১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


দহনকালের ভাবনা

অরিত্রী, মকবুল স্যার এবং আমাদের বাস্তবতা

-

কী ঘটছে ভিকারুননিসায়? অভিভাবকদের মত সারাদেশবাসীও উৎকণ্ঠিত চলমান ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। অনেকের মনেই প্রশ্ন কেন একটি সরল ঘটনা এমন জটিলরূপ ধারণ করল? সাদা চোখে ঘটনাটি সরলই। একটি মেয়ে সেলফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছে, শিক্ষদের হাতে ধরা পড়েছে। শিক্ষকরা নিয়ম অনুযাই তার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়েছেন, মেয়ের কৃতকর্মের কথা জানিয়েছেন । ছাত্রীটির পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং টিসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।

সাদা চোখে ঘটনাটি সরলই, স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টির নিয়মনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। কিন্ত ঘটনাটি এত সহজ ভাবলে চলবে না। একবার ভাবুন অরিত্রীর বাবা মা যদি কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি, আমলা কিংবা শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হতেন তবে এই সরল ঘটনা তাদের বেলায় ঘটত কিনা? ভাইস প্রিন্সিপ্যাল তাদেরকে রুম থেকে বের করে দেওয়ার মত অভদ্রতা করতেন কিনা? কিংবা প্রিন্সিপ্যাল তাদেরকে চেয়ারে বসতে না দিয়ে, বসার জন্য বেঞ্চ দেখিয়ে দেওয়ার মত আচরণ করতেন কিনা? অভিভাবকদের সাথে তাদের এই তাচ্ছিল্য, অবহেলা, অপমানজনক আচরণ একদিনের নয়। এই আচরণ তাদের প্রতিদিনকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে অভিভাবকদের ভিতরে ক্ষোভ জমতে জমতে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্হায় পৌঁছেছিল আগেই, অরিত্রীর স্বেচ্ছাপ্রায়ণের মধ্যদিয়ে তার বহিপ্রকাশ ঘটলো।

অরিত্রী প্রতিষ্ঠানিকভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধই করেছে। আরো একটি অনৈতিক কাজ করেছে অরিত্রী এবং তার বাবা মা। ১৫ বছরের মেয়ের হাতে সেলফোন দিয়ে । রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি অপরাধ হয়তো নয়। কিন্ত সামাজিকভাবে অরিত্রী অন্যায় করেছে, নিশ্চই এটা অন্যায়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অপরাধও বটে। যেহেতু এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য সেলফোন বহন নিষিদ্ধ ছিল । কিন্ত এই নিষিদ্ধ কাজটিই মেয়েটি করে ফেলেছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রায় সবধরনের পরীক্ষাতেই সেলফোন কিংবা অন্য যে কোন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস নিষিদ্ধ। আর তা বহনে নানান রকম শাস্তির বিধানও বিদ্যমান। সুতারং নৈতিকতার মানদণ্ডে এটি উতরে যাবে না। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতার প্রয়োজনে আমরা প্রায়শই কাজটি করতে বাধ্য হই।

তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, সে সেলফোনটিতে পুরো বই কপি করে নিয়েছিলো। আর তা দেখেই উত্তরপত্রে লিখছিলো। এটি কেবলমাত্রই অভিযোগ, প্রমাণিত নয়। ধরে নিলাম অরিত্রীর সেলফোনে বইটির কপি ছিল, কিন্ত তার অর্থ এই নয় যে সে নকল বা দেখে লেখার জন্যই সেলফোনে বইয়ের কপি রেখেছিল। যতটুকু জানা যায় মেয়েটি ছিল মেধাবি ছাত্রী, একজন মেধাবি ছাত্রীর পক্ষে কাজটি একটু বেমানাই এবং ‍পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যও নয়।

