৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে বড়াল বন্ধ সেচ কার্যক্রম ও নৌপথে ব্যবসা

-

চলনবিলের প্রাণ বড়াল এখন পানি শূন্য। বড়াল সংযুক্ত ৭৭টি নদী, বিল ও খাড়ি পাড়ে শুধুই হাহাকার। এসব নদী-বিল-খাড়ির বুকে ধানসহ নানা ফসল চাষ হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, দখল দূষণে বড়ালের অস্তিত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। বড়াল মরে যাওয়ায় দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হতে চলেছে বিপর্যস্ত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব। নদী-বিলকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেচ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
পদ্মা এবং যমুনা নদীর সংযোগ রক্ষাকারী বড়াল নদীর দৈর্ঘ্য ২০৪ কিলোমিটার। পদ্মার শাখা ও চলনবিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী হচ্ছে বড়াল। নদীটি রাজশাহীর চারঘাট পদ্মা থেকে চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মুশাখা, নারদ, নন্দকুজা, চিকনাইসহ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে পাবনার চাটমোহর ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর উপজেলা হয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী হয়ে যুমনা নদীতে মিশেছে। বড়াল পাবনার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড়াল অববাহিকায় ধান, চাল, মসুর, খেসারি, সরিষা, মাস কালাই চাষে সারা দেশে সুখ্যাতি লাভ করে। বড়াল পাড়ের ফসল নৌপথে চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারয়ণগঞ্জ ও খুলনায় পাঠানো হতো। তাই বড়ালের ধারে চারঘাট, পুঠিয়া, বাগাতিপাড়া, দয়ারামপুর ক্যান্টনমেন্ট, বড়াইগ্রাম, বনপাড়া, রামনগর, চাটমোহর, মির্জাপুরে নদী বন্দর গড়ে উঠে। আশির দশকের শুরুর দিকেও বড়াল দিয়ে বড় বড় নৌকা, বার্জ, কার্গোতে পণ্য সামগ্রী পরিবহন হতো। বড়াল নদীর ইলিশ মাছ, পাবদা, চিংড়ি, চিতল, আইড় ও বোয়াল মাছের ছিল ব্যাপক সুখ্যাতি। এখন নদীটি বলা চলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে। বর্ষায় দুই মাস পানি থাকলেও সারা বছর বড়াল পানি শূন্য হয়ে পড়ে। তখন এর চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া অংশে ধান চাষ করা হয়।
নদীর দৈর্ঘ্য ২২০ কিলোমিটার। বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলন সূূত্র জানায়, রাজশাহীর চারঘাটে বড়ালের উৎসমুখে একটি স্লুুইসগেট, ৪৬ কিলোমিটার ভাটিতে আটঘড়ি নামক স্থানে আরো একটি স্লুইস গেট, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় ব্যাপক নদীর পাড় দখল, ১২৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাবনার চাটমোহর উপজেলার রামনগর ঘাট, বোঁথড় ঘাট ও নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকায় বড়ালের বুকের ওপর তিনটি ক্রসবাঁধ ও বনপাড়ার ভাটিতে বড়াল নদীতে তৃতীয় ও চতুর্থ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয় ভাঙ্গুড়া এবং চাটমোহরের দহপাড়ার নিকটে। দহপাড়ার নিকটবর্তী স্লুইস গেটটির উভয় পার্শ্বই শুকিয়ে যায় শুষ্ক মৌসুমে।

এদিকে বনপাড়া ভূমি রাজস্ব অফিস বড়াল নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর জমি দখলে নিয়ে করা হয়েছে হাউজিং সোসাইটি। মরে যাওয়া নদীর প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা এভাবে দখল করে পাকাপাকিভাবে যারা বসে আছেন তারা নানা কায়দায় তা দখলে রাখার জন্য তদবির করছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে পানি উন্নয়ন বোর্ড বড়াল বেসিন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখে নির্মাণ করে ক্লোজার বা তিন দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট। পদ্মা নদী থেকে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়া বড়াল নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করা হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের আটঘড়ি নামক স্থানে আরো একটি পাঁচ দরজা বিশিষ্ট স্লুইস গেট নির্মাণ করে। এই গেটি নির্মাণ করার ফলে দক্ষিণ দিকের অংশে পানি থাকলেও উত্তরের অংশে পানি চলাচল একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখানেই বড়াল দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এক ভাগ নন্দকুঁজা এবং অপর ভাগ বড়াল। এখানেই বড়ালের মুখে নির্মাণ করা হয় এক দরজা বিশিষ্ট একটি স্লুইস গেট। যেহেতু নদীটিকে এভাবে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। অতএব এর পর যা হওয়ার তাই হয়েছে। যে যেখানে যতটুকু পারে নদী দখল করেছে। নদীর মধ্যে ঘরবাড়ি, দোকান-গুদাম উঠিয়েছে। নদীর মধ্যে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় নদীতে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর পানি চলাচল বন্ধ করে দিয়ে মাছ চাষ করছে।
চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা, বোঁথড়, নতুন বাজার খেয়াঘাট, কুমারগাড়া, দোলংসহ বেশ কিছু এলাকায় বড়াল নদী পরিদর্শন ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব চিত্রের কথা। কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, একসময় বড়াল নদীর পানি দিয়ে চলত আমাদের কৃষি কাজ। এখন সেই নদীতে পানি না থাকায় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। এর বিকল্প হিসেবে নদীর তীরে ফলদ বাগান গড়ে তোলা হলেও পানির অভাবে ফলন ভালো হচ্ছে না। নতুন বাজার খেয়াঘাট এলাকার মৎস্যজীবী সুবল হালদার বলেন, চলনবিল ও বড়াল নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ও খ্যাতি ছিল দেশব্যাপী। এছাড়া ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সাথে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে মাছ যেত কলকাতায়। এই নদীর মাছ বিক্রি করে সংসার চলত আমাদের। অনেক মৎস্যজীবী ছিল এলাকায়। এখন নদীতে পানি নেই, মাছও নেই। অনেক জেলেই পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
নদী মরে যাওয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশাল চলনবিলে। চলনবিলের প্রসিদ্ধ মৎস্যসম্পদ হ্রাস পেয়েছে। বিশাল গবাদিপশুর চারণভূমিতে আগের মতো মাসকালাই ও খেসারি ঘাস জন্মে না। তাতে গবাদিপশু সম্পদ মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে বড়ালে পানি প্রবাহ না থাকায় বিল শুকিয়ে যায়। বিলে পানির সঙ্কট দেখা দেয়। চাষি ও মৎস্যজীবীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। জেলে সম্প্রদায় এখন বিলুপ্ত প্রায়। উত্তরাঞ্চলের মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত চলন বিলে ৭০ থেকে ৭৫ প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এখন তার অনেক প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement