২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আইনজীবী মো: কবির চৌধুরী

মো: কবির চৌধুরী
মো: কবির চৌধুরী - ছবি : সংগৃহীত

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ দুর্যোগ চলাকালে মাত্র দু’মাসের ব্যবধানে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চট্টগ্রামের জেলা বারের ১৫ জন বিশিষ্ট আইনযোদ্ধা। এর মধ্যে কেউ মারা গেছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে, কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে, আবার কেউ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে। যাদের হারিয়েছি তাদের মধ্যে জেলা আইনজীবী সমিতির সর্বজন শ্রদ্ধেয় গুণীজন, দেশবরেণ্য আইনজীবী, আইনাঙ্গনের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব, বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আলহাজ মো: কবির চৌধুরী অন্যতম। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি আমাদের চট্টগ্রাম বারের বয়োজ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা বারে আইন পেশায় যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। পরে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ২ জুন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

তিনি চার ছেলে ও তিন মেয়ে, নাতি-নাতনী আত্মীয়-স্বজন ও বহু গুণগ্রাহী রেখে যান। তার শরীরে ব্যথা শুরু হয় গত ঈদের রাত থেকে। পরদিন থেকে জ্বর, হালকা কাশি। বিকেলের দিকে তার হঠাৎ খারাপ লাগা শুরু হয়। মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। ব্লাড প্রেশারও বেশি। আগের দিন থেকেই মানসিকভাবে তিনি খুব আপসেট ছিলেন। কারণ তার ঘনিষ্ঠজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট আবদুস সালামের মৃত্যুর সংবাদে। প্রতি ঈদের সকালে তিনি আসেন, এবার না আসায় খবর নিয়ে শুনলেন, তিনি রাতেই করোনায় মারা গেছেন। কবির চৌধুরীর সন্তান আবিদ থেকে জানতে পারলাম, তার বাবা আফসোস করছিলেন, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালামের জানাজার সালাতে দাঁড়াতে পারলেন না, জানাজায় লোক হয়েছে কি না।

ক’দিন থেকে বলছিলেন, করোনার যে পরিস্থিতি, বাঁচবেন কি না। ছেলেকে বলেছিলেনÑ তিনি অন্তত ডিসেম্বর পর্যন্ত বাঁচতে চান। জীবনের সব আকাক্সক্ষা ও কর্তব্য তিনি সম্পাদন করেছেন, শুধু একটা ইচ্ছে পূরণ বাকি, তা শেষ করে যেতে চান। ক্যান্সার ও হার্টের রোগীদের চিকিৎসার খরচ নির্বাহের জন্য জন্মস্থান আনোয়ারায় নিজ গ্রামে একটা দাতব্য ফাউন্ডেশন করতে চান। তার ছেলে জানান, সেদিন শারীরিক অবস্থা দেখে স্বভাবতই বুকটা তার থ মেরে গেল। উপসর্গগুলো ভালো ঠেকছিল না। শুরু হলো হাসপাতালে যোগাযোগ। ভর্তির জন্য চট্টগ্রামের প্রায় সব বেসরকারি ক্লিনিকের সাথে যোগাযোগ করা হয়। জ্বর আছে, ফলে করোনা সাসপেক্টেড। ইতোমধ্যে বিনা চিকিৎসায় করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রিয় ভাই অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবুল কাসেম চৌধুরীও মারা গেলেন। করোনা পরীক্ষা ছাড়া কেউ রোগী ভর্তি করে না। ঠিক করা হয়, পরদিন জেনারেল হাসপাতালে করোনা টেস্ট করা হবে। নানা চেষ্টা-তদবিরের পর তার বয়স বিবেচনায় আলাদা রুমে স্পেশাল টেস্টের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল। একজন আইনজীবীর কাছ থেকে খবর পেয়েছেন, অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম চৌধুরী শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুরেছেন ক্লিনিকের দ্বারে দ্বারে। শেষ পর্যন্ত সিট পেয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যালের একটি ওয়ার্ডের ফ্লোরে। শ্বাসকষ্টেই সেখানে সেদিন তিনি মারা যান। ছেলে জানান, সেদিন রাতে বাবা ঘুমোতে পারেননি। তিনি বলছিলেন, ঘুম আসে না, বারবার স্বপ্ন দেখছেন তিনি- রোগীরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছে, সিট পাচ্ছে না। কোথাও ভর্তি নিচ্ছে না। আর ভাবছিলেন, নিজে আইন পেশায় চসিকের একুশে পদক পাওয়া আইনজীবী, চট্টগ্রাম বারের সাবেক সভাপতি, বার কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন, তার অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী- তার জন্য অনেকে চেষ্টা করছেন, তার ক্ষেত্রে এ অবস্থা হলে সাধারণ রোগীদের কী পরিস্থিতি?

২৯ মে টেস্টের জন্য তাকে নিয়ে তার ছেলে শফি উদ্দিন কবির আবিদ জেনারেল হাসপাতালে যান। সেদিন তার জ্বর বাড়ল। অক্সিজেন স্যাচুরেশন অনেক কমে গেল। দ্রুত অক্সিজেন দিতে হবে। সকালে তার শ্বাসকষ্ট বাড়ে। কিন্তু কোথাও সিট নেই, আইসিইউ নেই। ভেঙে পড়েননি তার ছেলে, মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। ৩০ মে সকালে তাকে নিয়ে আসা হলো অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করা হয়। ২ জুন জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রবীণ আইনজীবী কবির চৌধুরী মেধায়, প্রজ্ঞায়, মননে, পেশাগত সদাচরণে, উন্নত রুচি সংস্কৃতিতে, নৈতিকতায়, নিষ্ঠায়, পরিমিতিবোধে এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অতি সহজ-সরল সজ্জন, নিরহঙ্কার মানুষটি আত্ম-প্রচারবিমুখ, স্বল্পভাষী হওয়ার কারণে দূর থেকে দেখে তাকে সহজে বোঝা-জানা কঠিন ছিল। কোনো জটিল বিষয়ে সহজ সমাধান দেয়া বিশেষত আরবিট্রেশনে নির্মোহভাবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি দীর্ঘকাল অনন্য নজির হয়ে থাকবেন। সঙ্কটে, দুর্দিনে আইনজীবী পরিবারের এ সভ্য আমাদের বিশ্বাসের-নির্ভরতার অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিলেন। তার শূন্যস্থান পূরণ সহজে হওয়ার নয়। তিনি দীর্ঘ সময় মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী, নির্লোভ-নির্মোহ একজন সচ্চরিত্রবান পেশাজীবী। মানবসেবায় তার অবদান অনস্বীকার্য।

তিনি আনোয়ারার বটতলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যময় মুসলিম পরিবারে ১৯৩৬ সালের ১ মার্চে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর তার স্ত্রী নুরুন নাহার বেগম পরপারে চলে যান। এর পর থেকে তিনি মানসিকভাবে খুব বেদনাহত হয়ে পড়েন। তার শ্বশুর ছিলেন মরহুম আলহাজ নজির উদ্দীন আহমদ। তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির চিফ অ্যাকাউনটেন্ট এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলনে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শওকত আলীদের সাথী ছিলেন। ১৯০২ সালে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেছিলেন। তিনি তৎকালীন পটিয়া থানার বৃহত্তর জোয়ারা ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু শরণার্থীদের আর্থিক সাহায্য করেছেন।

স্বাধীনতার পর ইউনিয়ন বোর্ডের রিলিফ কমিটির আমৃত্যু চেয়ারম্যান ছিলেন। কবির স্যার আমার বাবা সিনিয়র অ্যাডভোকেট মরহুম আবু মোহাম্মদ য়্যাহয়্যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে দু’জনই গ্র্যাজুয়েশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। বারে যোগদানও প্রায় একই সময়ে। ৬ মে ২০০৭ সালে সকালে বাবা আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সরকারি মহসিন কলেজের মাঠে বাবার বিশাল দ্বিতীয় নামাজে জানাজায় তিনি বক্তব্য রাখেন। জানাজায় বাবার সততার ও ন্যায়-নিষ্ঠার বিষয়াদির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। আমার বাবা সম্পর্কে তার দেয়া ছোট মূল্যবান বক্তব্য আজো যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে কোভিড-১৯ করোনাকালীন সরকারি ছুটি শুরুর আগের দিন আদালত পাহাড়ে ফুটওভারব্রিজে তার সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে মায়াভরা কণ্ঠে নাম ধরে ডেকে বলেন, ‘জিয়া গতকাল তোমার সাক্ষাৎকারটি সময় টিভিতে দেখলাম। খুব ভালো বলেছ, দোয়া করছি।’ ওটাই আমার সাথে তার শেষ দেখা। বহু স্মৃতি তাকে নিয়ে। ১৯৯৫ সালে আমার বিয়ের দিন লেডিস ক্লাবে তিনি সবার সামনে এসে দীর্ঘ সময় বসেছিলেন এবং দোয়া করেন। ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কির নেতৃত্বে ৯০ দশকে চট্টগ্রামের মানবাধিকার আন্দোলনে তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছি। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি বিএনপির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং এরপর থেকে বিএনপির রাজনীতির সাথেই কখনো সক্রিয়ভাবে, কখনো আইনজীবী সংগঠনের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন।

গত দুই দশক তিনি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জনাব কবির দলীয় লেজুড়বৃত্তি বা তোষামোদির রাজনীতি করতেন না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দলের পরিচয় কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতায় যুক্ত হননি। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানের পাত্র ছিলেন। অর্থলোভী মামলাবাজ আইনজীবী ছিলেন না। পারিবারিক বা সম্পত্তিগত বিরোধে চেষ্টা করতেন মামলা এড়িয়ে উভয়পক্ষের যথাসম্ভব স্বার্থ রক্ষা করে সালিশ করে দিতে। দেওয়ানি আইনজীবী হিসেবে অনেক পরিবারের সম্পত্তি বণ্টনে মধ্যস্থতা করতেন, তাদের অনেককে সারা জীবন যোগাযোগ রাখতে ও সম্মান করতে দেখেছি। এ জন্য যেকোনো পারিবারিক, সামাজিক, বাণিজ্যিক জটিল বিরোধের সালিশে তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মান্য করা হতো। তিনি দেশের বহু গুরত্বপূর্ণ বিরোধ আদালতের বাইরে সালিশ ও সমঝোতার মাধ্যামে নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হন। মানুষের প্রয়োজনে তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। মেয়ের বিয়ে বা পরীক্ষার ফিসের জন্য অনেককে তিনি সাহায্য করেছেন, এসব প্রকাশ করা পছন্দ করতেন না।

তিনি ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবার সাথে মিশতেন ও কথা বলতেন, মানুষের সঙ্গ পছন্দ করতেন। তার ইন্তেকালে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ পাক মরহুমের মৃত্যুকে শাহাদতের মৃত্যু হিসেবে কবুল করুন, আমিন। মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। চট্টগ্রাম মহানগরে এবং আনোয়ারা নিজ গ্রামে তার স্মৃতি ধরে রাখতে তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। 

লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী


আরো সংবাদ



premium cement
ঈশ্বরদীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪২.৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার রেকর্ড ‘মুক্ত সাংবাদিকতা চরম সঙ্কটে’ ‘রাফা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইলি সেনারা’ ৪৬তম বিএসএস প্রিলি পরীক্ষা : শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ ৮১ শিক্ষার্থীর মরুর উষ্ণতায় ক্ষতির মুখে কৃষি ছেলেদের কারণে বিপাকে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির দুই বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্স, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে সফরে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ড সফরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক বললেন প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের

সকল