৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কেন পাল্লা দিয়ে একটি ডুবন্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজছে?

এফ৩৫-সি বিমান - ছবি - বিবিসি

দক্ষিণ চীন সাগরে ডুবে যাওয়া মার্কিন একটি যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নৌবাহিনী।

১০ কোটি ডলারের (৭.৪ কোটি পাউন্ড) এফ৩৫-সি বিমানটি মার্কিন রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন থেকে উড্ডয়নের সময় ভূপাতিত হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে পড়ে নিমজ্জিত হয়।

মার্কিন নেভির ভাষ্যমতে এটি একটি 'দুর্ঘটনা'।

তাদের একেবারে নতুন প্রযুক্তির একটি নতুন বিমান ছিল এটি। বিমানটি বিশেষায়িত এবং গোপন প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।

যেহেতু এখন এটি আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমার মধ্যে রয়েছে, আইন অনুযায়ী যে কোনো দেশ এটি উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারে।

তাই এই বিমানের কাছে আগে যেই দেশ পৌঁছাবে, তারাই এর মালিকানা দাবি করতে পারবে।

আর এই বিমান উদ্ধারের পুরস্কার হলো অত্যন্ত দামী, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আকাশযানটির সব রহস্য।

সোমবার এক সেনা মহড়ার সময় ডুবে যাওয়ার আগে বিমানটি রণতরী ভিনসনের ডেকে আঘাত করে এবং সাতজন নাবিক আহত হন।

বিমানটি এখন সমুদ্রের তলদেশে পড়ে আছে, কিন্তু এটি নিয়ে এরপর কী করা হবে তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

বিমানটি ঠিক কোন অবস্থানে রয়েছে বা এটি উদ্ধার করতে কত সময় লাগতে পারে, এসব তথ্য প্রকাশ করছে না মার্কিন নেভি।

দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটাকেই নিজেদের বলে দাবি করে চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের এই দাবি পাকাপোক্ত করার জন্য নানারকম পদক্ষেপও নিয়েছে তারা।

২০১৬ সালে এক আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছিল যে, চীনের এই দাবির পেছনে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তবে চীন ওই রায় মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

মার্কিন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের সেনাবাহিনী এই বিমানের কাছে পৌঁছাতে 'অত্যন্ত উদগ্রীব।'

একটি উদ্ধারকারী মার্কিন জাহাজ বিমান ধ্বংসের জায়গা থেকে ১০ দিনের দূরত্বে রয়েছে বলেও বলছেন তারা।

তবে বিমানের কাছে যেতে ১০ দিন লাগলে অনেক দেরি হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন প্রতিরক্ষা বিষয়ক পরামর্শদাতা আবি অস্টেন।

তিনি মনে করেন, ১০ দিনের মধ্যে বিমানের ব্ল্যাক বক্সের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে এবং তখন বিমানটির অবস্থান চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ‘’এ বিমানটি ফিরে পাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এফ-৩৫ আসলে উড়ন্ত একটি কম্পিউটারের মত। অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের সাথে সংযোগ করার জন্য প্রস্তুত করে এটি তৈরি করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর ভাষায় এটি 'সেন্সরের সাথে শুটারের সংযোগ' তৈরি করে।"

চীনের কাছে এই প্রযুক্তি নেই, তাই তারা যদি এই বিমানের দখল নিতে পারে তাহলে সেটা হবে তাদের জন্য একটা বড় ধরণের অগ্রগতি - বলছেন প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা অস্টেন।

এফ-৩৫ বিমানে কী আছে
নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত মিশন সিস্টেম, যার ফলে বিমান চলাকালীন সময়ে এটি তাৎক্ষণিকভাবে ওই সময়ের তথ্য সরাসরি আদান-প্রদান করতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্রথম 'লো অবজার্ভেবল' ক্যারিয়ারভিত্তিক বিমান, যেটি শত্রুর আকাশসীমায় শনাক্ত না হয়ে অভিযান পরিচালনা করতে পারে।

অপেক্ষাকৃত বড় পাখা ও আরো শক্তিশালী ল্যান্ডিং উপকরণ, যার ফলে এটি সমুদ্রে থাকা রণতরী থেকে 'ক্যাটাপুল্ট' আক্রমণ চালাতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইটার ইঞ্জিন। এটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০০ মাইল পর্যন্ত গতিবেগ অর্জন করতে পারে।

দুই পাখায় দুটি এবং ভেতরে চারটি মিসাইল বহন করতে পারে।

চীন যে এই বিমানের দখল চায়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

যদিও সাইবার গুপ্তচরবৃত্তির কল্যাণে বিমানটির ভেতরে কী আছে এবং এটি কীভাবে কাজ করে - এই বিষয়ে এরইমধ্যে তাদের কিছু জ্ঞান আছে বলে ধারণা, মন্তব্য ব্রাইস ব্যারসের, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা ট্রুম্যান প্রজেক্টের নিরাপত্তা বিষয়ক ফেলো এবং চীন বিষয়ক বিশ্লেষক।

ব্যারস বলেন, ‘আমার মনে হয় তারা বিস্তারিত বোঝার সুবিধার্থে বিমানটির অংশবিশেষ দেখতে চাইবে - যেন এটি কীভাবে তৈরি করা হয়েছে তা বুঝতে পারে এবং এর দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারে।’

উদ্ধারকার্য কীভাবে পরিচালিত হবে?
মার্কিন নেভির একটি উদ্ধারকারী ও ডুবুরি দল বিমানটির মূল কাঠামোর সাথে ব্যাগ সংযুক্ত করবে। ধীরে ধীরে সেসব ব্যাগ ফুলানো হবে এবং বিমানের ধ্বংসাবশেষ এর সাহায্যে পানির উপরে ভেসে উঠবে।

বিমানের মূল কাঠামোটি যদি মোটামুটি অখণ্ড না থাকে, তাহলে এই পদ্ধতিতে বিমান উদ্ধার করা কঠিন হয়।

বিমানটিতে কমপক্ষে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ছিল বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো হয় এটির দুই পাখার সাথে সংযুক্ত ছিল অথবা অভ্যন্তরীণ অস্ত্রাগারে রক্ষিত ছিল, যা উদ্ধার করা জটিল হয়ে বসতে পারে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই ইঁদুর দৌড়ে যে জিতবে তার ভাগেই লাভের গুড় পড়বে, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

১৯৭৪ সালে যখন স্নায়ুযুদ্ধ তুমুল উত্তেজনাকর অবস্থায়, তখন সিআইএ একটি দৈত্যাকার যান্ত্রিক হাত ব্যবহার করে হাওয়াই উপকূলে গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে অতি গোপনে একটি রুশ সাবমেরিন তুলে নেয়।

তার দুই বছর আগে চীন গোপনে একটি ব্রিটিশ সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করে। এইচএমএস পসেইডন নামের এই সাবমেরিনটি নিমজ্জিত হয়েছিল চীনের পূর্ব উপকূলে।

অনেকেই ধারণা করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন 'স্টেলথ' হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ একবার চীনের হস্তগত হয়েছিল।

২০১১ সালে ওসামা বিন লাদেনের বাড়িতে অভিযান চলাকালে হেলিকপ্টারটি ভূপাতিত হয়।

ব্যারস বলছেন, ‘আমরা নিশ্চিত যে চীনের সেনাবাহিনী এটিতে থাকা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দেখার একটা সুযোগ তখন পেয়েছিল।’

সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর তলদেশ থেকে ধ্বংসাবশেষ তুলে আসার গিনেজ রেকর্ডধারী ঘটনাটি ছিল ২০১৯ সালে।

ওই বছর মে মাসে ফিলিপাইন সাগরের প্রায় সাড়ে এগার হাজার ফুট বা ৫,৬৩৮ মিটার গভীর থেকে একটি পরিবহণ বিমানের ধ্বংসাবশেষ তুলে আনে মার্কিন নেভি।

আরেকটি উপায় অবশ্য ছিল, বিমানটিকে বেইজিংয়ের হস্তগত হওয়া ঠেকাতে একেবারে ধ্বংস করে ফেলতে হত।

‘সবচেয়ে সহজ হতো যদি এটাকে লক্ষ্য করে টর্পেডো ছোঁড়া যেত!’ বলেছিলেন একজিন সেনা কর্মকর্তা।

কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, সেই সহজ উপায়টিকেও কেউ গ্রহণ করেনি সে সময়।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement