আফগানিস্তানের শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রাসি নীতি অনেকখানি বিফলে যাওয়ার পর আবার আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে। সর্বশেষ গজনিতে তালেবানদের দুঃসাহসিক হামলার পর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, শক্তি প্রয়োগ করে তালেবানদের দমন করা যাবে না। এর মধ্যে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খান সরকার গঠন করেছেন। এই পাঠান নেতার বিশেষ প্রভাব রয়েছে পশতুন ভাষাভাষীদের ওপর। বিশ্বকাপজয়ী এই ক্রিকেটার রাজনীতিতে ২০ বছরের বেশি সময় পর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। সাবেক ক্রিকেটার এ রাজনীতিবিদ গত দু’দশক সময়ে রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আফগানিস্তানে চলমান যুদ্ধের ফলে দেশটির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অম্ল-মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। উত্থান পতনের এ সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা কতখানি এ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। আফগান সঙ্কটের মতো নিরাপত্তাঘনিষ্ঠ প্রশ্নে সামরিক বাহিনীর বিশেষ প্রভাব থাকে। তবে এ প্রভাবের মাত্রা যাই হোক না কেন রাজনৈতিক সরকারের এক ধরনের প্রভাব থাকতেই পারে। এ কারণেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তনে আফগান সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির ব্যাপারে কিছুটা ইতিবাচক আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে প্রচারাভিযান চালানোর সময় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু গত জানুয়ারিতে তার প্রশাসনের নীতি পাল্টে যায়। তিনি মূলত পেন্টাগনের সেনানীতি নির্ধারকদের পরামর্শ গ্রহণ করে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসীদের জন্য ‘নিরাপদ আশ্রয়স্থল’ দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেন এবং দেশটিকে দেয়া নিরাপত্তাসহায়তা ব্যাপকভাবে কমানোর ঘোষণা দেন। তিনি টুইটারে লিখেন : ‘গত ১৫ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য দিয়েছে আর তারা আমাদের সাথে মিথ্যা এবং প্রতারণা ছাড়া কিছুই করেনি। আমাদের নেতাদের তারা বোকা ভাবে। আফগানিস্তানে আমরা যে সন্ত্রাসীকে খুঁজছি, সেগুলোকে তারা নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে।’
ইমরান খান ট্রাম্পের এ নীতি ঘোষণার পর তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। আফগানিস্তানে ব্যর্থতার জন্য পাকিস্তানকে ‘বেদনাদায়কভাবে’ ব্যবহার করার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেন। ইমরান খান ট্রাম্পের নীতিকে ব্যক্তিগতভাবে ‘লজ্জাজনক’ বলেও অভিহিত করেন।
তবে জুলাইয়ের নির্বাচনের পর ইমরান খানের প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ খানিকটা হিসেবি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল সুরে তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমরা পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই। আমরা একটি সুষম সম্পর্ক চাই।’
ইমরান খান ট্রাম্পের নীতির একসময় সমালোচনা করলেও তার নতুন বক্তব্য দুই দেশের সম্পর্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আরএএনডি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ লরেল মিলার নিউ ইয়র্ক টাইমসকে অবশ্য বলেছেন, ‘তার (ইমরানের) নতুন দায়িত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর খুব কম প্রভাব ফেলবে ... আফগান পরিস্থিতি, পারমাণবিক সমস্যাবলি- এসব সামরিক বাহিনীর দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।’
তবে ওবামা প্রশাসনের সাবেক পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা বিক্রম সিং এ মত পোষণ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান- উভয় পক্ষকে এখনো একসাথে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক দেশই নিরাপত্তার জন্য অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা রোধ করে’। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানকে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা করার জন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প এবং ইমরান খান সুযোগ পেলে একসাথে কাজ করতে পারবেন।
আফগানিস্তানের এখন যে অবস্থা তাতে যুদ্ধ করে কোনো পক্ষ চূড়ান্ত জয় অর্জন করতে পারবে না। তবে তালেবানদের যে কৌশল এবং এ এলাকার ভূ-কৌশলগত যে পরিবর্তন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঘটেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রকে এখানে সামরিক অবস্থান বজায় রাখতে গেলে অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। এর মধ্যে দেশটি এখানে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশী দেনা পরিশোধে ব্যয় করলে এ দায়দেনা এক চতুর্থাংশ কমে যেত।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনী বিপর্যয়ে পড়ার আগে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল এখন তার কাছাকাছি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন বাহিনীর জন্য। আফগানিস্তানজুড়ে তালেবান দখলদারিত্বের নাটকীয় এবং দৃশ্যত অপ্রতিরোধ্য অগ্রাভিযানে মনে হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বল্প সময়ের মধ্যে এই অভিযানের সমাপ্তি ঘটাতে হবে। আর এই সমাপ্তি ঘটানোর ব্যাপারে তারা আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে গ্রহণ করা ভারতের ওপর যেভাবে নির্ভর করতে চেয়েছিল সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাদের পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতার কোনো বিকল্প থাকছে না।
এর মধ্যে আফগানিস্তানের চার প্রতিবেশী- রাশিয়া, চীন, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা সৃষ্টি হয়েছে। এই চার দেশ নানা মাত্রার আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। ফলে একসময় তারা অভিন্ন অবস্থানকে সামরিক সক্রিয়তার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভিয়েতনামের মতো চূড়ান্ত বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।
এ অবস্থায় সমঝোতাই হতে পারে ওয়াশিংটনের সামনে সর্বোত্তম পথ। ইমরান খান উভয় দেশের লাভের হিসাব থেকে সহযোগিতা করতে পারে বলে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন সেটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে তিনি সামরিক বেসামরিক উভয় নীতিনির্ধারকদের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। নিরাপত্তার জন্য চীননির্ভর নীতি পাকিস্তানের জন্য স্থায়ী হওয়ার অর্থনৈতিক কিছু ঝুঁকি রয়েছে। চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর বিনিয়োগ ক্ষেত্রে সহায়তা করলেও বৈশ্বিক পণ্য বাজার ও রেমিটেন্সের জন্য পাকিস্তানের অর্থনীতির পাশ্চাত্যনির্ভরতা অনেক গভীর।
এই বিবেচনায় আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি নিরাপদ আমেরিকান প্রস্থানের ব্যবস্থা করা যেমন বিশেষভাবে প্রয়োজন, তেমনিভাবে নিজ আঙিনায় অস্থিরতা আরো বেশি দিন চলতে দেয়া পাকিস্তানের জন্যও বিপজ্জনক। আবার একই সাথে অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিষয়টিও অনেক বড়। এসব বিবেচনা সম্ভবত ইমরান খানকে ক্ষমতায় আসতে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে তার পেছনে একটি প্রধান কারণ। আর এ কারণে ট্রাম্প সম্ভবত তালেবান এবং তার সমর্থকদের পরাজিত করার জন্য অপ্রচলিত ও আরো আগ্রাসি কৌশলগুলো বিবেচনা না করে আলোচনার পথকে প্রশস্ত করবেন। তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনার ব্যাপারে একধাপ অগ্রগতি হয়েছে জুলাইয়ের কাতার বৈঠকে। আফগান সরকারের দীর্ঘ সময়ের জন্য অস্ত্রবিরতির প্রস্তাবও ইতিবাচক। আগামী সপ্তাহগুলোয় তিনি যে কৌশল নেবেন তার প্রভাব দেখা যেতে পারে।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের কেন্দ্রে থাকবে পাকিস্তান। ভারতকে সাথে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে শান্তিপূর্ণ প্রস্থান করতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা না থাকায় ওয়াশিংটনকে মনোযোগী হতে হবে পাকিস্তানের প্রতি। ওয়াশিংটন আশা করছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি যুক্তিসঙ্গত রাজনৈতিক নিষ্পত্তির দিকে তালেবানকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। যদিও এখনো পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে তালেবানরা তাদের অবস্থানে কোনো আপস করবে। তবে এ অঞ্চলের সব প্লেয়ারদের যে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো না কোনো স্বার্থ রয়েছে তাতে সংশয় নেই। ফলে সব পক্ষের চাপে তালেবানদের শান্তির পথেই অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তো এ কারণেই গত সপ্তাহান্তে এক বিবৃতিতে তালেবান প্রধান মোল্লা আখন্দজাদা মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাম্প্রতিক যোগাযোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। যদিও অবাস্তব প্রস্তাব দেয়ার জন্য তিনি ওয়াশিংটনের সমালোচনাও করেছেন এবং বলেছেন এটি কেবল যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে।
আফগান তালেবানদের অন্যতম প্রধান দাবি হলো আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়া। সেই সাথে, তালেবানেরা এটাও বলে এসেছে যে, তারা শান্তি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, কিন্তু সেটা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে, আফগান সরকারের সাথে নয়। কার্যত, ২৩ জুলাইয়ের মার্কিন-তালেবান দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের মধ্য দিয়ে তালেবানদের মর্যাদা একরকম পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। তালেবানেরা বহু দিন ধরে এটাই কামনা করে এসেছে। তালেবানেরা নিজেদের শুধু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, ‘অপেক্ষমাণ সরকার’ হিসেবেও বিবেচনা করে। তারা স্পষ্টতই একটা শক্তির জায়গা থেকে কাজ করছে এবং দরকষাকষি করছে। শান্তির সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা