরকার সংগ্রাম, জীবন পণ সংগ্রাম। ভারতবর্ষের এই পার্লামেন্টের ভেতরে চার ভাগের এক ভাগ সদস্য আমার। ওই আইনসভার ভেতরে এক-চতুর্থাংশ মানুষ আমার। তারা কথা বলে না। কোন রাজনৈতিক দল থেকে আমরা তাদের পাঠিয়েছি? কেন তারা কথা বলে না? এই রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেল নাগরিকত্ব বিল। একজন এমএলএ এমপি পদত্যাগ করেনি। কী জন্য তাদের আমরা পাঠিয়েছি? আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নিজেদের পছন্দ করতে হবে। যে মানুষটি পার্লামেন্টে গিয়ে কথা বলতে পারে, যে মানুষটি অ্যাসেম্বলিতে গিয়ে কথা বলতে পারে, প্রতিরোধ করতে পারে, বিক্ষোভ করতে পারে, আন্দোলন করতে পারে, সংগ্রাম করে অধিকার আদায় করতে পারে; সেই মানুষটিকে আমরা পার্লামেন্টে পাঠাব। অন্য কাউকে আমরা পাঠাতে চাই না। আমরা ভিক্ষাবৃত্তি করতে রাজি না। আপনারা সাবধান হন।

বাবা সাহেব কী বলেছেন, যদি এই জাতির রক্তে-মাংসে তেজ বীর্য থেকে থাকে তা হলে আসুন সবাই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হারিয়ে যাওয়া অধিকার আমরা যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করব। বাবা সাহেবের প্রচেষ্টার পথে এবং সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় আমরা হারিয়ে যাওয়া অধিকার ফিরিয়ে আনব। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। কারণ ভারতবর্ষে বৃহত্তমসংখ্যক নাগরিক আমরা। আমরা কেন ভিক্ষুক হয়ে থাকব? ১৫ জন মানুষ কেন আমাদের ৮৫ জন মানুষকে শাসন ও শোষণ করবে? অতএব আসুন আমরা সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন শুরু করি। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বাস্তু সমস্যা, তফসিলি সমস্যা, মূল নিবাসী সমস্যা, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষক।


আরো সংবাদ



premium cement