প্রযুক্তির সহজিকরণ ও সহজলভ্যতায় আজকাল আমরা অনেকেই প্রয়োজনীয় বই, দলিলপত্র, ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে রাষ্ট্রীয় সংবিধান প্রায় সবকিছু সংরক্ষণ করে থাকি। আর ঠিক এ প্রক্রিয়াটি আজকাল অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক অনুসরণ করে থাকেন। স্কুলে যা পড়নো হয়, তা তার সন্তান সঠিকভাবে অনুসরণ করেছে কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের লেখা সেলফোনে ছবি তুলে রাখে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে, আমাদের থেকে আমাদের সন্তানদের প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি। বহুদিন থেকে সিলেবাস, বইয়ের সংখ্যা এবং ওজন নিয়ে নানান রকম আপত্তি উঠেছে দেশব্যাপি। সম্ভবত আদালত থেকে এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্ত সেটি মানা হচ্ছে না।

অন্যদিকে আজকাল শহরের বড় স্কুলগুলোতে প্রায় প্রতেকটি শ্রেণির শাখায় ৮০ থেকে ৯০ জন শিক্ষর্থী থাকে। এই অত্যধিক শিক্ষার্থীর কারণে একদিকে যেমন শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সঠিকভাবে সম্ভব হয় না, তেমনি শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাটা না পেয়ে কোচিং এর দ্বারস্থ হয়। আর তাই স্কুল শেষে শুরু হয় এক কোচিং থেকে আর এক কোচিং এ আসা-যাওয়া। পথে অনেককেই বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে দেখা যায়। বই বহনের ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য অনেক অভিবাভক তাদের সেলফোনে বই কপি করে রাখে। এবার যুক্তির প্রয়োজনে মেনে নিলাম অরিত্রী নকল করার জন্য বইটি কপি করেছিল। তার মানে ঐদিনের তার পরিক্ষার বিষয়টির প্রস্তুতি ভাল ছিল না। তাহলে এই ব্যর্থতা কার? কেবলমাত্র শিক্ষার্থীরই নাকি শিক্ষক-শিক্ষিকারও ছিল? প্রতিষ্ঠান প্রধানই বা দায় এড়াবেন কিভাবে?

আমাদের স্কুল জীবনে দেখেছি, প্রায় প্রতিটি স্কুলেই কিছু নিবেদিত শিক্ষক ছিলেন যারা পরীক্ষার এক দুই মাস আগে থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে হঠাৎ সন্ধ্যা কিংবা রাতের বেলা গিয়ে উপস্থিত হতেন। এখানে তারা দুই ধারনের শিক্ষার্থীকে নির্বাচন করতেন। যারা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী এবং যারা অগ্রভাগের শিক্ষার্থী। শিক্ষদের এই বাড়িতে গিয়ে তদরকির ফলে একদিকে যেমন কারো প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকার সম্ভবনা কমে যেতো, অন্যদিকে ছাত্র-শিক্ষক, শিক্ষক–অভিবাভক সম্পর্ক প্রগাঢ় হতো। সময়, পরিস্থিতি এবং শহুরে পরিবেশের বাস্থবতায় এ ধারনের তদারকি এখন আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ত সম্ভব নয়। কিন্ত প্রযুক্তির সহয়তায় এই তদারকি আরো সহজভাবে পালন করা যায়। এখন শহরের প্রায় প্রতিটি স্কুলেই শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি, অভিভাবক মিটিং এবং বিশেষ কারণে স্কুলের কার্যক্রম বন্ধের বার্তা অভিভাবকদের কাছে এই প্রযুক্তির সহায়তায় পৌঁছে দেওয়া হয়। ঠিক এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই ছাত্র-ছাত্রীর অগ্রগতি, অনগ্রগতি এবং শিক্ষার্থীর সকলপ্রকার এক্টিভিটিজের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেকোন ধরনের ঘাটতি কমানো সম্ভব এবং শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব। প্রয়োজন কেবলমাত্র উদ্যোগের।

জাপানি শিশুদের স্কুল শিক্ষা নিয়ে জানা যায় সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কেবল নৈতিকতা শেখানো হয়। নৈতিকতা শেখানোর দায়িত্ব কেবল পরিবারের উপরে ছেড়ে দেয়া হয় না। স্কুল থেকেই তাদের নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের দেশ জাপান নয়, কিন্ত আমাদের শিক্ষার ঐতিহ্য নৈতিকতা বিবর্জিত নয়। কিন্ত বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এর উপস্থিতির পরিমান এবং মান আমাদের ভাবায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ও ব্যবস্থাপনায় যে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং নৈতিক স্খলন কেবলই কি শিক্ষার্থীদের মাঝে? নাকি যারা শিক্ষাদান এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন তাদেরও? কেন এই অবক্ষয় ও স্খলন? সময়ের স্রোতে অনেক কারণই এর পেছনে জমা হয়েছে তবে-
(১) একটি স্থিতিশীল শিক্ষানীতির অভাব
(২) শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিকিকরণ
(৩) শিক্ষক এবং পরিচালনা পর্ষদ এর অতিরাজনীতি সম্পৃক্ততা এবং
(৪) শিক্ষা অধিকার থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যবসায় পরিণত হওয়া অন্যতম কারণ বলে মনে করি।

বিগত ৭-৮ বছর ধরে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে লটারি প্রথা চালু হয়। দেখা যায় প্রতি শাখার জন্য ৪০-৫০ জনের ভর্তির সার্কুলার থাকে। লটারিও হয় সেই মোতাবেক। তবে ভর্তির পরে দেখা যায় প্রতি শাখায় শিক্ষার্থী ৮০-৯০ জন। এই অতিরিক্ত শিক্ষার্থী এলো কীভাবে? এই যে অনৈতিকভাবে ভর্তি করানো হলো, এর জন্য যেমন অভিভাবকগণ দায়ী, তেমনি দায়ী শিক্ষক এবং পরিচালনা পর্ষদ। তারা অনৈতিক পথে আয়ের উৎস হিসাবে লুফে নেন এই সুযোগটি। ফলে আলোর পথ থেকে এই তিনটি শ্রেণি সরে যেতে থাকলো। অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের জন্য যেমন সঠিকভাবে শিক্ষাদান কঠিন, তেমনি শিক্ষর্থীর জন্যও সঠিকভাবে অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে, আর তখন ঘাটতি পোষাণোর জন্য তারা কোচিংগামী হতে বাধ্য হয়। আর এই সুযোগটি লুফে নেন কতিপয় নীতি বিবর্জিত শিক্ষক। তার মানে শিক্ষরা তাদের নৈতিক দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হয়ে মনোযোগি হন নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।

ফিরে আসা যাক অরিত্রীর অপরাধ এবং শাস্তির বিষয়। মূলত অপরাধ দুটি, সেলফোন বহন এবং নকল করার অভিযোগ। এ দুটি অপরাধের শাস্তি কী এবং প্রক্রিয়াটি কী হওয়া উচিৎ? আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষার্থী মানেই ভুল করার সম্ভবনা থাকবে এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য, সংশোধনের জন্যই শিক্ষক। অরিত্রীর অন্যয়গুলো শিক্ষকরা চিহ্নিত করেছেন, কিন্ত সংশোধনের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। প্রথমবারেই তারা চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। এটিও একটি অনৈতিক ও অন্যয় পদক্ষেপ। যা অত্যন্ত কঠিন ও নির্মম এবং ক্ষমতা চর্চার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অরিত্রীর প্রায়ণের দুদিন পর একজন অগ্রজের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম তিনি লিখেছেন, বরিশাল জিলা স্কুলে পড়াকালীন সময় নকল করে লিখতে গিয়ে তিনি শিক্ষকের হাতে ধরা পড়েন। তাকে প্রধান শিক্ষক তার কক্ষে নিয়ে সেই ছাত্রের সামনে অঝরে কেঁদেছিলেন। কারণ ঘটনাটি প্রধান শিক্ষকের কাছে ছিল অবিশ্বাস্য, লজ্জাজনক এবং তার পক্ষ থেকে চরম ব্যর্থতার পরিচায়ক। প্রধান শিক্ষকের কান্না দেখে কেদেছিলেন সেই অগ্রজও এবং তার পরবর্তী শিক্ষাজীবনে তিনি আর কখনোই নকলের চিন্তা মাথায় আনেননি।

মধ্য চল্লিশ বয়সী মকবুল হোসেন স্যার। আমরা তাকে ডাকতাম মকবুল স্যার বলে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন প্রথমিক বিদ্যালয়ে। মকবুল স্যারের বাড়ি ছিল অন্য জেলায়। সরকারি চাকুরির সুবাদে বদলি হয়ে এসেছিলেন আমাদের স্কুলে। গৃহশিক্ষক হিসেবে থাকতেন স্কুলের পার্শ্ববর্তী এক বাড়িতে। কড়া শিক্ষক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তেমনি। হাতে থাকতো দুটো বেত, একত্রে জোড়া দেওয়া। কিন্ত সেটা ব্যবহার করতে সেভাবে দেখিনি তেমন। আমরা যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি মকবুল স্যার ক্লাসে এসে হঠাৎ হঠাৎই পুরানো কোন অধ্যায় থেকে (যে অধ্যায়গুলো আগে পড়ানো হয়েছে) প্রশ্নকরতেন। সঠিকভাবে উত্তর দিতে না পারলে ‘নীলডাউন’ করাতেন এবং কান ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। দিনে দিনে তার এই অভ্যসটা এমন হয়ে দাঁড়লো যে স্কুলের বারান্দা দিয়ে যাওয়ার সময় যদি দেখতেন ক্লাসে টিচার নেই বা ক্লাস বিরতি, স্যার হুট করে ঢুকে যেতেন। ক্লাসে ঢুকেই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করতেন। এইরকম একদিন আমরা প্রায় সবাই স্যারের কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। স্যার তখন প্রচণ্ড ক্ষোভে তার সেই ট্রেডমার্ক জোড় বেতের সদ্বব্যবহার শুরু করলেন। এইবার আমাদের মাথায় তাকে হেনস্থাকরার ভূত চাপলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম স্যার যখনই ক্লাসে ঢুকবেন আমরা সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাব, হলোও তাই। প্রথমদিন স্যার ঘটনাটি বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ বাইরে উঁকি দিয়ে বুঝতে চাইলেন কোথাও কোন দুর্ঘটনা হয়েছে কি না, তারপর আমাদের ক্লাসে ফিরতে ডাকাডাকি করলেন। কিন্ত আমরা ফিরে না আসায় তিনিও ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। পরের দিনও আমরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় স্যার আমাদের ক্লাসে বসার জন্যে আদেশ দিলেন, কিন্ত কাজ হলো না। তৃতীয় দিনও আমরা একইভাবে বের হলাম , কিন্ত স্যার আজ আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলেন। চতুর্থ দিন স্যার আর ক্লাসে এলেন না, তাকে আমরা স্কুলেও দেখিনি। তার পরের দিনও না তার পরের দিনও না। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তিনি ব্যক্তিগত কারণে ছুটি নিয়েছেন। আমরা লক্ষ্য করলাম আমাদের এই ক্লাস বর্জন নিয়ে কোন শিক্ষকই আমাদের কোন প্রশ্ন করেননি। এমনকি পাশের ভবনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আমার শিক্ষক বাবাও। তার মানে পুরো ঘটনাটাই মকবুল স্যার তার নিজের ভিতরে রেখেছিলেন। অন্য কোন শিক্ষকে জানতে দেননি। প্রায় দশ-বারো দিন স্যারের দেখা না পেয়ে আমাদের ভিতরে কেমন যেন শূন্যতা অনুভুত হতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে সেটা অপরাধবোধ এবং অনুশোচনায় রূপান্তরিত হলো। বার দিন পর দেখলাম স্যার স্কুলে এলেন। স্যারের ক্লাস ছিল টিফিন আওয়ারের পরে। কিন্ত সেদিন তিনি ঠিক টিফিন আওয়ারের আগে ক্লাসে চলে এলেন। আমরা নত মস্তকে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানালাম। স্যার শান্ত, স্থিরভাবে বলতে লাগলেন, আমার বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে। তোমাদের মত আমার একটি ছেলে আছে বাড়িতে, আমার থেকে অনেক দূরে । সে তোমাদের মত এ বছর মাধ্যমিক স্কুলে উঠবে। আমি তাকে পড়াতে পারছি না, যত্ন নিতে পারছি না। তাই তোমাদেরকে দিয়ে সেই না পারার কষ্টটা কমাতে চেয়েছিলাম। আর চেয়েছিলাম তোমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠবে, তখন আমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকর্মীরা যেন আমাদের বলতে পারেন, আপনাদের প্রত্যেকটি ছাত্রই এক একটি রত্ন। কিন্ত তোমরা তো আমার ছাত্র-ছাত্রী মাত্র পরিবারের কেউ নয়, তাই আমার শাষণটা তোমরা পছন্দ করোনি। শাস্তিটা মেনে নিতে পারোনি, ক্লাসবর্জন করে সেটা ফিরিয়ে দিলে। শিক্ষক ছাত্রকে শাস্তি দিয়েছে, বিনিময় ছাত্ররাও! যদি মানুষ হতে চাও এবং মানুষ হও আজকের দিনটা মনে রাখবে এবং মনে থাকবে। আমি বদলি হয়ে চলে যাচ্ছি আমার গ্রামের স্কুলে। আমাদের কিছু বলতে না দিয়ে স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন নিজস্ব ঢংয়ে। সেদিনের জোড় বেতের আঘাতগুলো ভুলেছিলাম দু’দিনেই। মানুষ হইনি হয়তো, কিন্ত চল্লিশ বছর আগে তার বিদায় দিনের এই শেষ শাস্তিটা মনে রেখেছিলাম সমস্ত শিক্ষাজীবন এবং বয়ে বেড়চ্ছি এখনো। এভাবেও শাস্তি দেয়া যায়।

অভিভাবক হিসাবে আমরা লজ্জিত এইজন্য যে, এইসকল ‘অভিজাত’ বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ানোর জন্য স্বপ্ন দেখি, হুমড়ি খেয়ে পড়ি, হাহাকার করি, ভর্তি করাতে না পারলে। আর এই অভিজাত স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা দিনে দিনে অভিজাত হয়ে ওঠেন আমাদের এই হাহাকার দেখে। আমরা লজ্জিত এই জন্য যে, কোন অনিয়মের প্রতিবাদ করতে চাইলে সন্তানদের কাছ থেকেই বাধা আসে। কারণ তারা জানে প্রতিবাদের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে!

আমরা লজ্জিত এই জন্য যে অভিভাবক হিসেবে তাদের সাথে দেখা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ তারা অভিজাত এবং তাদের ধারণায় অভিভাবকরা অস্পৃশ্য! সময় গড়ানোর সাথে সাথে তারা হয়ে ওঠেন অভিজাত থেকে অতিঅভিজাত। তারা তখন আর শুধুই শিক্ষক থাকেন না, তারা তখন অতিঅভিজাত শিক্ষক। সেখান থেকেই শুরু হয় সঙ্কটের। তাই আজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হয় তারই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। আন্দোলন করতে হয় বহিস্কারের জন্য, গ্রেপ্তারের জন্য। অভিভাবক হিসাবে আমরা তাই লজ্জিত। আমরা এই পরিস্থিতি কামনা করি না। আমরা চাই না শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মুখোমুখি অবস্থান, শিক্ষক-অভিভাবকের মুখোমুখি অবস্থান। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য এমন একটি পরিবেশ যেখানে বিদ্যালয়টি তাদের আর একটি বাড়ি হয়ে ওঠে, শিক্ষক শিক্ষিকারা তাদের মা-বাবা হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন অভিভাবক। তাদের কাছে সন্তান পাঠিয়ে আমরা নির্ভার থাকতে চাই।


আরো সংবাদ



premium cement
বান্দরবানে কেএনএফের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেন বম উজিরপুরে বিশ্বনবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল তামিমের ব্যাটে বাংলাদেশের উড়ন্ত শুরু নাটোরে এক প্রার্থীর সমর্থককে মারপিট করায় অপর প্রার্থী গ্রেফতার বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অবসরে নিউজিল্যান্ডের ওপেনার কক্সবাজারে ৩ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ সরকারের জনসমর্থন শূন্যের কোঠায় : গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দস্যুর দখলে লক্ষ্মীপুরের দ্বীপ চর মেঘা, বিপাকে দেড়শতাধিক কৃষক রেলপথ উন্নয়নে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করল চার দেশ একাদশে ৩ পরিবর্তন, টসে হেরে ব্যাট করছে বাংলাদেশ স্রোত বা বাতাস ছাড়াই দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় নদীভাঙন

সকল