জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের চলতি অধিবেশনে মুসলিম বিশ্বের দু’জন নেতার বক্তব্যে সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বিশেষভাবে মুসলিম বিশ্বের চলমান সঙ্কট নিয়ে তারা বক্তব্য রেখেছেন। নিজেদের সঙ্কট ও সমস্যার চেয়েও মুসলিম উম্মাহর বর্তমান সঙ্কট ও তার সমাধানের ব্যাপারে তারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। মুসলিম বিশ্বের এই দুই নেতা হলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
বিশ্ব নেতারা যখন জাতিসঙ্ঘ ফোরামে বিশেষভাবে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখেন তখন তারা বিশেষত নিজ দেশের শ্রোতাদের দিকে খেয়াল রেখে বক্তব্য রাখেন। কিন্তু এ দুই নেতা বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশেই বক্তব্য রেখেছেন। রজব তাইয়েব এরদোগান পরিষদে এবারের অধিবেশনে মুসলিম বিশ্বের চলমান সঙ্কট এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় সমাধানের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন।
২৪ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি ইসরাইলি সম্প্রসারণবাদ, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) ভোট দান পদ্ধতির সংস্কার, সিরিয়া সঙ্কটের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ, মিসরে আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির স্বৈরশাসন ও মিয়ানমার, গাজা, কাশ্মির এবং আফগানিস্তানে মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এরদোগান সিরিয়ার সঙ্কট নিয়ে অধিক সময় ধরে বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, তুরস্ক ইসলামিক স্টেট বা দায়েশের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা চালিয়েছে। তুরস্ক সিরিয়ায় অপারেশন ইউফ্রেইটস শিল্ড চালানোর পর দায়েশ সম্পূর্ণভাবে পরাজয় বরণ করে। এরদোগান বলেন, দায়েশ সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত ও তাদের মূলোৎপাটনে তুরস্ক বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিপুলসংখ্যক দায়েশ সন্ত্রাসী যারা সিরিয়ায় প্রবেশের জন্য তুরস্ককে ব্যবহার করেছিলÑ এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক পরিণতি ডেকে এনেছে। তিনি বলেন, তুরস্ক এ পর্যন্ত সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য ৪০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। দেশটির শরণার্থীদের জন্য অন্য কোনো দেশ এত বেশি পরিমাণ অর্র্থ ব্যয় করেনি।
এরদোগান সিরীয় শিশু শরণার্থী এলানকুর্দির ছবিসংবলিত একটি ব্যানার প্রদর্শন করেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে একটি নৌকায় করে শরণার্থীরা গ্রিসে যাওয়ার সময় নৌকাটি ডুবে যাওয়ার পর ওই শিশুটির লাশ ভেসে তুরস্কের নদী তীরে গিয়ে পৌঁছে। এরদোগান বলেন, ‘তার দেশ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় জারাব্লুস শহরে তিন লাখ ৬৫ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে তাদের বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছে। জারাব্লুস শহরটি তুরস্কের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তুর্কি কর্মকর্তারা সেটার দেখাশোনা করছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বলেন, তুরস্কের ইচ্ছা অনুযায়ী তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়ায় একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গঠন করা হলে এবং সেটা দিয়ার এজর এবং রাক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত করা গেলে এরদোগান জানান, সেখানে আরো ৩০ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে পুনরায় পুনর্বাসিত করা যেতে পারে।
তুরস্কের জন্য সিরীয় সঙ্কটের এটা হবে একটি আদর্শ সমাধান। কিন্তু এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ওই ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে তুরস্কের প্রবেশের বিরোধিতা করবে। ওয়াশংটন চায় ওই এলাকা সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। মনে রাখা প্রয়োজন তাদের মেরুদণ্ড হলো কুর্দিস পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটস (ওয়াইপিজি)। দ্বিতীয়, এসব এলাকা বিশেষত ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকে তুর্কি-সিরীয় সীমান্ত বরাবর অবস্থিত এবং এখানে প্রধানত কুর্দিদের বসবাস। জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগের আগে এরদোগান বলেছিলেন, ‘আমাদেরকে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলকে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো থেকে মুক্ত করে ওই অঞ্চলের আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর ওই এলাকার প্রকৃত মালিক হচ্ছে আরবরা। প্রধানত, কুর্দি বসবাসকারী ওই এলাকায় এই আইন বলবৎ করা হলে কুর্দিরা সম্ভবত তাদের এলাকায় ননকুর্দিদের বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করবে। তৃতীয়ত, ৩০ লাখ শরণার্থীর জন্য গৃহায়নের ব্যবস্থা করতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। এত বিশাল পরিমাণ অর্থ সংস্থান করাও খুব সহজ হবে না।
ইসরাইল সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এরদোগান ১৯৪৮ ও ১৯৬৭ সালে কিভাবে ফিলিস্তিন এবং সিরিয়ার ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল তাদের দেশের সীমানা বৃদ্ধি করেছে তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এখন নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের বিরাট অংশ দখল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মিসর নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এরদোগান আদালত কক্ষে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যু এবং তার যথাযথ জানাজা অনুষ্ঠানে বাধা প্রদানের নিন্দা করেন।
এরদোগান নিরাপত্তা পরিষদের ভোটদান পদ্ধতির বারবার বিরোধিতা করে বলেন, পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের চেয়ে ‘বিশ্ব অনেক বড়’। পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হয় সবার জন্য এটা নিষিদ্ধ করতে হবে অথবা সবার জন্য এর অনুমতি দিতে হবে।’ ২৭ অক্টোবর শুক্রবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে ইমরান খান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নিয়ে নজিরবিহীন অবরোধ কার্যকর করে নির্মম দমনাভিযান চালিয়ে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে কাশ্মিরে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া কাশ্মির নিয়ে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যেকোনো সময় যুদ্ধ বা সঙ্ঘাতের নেতিবাচক পরিণতি যে, বিশ্বকেও ভোগ করতে হবে- তাও ইমরান স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ইমরান বলেন, অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে কাশ্মিরে রক্তগঙ্গা বইবে। তিনি কাশ্মিরে মোদির পদক্ষেপকে নির্মম ও বোকামি বলে উল্লেখ করেন।
ইমরান বলেন, কাশ্মির ঘিরে নেয়া মোদির পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এ যুদ্ধ কেবল ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তিনি বলেন, পরমাণু শক্তিসম্পন্ন কোনো দেশ সব কিছু নিয়ে লড়াইয়ে নামলে পুরো বিশ্বকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে। ইমরান খান বলেন, জাতিসঙ্ঘের মনে রাখা উচিত- ১৯৩৯ সালে ইউরোপ হিটলারের অপরাধকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরএসএস নামে যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আজীবন সদস্য তাদের আদর্শ ‘হিটলার ও মুসোলিনি’ এবং ওই আরএসএসই মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে ছিল। ইমরান খান সাহসী ও বলিষ্ঠভাবে কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় উল্লেখ করে জাতিসঙ্ঘ ও বিশ্ব নেতাদের কাশ্মির সঙ্কট নিরসনের আহ্বান জানান।
ইমরান খান নিউ ইয়র্কে অবস্থানকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে আলোচনায় আফগান সঙ্কট সমাধান এবং ইরানের সাথে অচলাবস্থা দূর করার ব্যাপারে বক্তব্য রাখেন। তিনি ইরান-সৌদি সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারেও উভয় পক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইমরান খান কাশ্মির ইস্যু নিয়ে জাতিসঙ্ঘে এবার বলিষ্ঠভাবে যে বক্তব্য রেখেছেন অতীতে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী সে ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কাশ্মির নিয়ে জাতিসঙ্ঘে প্রস্তাব পাস হলেও তা কার্যকর না হওয়ায় ভারত কাশ্মিরে দমনাভিযান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অব্যাহত রেখেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা